রাত পোহালেই অনুষ্ঠিত হবে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম পর্বের ভোট। সহিংসতার শঙ্কা ও নানামুখী অভিযোগ নিয়েই ১৪১টি উপজেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নির্বাচন। আনুষ্ঠানিক প্রচার সমাপ্ত হলেও শেষ মুহূর্তের নানা হিসাবনিকাশ মেলাতে ব্যস্ত ভোটার ও প্রার্থীরা। ভোটের দিন ঘিরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কোনো অংশেই কম নয়। দলীয় প্রতীক না দেওয়ায় প্রায় প্রতিটি উপজেলায় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ফলে প্রতিটি এলাকায়ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। আর এ কারণেই নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন উপজেলায় তৈরি হয়েছে সংঘাতের শঙ্কা। এরই মধ্যে প্রচারণার সময় প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, প্রার্থীর ওপর হামলা ও প্রচারে বাধা দেওয়ার মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। এদিকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে এরই মধ্যে নানা প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের মতোই বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচন বয়কট করায় বেশিরভাগ উপজেলায় মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই। জাতীয় নির্বাচনের বিভেদের রেশ উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে এমন শঙ্কায় আওয়ামী লীগদলীয় প্রার্থী দেওয়া থেকে বিরত থাকে। এমনকি নির্বাচনকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের প্রার্থী না হতে নির্দেশনা দেয়। দলীয় নির্দেশ উপেক্ষা করে এর পরও বেশ কিছু উপজেলায় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের স্বজন ও নিকটাত্মীয় প্রার্থী হওয়ায় সংঘাতের শঙ্কা রয়েই গেছে। তা ছাড়া উপজেলাগুলো প্রতিটি সংসদীয় আসনের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালীরা নিজেদের দখলে রাখার চেষ্টায় ভোটে প্রভাব বিস্তার করার আশঙ্কায় ভোটেও এর প্রভাব ফেলতে পারে।
উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ইসির এক বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমাদের দেশে নির্বাচনে আবেগ-অনুভূতির জন্য কিছুটা বিশৃঙ্খলা হয়। তবে ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। যে কোনো মূল্যে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে। সুষ্ঠু ভোটে ব্যর্থ হলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হতে পারে।’
এদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও কোথাও সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে কোথাও কোথাও হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রশাসনকে। গতকালও নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিনেও কয়েকটি উপজেলায় হুমকি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট না দিলে এলাকার উন্নয়ন বন্ধের হুমকিও দিয়েছে প্রভাবশালী প্রার্থীদের প্রচারে অংশ নেওয়া নেতারা।
নির্বাচনকে সংঘাতমুক্ত করতে সার্বিক ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচন কমিশন। ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু করতে প্রতিটি ইউনিয়নে দায়িত্বে পালন করবেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে পুলিশ ও আনসারের সমন্বয়ে ১৭ থেকে ১৮ জনের দল নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও ৯৯৯-এ অভিযোগ জানানো যাবে। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় ২-৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হবে।
নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে সার্বিক সহযোগিতা করবে ক্ষমতাসীনরা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ তার নেতাকর্মীদের দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করতে নির্দেশ দিয়েছে। তার পরও যদি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে তবে সেসব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। সাংগঠনিক শাস্তি গ্রহণের হুমকিও দিয়েছে দলটি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনে যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে, তাদের কোনো না কোনোভাবে শাস্তির মুখোমুখি হতেই হবে।
এদিকে গতকাল সোমবার জামালপুর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাবেক মোজাফফর হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। জামালপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদে বিজন কুমারকে ছাড়া অন্য কাউকে ভোট দিলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা হবে—মোজাফফর হোসেনের এমন বক্তব্যের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে তিনি ছাড়াও প্রার্থী বিজন কুমার চন্দকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান মিনহাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রভাব খাটানো ও প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জাকির হোসেন। অবাধ, সুষ্ঠু, প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত না হলে ভোট বর্জনের হুমকিও দিয়েছেন মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী জাকির হোসেন। মিনহাদুজ্জামান বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই।
অন্যদিকে ছেলের বিরুদ্ধে ভোট করলে ইউনিয়নে উন্নয়ন ঠেকিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর স্ত্রী। সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একমাত্র ছেলে আতাহার ইশরাক সাবাব চৌধুরীর প্রচারণায় এমন মন্তব্য করেছেন কবির হাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুন নাহার শিউলী। এমনকি সাবাব চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভোট করায় ইউপি সদস্যকে ‘ডিও লেটার’ বন্ধের ভয় দেখিয়েছেন তিনি।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থী বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাস এক তরুণকে জনসম্মুখে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। নির্বাচনের শেষ সময়ে এমন একটি বিষয় কোটালীপাড়ার মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রার্থীকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের দুই সংসদ সদস্য হুমকি দিয়ে বক্তব্য দেওয়ায় এই উপজেলা নির্বাচন নিয়েও জনমনে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
এ ছাড়াও গত কয়েক দিনে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, নীলফামারীর ডোমারের পাঙ্গামুটুকপুর ইউনিয়নের পাঙ্গা বাজারে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার ধামোরহাটে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে পাল্টাপাল্টি হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর, মাদারীপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের তালতলা এলাকায় আনারস প্রতীকের দুই কর্মীকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে, যা ভোটে প্রভাব ফেলবে। এর জেরে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্য ভোটের দিনেও কাজ করবে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
তবে সবরকম শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে সংঘাতের কোনো আশঙ্কা নেই। যদি কোথাও তেমন কিছু হয়, দল কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। এমন নির্দেশনা দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করবে, স্থানীয় প্রশাসনতো রয়েছেই। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তার ভূমিকা পালন করবে, যেন একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হয়।’