প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে। গতকাল রোববার রাত ৮টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের পটুয়াখালীর খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে। ঘূর্ণিঝড়টির বিস্তৃতি প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। সম্পূর্ণ ঘূর্ণিঝড়টি পরবর্তী পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টার উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এদিকে ঘূর্ণিঝড় উপকূল ছোঁয়ার আগেই পটুয়াখালী ও সাতক্ষীরায় মারা গেছেন দুইজন। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে পুরো সুন্দরবন। ১৫ জেলায় ৮-১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঝড়ের তোড়ে উপড়ে গেছে অনেক গাছপালা, বিধ্বস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। মোংলা ও পায়রাসহ ৯ জেলায় ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত, ৪ জেলায় ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। দুর্যোগকবলিত এলাকার মানুষের জন্য ৯ হাজার আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত খাবার এবং চিকিৎসাসামগ্রী মজুত রাখা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে গতকাল দুপুর থেকেই উপকূলে ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি শুরু হয়। উত্তাল হয়ে ওঠে সাগর। আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয় নৌ চলাচল। উড়োজাহাজ ওঠানামায় লাগাম টানা হয়েছে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও কক্সবাজার বিমানবন্দরের। বন্ধ রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেলে যান চলাচল। এদিকে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাচন বাতিল করা হবে বলে জানিয়েছে ইসি। এদিকে দুর্যোগ মোকাবিলা এবং দুর্গত মানুষের পাশে থাকার জন্য সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করেছে সরকার। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪০ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। গাছ পড়ে, লাইন ছিঁড়ে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
আবার দুর্ঘটনা এড়াতে অনেক এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক এলাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক অচল হয়ে পড়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মুহিববুর রহমান গতকাল রাতে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি। সারারাত আতঙ্কে থাকব। এখন ১১০-১২০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইছে। ঘূর্ণিঝড়ের মূলভাগ উপকূলে আঘাত করার পর বাতাস আরও বাড়তে পারে। ততক্ষণে জোয়ারের সময় হবে। তাই পানির পরিমাণও বাড়বে।
প্রতিমন্ত্রী জানান, উপকূল এলাকায় ৯ হাজার আশ্রয়কেন্দ্রে ৮ লাখ লোক সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও উপকূল এলাকার স্কুলগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছে গেছে। পুরো উপকূলীয় এলাকায় বাতাস বইছে, ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হচ্ছে। সাতক্ষীরা থেকে ভোলায় বেড়িবাঁধ ভেঙেছে, লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছে, সেখানে সবার খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গতকাল রাত ১১টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল সামান্য উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি রাত ৯টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩০০ কিলোমিটার পশ্চিম, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩০৫ কিলোমিটার পশ্চিম, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর দিকে ধীরগতিতে অগ্রসর হয়ে মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম অব্যাহত রেখেছে। ঘূর্ণিঝড়টি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে পরবর্তী ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮-১২ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারী বর্ষণের প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে।
বিভিন্ন স্যাটেলাইট ও পূর্বাভাস পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, ঝড়ের কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ, সুন্দরবন (ভারতীয় অংশ), কলকাতা হয়ে দেশের খুলনা, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া অঞ্চল দিয়ে স্থলভাগ অতিক্রম করবে। এ ক্ষেত্রে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরে বেশি প্রভাব পড়বে। একই সঙ্গে কেন্দ্রের চারপাশের প্রভাব পড়বে পটুয়াখালী থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘একটা ঝড়ের চোখের ব্যাস ৩০ থেকে ৬০ কিলোমিটার অথবা ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার হয়ে থাকে। মোংলা থেকে সাগরদ্বীপের দূরত্ব দেখলেই বোঝা যাবে। সাইক্লোনের ব্যাস এদিক-সেদিক হবেই। এটি একটা পয়েন্ট দিয়ে উপকূল অতিক্রম করে না। একটা এরিয়া নিয়ে করে। একে বলে সাইক্লোনের মট এরিয়া। মট এরিয়া একটু এদিক-সেদিক হবেই। সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা মট এরিয়াকে বিশ্লেষণ করি। বৈজ্ঞানিকভাবে উপকূল অতিক্রম করা মানে সেটির কেন্দ্রের উপকূল অতিক্রম করা বোঝায়।’
জাপানি স্যাটেলাইট দিয়ে রিমাল পর্যবেক্ষণ করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ নাথ। তিনি বলেন, ‘এই ঝড়ের কেন্দ্র কখনো পটুয়াখালীর খেপুপাড়া দিয়ে পার হবে না। তবে সেখানে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। এটির কেন্দ্র ভাগ মূলত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে পার হবে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের দিঘা, হলদিবাড়ি ও সুন্দরবন অংশ দিয়ে কলকাতা হয়ে বাংলাদেশ ঢুকবে। আর এতে করে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চল।’
ড. বিশ্বজিৎ নাথ জানান, পুরো রাত এটি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা হয়ে অগ্রসর হবে। এ সময় এর গতিবেগ ১৫০ কিলোমিটারের কাছাকাছি থাকতে পারে। এই অঞ্চলে স্থলভাগের তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে সে এই শক্তি পাবে। আর কেন্দ্রের ডান অংশ তাণ্ডব চালাবে সাতক্ষীরা ও শ্যামনগর অংশে। আর রাত ২টা থেকে ৩টার মধ্যে এটি কলকাতা পার হবে। এরপর কুষ্টিয়া, মেহেরপুর হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে আজ সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে। এ সময় এর গতিবেগ থাকতে পারে ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটারের মধ্যে। ফরিদপুর, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চল রিমালের তাণ্ডব মোকাবিলা করবে। আগামীকাল মঙ্গলবার পুরোটা সময় অবস্থান করে এটি মিলিয়ে যাবে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রকৃতি সম্পর্কে বলেন, এটিকে প্রায় আইলার সঙ্গে তুলনা করতে পারি, একই ক্যাটাগরির। আবার কোনো ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে কোনো ঘূর্ণিঝড় সিমিলার হবে না। মানে খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে রিমাল পার হওয়ার সময় বামে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা পাবে আর ডানে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে বরিশাল-পটুয়াখালী পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে খেপুপাড়ার পাশা দিয়ে অতিক্রমের সময় সুন্দরবনের ওপর দিয়েও এর প্রভাব থাকবে যেমন, বরিশাল-পটুয়াখালীতেও পড়বে। খেপুপাড়া থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব অন্তত ১০৮ কিলোমিটার। এ সময় বনায়নের কারণে সুন্দরবন ও আশপাশের এলাকা হয়তো কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বনায়ন কম—এমন এলাকায়, বরিশাল-পটুয়াখালীতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে।
আজিজুর রহমান বলেন, কেন্দ্রভাগ অতিক্রম করলেও ঘূর্ণিঝড় শেষ হবে না, এরপর তার নিম্নভাগ বা শেষের অংশ ভূমি অতিক্রম করবে। সে অবস্থায়ও বাতাস হবে, বৃষ্টি হবে, ঝোড়ো হাওয়া হবে, জলোচ্ছ্বাস হবে।
ঘূর্ণিঝড় দুর্বল হওয়ার প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে গিয়ে আজিজুর বলেন, এটা যখন পরিপূর্ণভাবে স্থলভাগে আসবে, সেটি আর শক্তি অর্জন করতে পারবে না। স্থলভাগে আসার পর এটি গাছপালা, বিল্ডিং, অবকাঠামোর কারণে একসময় আর শক্তি অর্জন করতে পারবে না। কারণ তার সোর্স বন্ধ হয়ে যাবে। সোর্স হচ্ছে সাগর। তখন পর্যায়ক্রমে এটি দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হবে।
সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল: ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষয়ক্ষতি রোধের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ সারা দেশের সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করেছে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান এ কথা বলেন। তিনি বলেন, রিমালের প্রভাবে সাতক্ষীরা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পুরো এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। এ সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। এ কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ: ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে উপকূলীয় জেলাগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবহারের জন্য এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় যেসব অবকাঠামো আছে, সেগুলো ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেবে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেখানে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী অবস্থায় সে প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান কার্যক্রম জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ীই হবে।
পটুয়াখালীতে ও সাতক্ষীরায় দুজনের মৃত্যু: পটুয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বোন ও ফুপুকে নিরাপদ রাখার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে গিয়ে পানির তোড়ে ভেসে মারা গেছেন এক যুবক। গতকাল দুপুরে কলাপাড়া উপজেলার ধুলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় তলিয়ে যাওয়া সড়ক সাঁতার কেটে পার হতে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ২৮ বছরের শরীফ হাওলাদার ওই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অনন্তপাড়া এলাকার আবদুর রহিম হাওলাদারের ছেলে।
এদিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। শ্যামনগর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান বলেন, ঘূর্ণিঝড়কে কেন্দ্র করে নাপিতখালী গ্রামে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সন্ধ্যায় গ্রামের বাসিন্দা শওকাত মোড়ল (৬৫) বাড়ি থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় হয়ত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন।
জোয়ার ও বাঁধ ভেঙে প্লাবিত বিভিন্ন এলাকা: দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টিতে উপকূলীয় অঞ্চলের
নদ-নদীগুলো উত্তাল হয়ে উঠেছে। পায়রা নদীতে পানি বৃদ্ধিতে ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলার ২৭ গ্রাম। গতকাল দুপুরে পায়রা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে চার-পাঁচ ফুট পানি বৃদ্ধি পেলে আমতলীর বালিয়াতলী ও পশুর বুনিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যায়। ইউপি চেয়ারম্যান সোহেলী পারভীন মালা জানান, পায়রা নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ৩০০ ফুট ভেঙে গেছে। এর ফলে বালিয়াতলী ও পশুরবুনিয়া গ্রাম ২-৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে বোরো ধানের ক্ষেত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে এ বাঁধ ভেঙে গেছে অভিযোগ করেন তিনি।
আমতলীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরের আরপাঙ্গাশিয়া, তারিকাটা, লোছা, বৈঠাকাটা, বাসুগি, নয়াভাঙ্গলী, ফেরিঘাট, খাদ্যগুদাম সংলগ্ন চর, ওয়াপদা চর, পশ্চিম ঘটখালী, আংগুলকাটা, গুলিশাখালীর জেলেপাড়া তলিয়ে গেছে। তালতলী উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরের মরানিদ্রা, আগাপাড়া, মেনিপাড়া, গোড়াপাড়া, অংকুজানপাড়া, মোয়াপাড়া, নামিশেপাড়া, ছোবাহাপাড়া, খোট্টারচর, জয়ালভাঙ্গা, আশারচর, তেতুলবাড়িয়া, জয়ালভাঙ্গা, সকিনা, আমখোলা গ্রামও প্লাবিত হয়েছে।
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় প্লাবিত হয়েছে ১৫টি গ্রাম। হাতিয়ায় নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৪-৫ ফুট বেশি উচ্চতায় প্রবাহিত হয়। এতে নিঝুম দ্বীপসহ আশপাশের ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া হরণী ইউনিয়নের চর ঘাসিয়া, বয়ারচর গ্রাম, নলচিরা ইউনিয়নের তুফানিয়া গ্রাম, তমরদ্দি ইউনিয়নের পশ্চিম তমরদ্দি গ্রাম প্লাবিত হয়।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ২৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের একাধিক জায়গা থেকে পানি প্রবেশ করায় গরুভাঙ্গা, চরলতা, চিনাবুনিয়াসহ ওই ইউনিয়নের সব কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দক্ষিণ চরমোন্তাজ নয়ারচর এলাকায় গ্রামরক্ষা বাঁধ অতিক্রম করে গ্রামের মধ্যে পানি প্রবেশ করেছে। এতে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া মৌডুবী ইউনিয়নের আওতায় চরহেয়ার, আশাবাড়িয়া, নিচকাটা ভাঙ্গার খাল এলাকাসহ উপজেলার ২৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
খুলনার উপকূলীয় কয়রায় ১০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। পাইকগাছায় তিনটি স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙে পোল্ডারে লবণ পানি ঢুকে পড়ছে। বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রাজৈর এলাকার স্লুইসগেট নির্মাণের জন্য দেওয়া বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এই উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের তেরাবেকা এলাকায় রিংবেরি বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এতে প্রায় ৫০০ বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া মোরেলগঞ্জ উপজেলার পানগুছি, বাগেরহাট সদর উপজেলার ভৈরব, মোংলার পশুর নদীর পানি বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ও সড়ক উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে।
প্লাবিত হয়েছে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন এলাকা। বন বিভাগ বলছে, ঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট উঁচু জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসের কারণে সুন্দরবনের হরিণ, বানর, বেঙ্গল টাইগারসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। মিঠা পানির পুকুর তলিয়ে যাওয়ার কারণে বনের প্রাণিকুল ও বনকর্মীদের বিশুদ্ধ পানির সংকটও তৈরি হতে পারে। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রবল বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারে প্লাবিত হয় ভোলার সদরের ধনিয়া, নাছির মাঝি, রাজাপুর, শিবপুর, চটকিমারার চর, চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, কুকরী-মুকরি ও চর পাতিলা, দৌলতখানের সৈয়দপুরসহ মনপুরার বেশ কিছু নিচু এলাকা। জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৫ হাজার পরিবার।
কক্সবাজারে সাগরের জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট বেড়েছে। এতে জেলার বেশকিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজার সদরের কুতুবদিয়া পাড়া, সমিতি পাড়া, গোমাতলী, পোকখালী, ইসলামপুর, মহেশখালী-কুতুবদিয়াসহ জেলার ২০টি গ্রামে জোয়ারের পানি ঢুকেছে।
৪০ লাখ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন: পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৪টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ২৫ লাখ ৬৯ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎহীন এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে পটুয়াখালী, বাগেরহাট, ভোলা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, বরিশাল ও ঝালকাঠি। দক্ষিণাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ওজোপাডিকোরও ২-৩ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত যে কোনো প্রয়োজনে ১৬৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়েছে।
উপকূলে প্রস্তুতি: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নেওয়া হয়েছে বিশেষ প্রস্তুতি। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করার পাশাপাশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে শুকনো খাবার। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসের নিকটবর্তী ফায়ার স্টেশন, বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হটলাইন নম্বর ১৬১৬৩ অথবা কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলের জরুরি মোবাইল নম্বর ০১৭৩০৩৩৬৬৯৯-এ ফোন করার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি।
আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে অনীহা: খুলনা ও বরিশালের উপকূলীয় এলাকায় শনিবার সন্ধ্যায় ৭ নম্বর বিপৎসংকেত ঘোষণা করে আবহাওয়া অফিস। এর আগে থেকেই দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় উপকূলীয় জেলাগুলোর আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুতির নির্দেশ দেয়। গতকাল সকালের দিকে এসব এলাকায় ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত ঘোষণা করা হয়। এসব এলাকার উপজেলা প্রশাসন মাইকিং করে সতর্কতা জারি করে শনিবার সন্ধ্যা থেকেই; কিন্তু গতকাল বিকেল পর্যন্ত বেশিরভাগ আশ্রয়কেন্দ্রই দেখা অনেকটা ফাঁকা।