রাফসান জানি
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৪, ০৩:৩৫ এএম
আপডেট : ২৮ জুন ২০২৪, ০৮:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘পুলিশের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে’ মন্দিরে আত্মগোপন করে ফয়সাল-মোস্তাফিজ

আনার হত্যাকাণ্ড
‘পুলিশের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে’ মন্দিরে আত্মগোপন করে ফয়সাল-মোস্তাফিজ

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার পর ঢাকায় চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়াসহ তিনজন গ্রেপ্তারের পর অন্য আসামিরা যে যার মতো আত্মগোপনে চলে যায়। এমপি আনারকে হত্যার মিশনে অংশ নিয়েছিল সাতজন। সবশেষ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকার শ্রী শ্রী পাতাল কালীমন্দির থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে ফয়সাল আলী সাহাজী ও মোস্তাফিজুর রহমান ফকির। তারা ওই মন্দিরে আত্মগোপন করার আগে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ ধামে গিয়েছিল। সেখানে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে পাতাল কালীমন্দিরের সন্ধান পায় তারা। এরপর চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে নেমে এসে মন্দিরে আত্মগোপন করে।

গত বুধবার বিকেলে মন্দিরে অভিযান চালিয়ে আত্মগোপনে থাকা ফয়সাল ও মোস্তাফিজকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় নিয়ে আসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেওয়া ডিবির কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

ডিবির সদস্যরা জানিয়েছেন, চন্দ্রনাথ পাহাড়ে পুলিশের একটি ফাঁড়ি আছে। যেখানে ৮-৯ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। ওই এলাকায় সিসি ক্যামেরাও বসানো আছে। তবে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মন্দিরে রাতে অবস্থান করার সুযোগ নেই। দুজন ওখানে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশ তাদের বলে, ‘এখানে রাতে থাকা যাবে না।’ রাতে অবস্থান করতে পারবে না শুনে ফয়সাল ও মোস্তাফিজ পুলিশকে বলে, ‘আমরা কোথায় যাব? আমরা মায়ের (দেবী) ভক্ত। তখন ওখানকার পুলিশ তাদের বলে, ‘এই পাহাড়ের ঠিক নিচে কয়েকটি পাহাড় পরে একটা মন্দির আছে, যেখানে পুরোহিত পুণ্যার্থীদের থাকতে দেয়।’

ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, পাহাড়ে থাকা পুলিশের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে পাতাল কালীমন্দিরে যায় ফয়সাল ও মোস্তাফিজ। সেখানে গিয়ে তারা নাম ধারণ করে, শিমুল রায় ও পলাশ রায়। তারা সম্পর্কে জেঠাতো ভাই। ওই মন্দিরে যাওয়ার পর একইভাবে মায়ের ভক্ত বলে আশ্রয় নেয় ফয়সাল ও মোস্তাফিজ। মন্দিরের অন্যদের সঙ্গে মিশে যায় তারা। সকালে উঠে বাজারে যায়, কেনাকাটা করে, কাটাকুটি, রান্নাবান্না সব করা শুরু করে। যাতে কারও কোনো সন্দেহ না হয়।

গত ১৯ মের পর ফয়সাল ও মোস্তাফিজ ঢাকা থেকে পালিয়ে যায়। পাতাল কালীমন্দিরে আত্মগোপন করে গত ২৩ মে থেকে। টানা ২৩ দিন সেখানে তারা আত্মগোপনে থাকে। তবে ঈদ উদযাপন করতে কয়েকদিনের জন্য মন্দির ছেড়ে যায় তারা।

অভিযানে অংশ নেওয়া এক কর্মকর্তা বলেন, ঈদ হয় ১৭ জুন। এতদিন হিন্দু পরিচয়ে মন্দিরে আত্মগোপন করলেও ঈদের আগে ১৫ জুন তারা মন্দির থেকে চলে যায় খাগড়াছড়ির রামগড়ে। সেখানে ফয়সালের এক বন্ধু রয়েছে। তার বাড়িতে ঈদ করে। ঈদ শেষে তারা আবার মন্দিরে ফিরে আসে। তারা ফিরে আসার পর আমরা তাদের অবস্থান শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করি।

এমপি আনার হত্যার মতো হাই-প্রোফাইল মামলার আসামিরা দেশের যে কোনো জায়গায় আত্মগোপনে থাকতে পারে। কিন্তু চন্দ্রনাথ পাহাড়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের সামনে দিয়ে দুই পলাতক আসামি চলে যাওয়াকে গোয়েন্দা তথ্যের ব্যর্থতা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সন্দেহভাজন আসামিদের ছবি ও তথ্য সারা দেশের ইউনিটগুলোতে থাকার কথা। কিন্তু তার পরও আসামিদের শনাক্ত করতে না পারা চরম ব্যর্থতা।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে থাকা পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের কাছ থেকে পলাতক আসামিদের সম্পর্কে কোনো তথ্য না পেলেও তথ্যপ্রযুক্তি ও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে ফয়সাল ও মোস্তাফিজকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিবি। সীতাকুণ্ড থানাধীন ওই ফাঁড়ির এক দায়িত্বশীল সদস্য বলেন, আমাদের এখানে অনেক পুণ্যার্থী ও সাধারণ মানুষ আসে। তাদের মধ্যে কেউ আসামি ছিল কি না, তা আমাদের বোঝার উপায় ছিল না। আর এমন কোনো আসামি পাহাড়ে আত্মগোপন করতে পারে, সেই ব্যাপারে কোনো তথ্য আমাদের জানানো হয়নি।

পরিকল্পনা বুঝতে পেরে ফ্ল্যাট থেকে চলে যেতে চেয়েছিলেন আনার:

তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে প্রলুব্ধ করে গোপালের বাসা থেকে বের করার পর তাকে প্রথমে গ্রহণ করে ফয়সাল। তারা একসঙ্গে একটি জায়গায় যাওয়ার পর গাড়ি পরিবর্তন করে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল মূল কিলার আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। গাড়ি পরিবর্তন করে এমপি আনার, শিমুল ও ফয়সাল তিনজন এক গাড়িতে কলকাতা নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সে পৌঁছায়। ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে দরজা খুলে এমপি আনারকে অভ্যর্থনা জানায় শিলাস্তী রহমান। এমপিকে স্বাগত জানিয়ে শিলাস্তী চলে যায় ত্রিপ্লেক্স ফ্ল্যাটের ওপর তলায়। আর শিমুলসহ অন্যরা এমপি আনারকে নিয়ে যায় ওই ফ্ল্যাটের কর্নারের একটি কক্ষে।

কক্ষে নেওয়ার পর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তা বুঝতে পেরে ওই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এমপি আনার। কিন্তু শিমুল ভূঁইয়াসহ অন্যরা বাধা দেয়। আনারকে পেছন থেকে গলায় ধরে নাকে-মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম মেশানো রুমাল দিয়ে চেপে ধরে ফয়সাল। কিছু সময় ধস্তাধস্তির পর নিস্তেজ হয়ে পড়েন এমপি আনার। এরপর আনারকে বিবস্ত্র করে একটি চেয়ারে বেঁধে ফেলে আসামিরা। একপর্যায়ে তাকে হত্যা করা হয় এবং হাড় থেকে মাংস ছড়িয়ে মরদেহ গুম করে ফেলে।

গত বুধবার বিকেলে আনার হত্যার মিশনে সরাসরি অংশ নেওয়া ফয়সাল আলী সাহাজী ও মোস্তাফিজুর রহমানকে সীতাকুণ্ড থেকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ ও আগে গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দির বরাতে এসব তথ্য জানিয়েছেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। দুজনের ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করে ডিবি। শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল্লাহর আদালত প্রত্যেকের ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

একে একে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া সাতজনের সবাই গ্রেপ্তার হলেও হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের কোনো সন্ধান পায়নি ডিবি। এ বিষয়ে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন বলেন, কলকাতার একটি মার্কেট থেকে ১৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি চেয়ার কিনে আনে তারা। সঙ্গে আনে ক্লোরোফর্ম। সেই চেয়ারে বেঁধে আনারকে বিবস্ত্র করা হয়। এই কাজগুলো করেছে ফয়সাল। আর হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সিয়াম এনে দিয়েছিল ফয়সালকে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, এমপি আনার হত্যার কারণে কারা আর্থিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সন্দেহভাজনদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু এবং ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে হারুন বলেন, যে কোনো হত্যার পেছনে একটা মোটিভ থাকে। আনার জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ছিলেন। তাকে টাকা-পয়সা লেনদেনের কথা বলে নিয়ে যায় শাহীন। তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল? কারা লাভবান? কারা আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে লাভবান সেটা আশা করি বের হবে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা সুনির্দিষ্ট মোটিভ বলতে পারছি না। আমরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সম্ভাব্য সব কারণ আমলে নিয়ে তদন্ত করছি। আমরা সর্বশেষ গ্রেপ্তার হওয়া দুজনকে রিমান্ডে নেব। হত্যার সম্ভাব্য সব মোটিভ সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আমরা অনর্থক কাউকে ডাকাডাকি করছি না। নির্দোষ কাউকে হয়রানি করছি না।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি এস এম ইকবাল হোসেন)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, তারিখ ঘোষণা

অনুমতি ছাড়া খুলনা মেডিকেলে সংবাদ সংগ্রহে পরিচালকের নিষেধাজ্ঞা

এক টেবিলে বিএনপির হেভিওয়েট ৫ মনোনয়নপ্রত্যাশী 

ঢাবি, বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে পরিচ্ছন্নতায় ডিএসসিসি

রোববার ইতালি যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই : মির্জা ফখরুল

সেই ভিক্ষুকের ঘরে মিলল আরও এক বস্তা টাকা

শিশুর উচ্চতা বাড়াতে প্রতিদিনের খাবারে রাখুন এই ৪ জিনিস

রাজধানীর আরও বেশ কিছু এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ

গোসলে নেমে প্রাণ গেল ৩ বোনের

১০

জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে অ্যাকশনে পুলিশ

১১

ইশরাকের সঙ্গে বাগদান নিয়ে হবু স্ত্রীর স্ট্যাটাস

১২

মোবাইলে আফগানিস্তান-বাংলাদেশ ম্যাচ দেখবেন যেভাবে

১৩

‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি : দুদু

১৪

র‍্যাবের গাড়ি-বাসের সংঘর্ষে শিশুসহ নিহত ৩

১৫

কাঁদতে কাঁদতে নিজের জীবনের যে দুঃখের গল্প শোনালেন মারুফা

১৬

আমি কিছুটা ‘লক্ষ্মী’, কিছুটা ‘দুষ্টুও’: মনামী ঘোষ

১৭

ডিরেক্টর আর্টিস্ট পয়দা করতে পারে না : যাহের আলভী

১৮

মক্কা থেকে যা বললেন ফারহান

১৯

ইমা অ্যাওয়ার্ডে ‘নিশি’

২০
X