মাওলানা আব্দুর রহমান
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২০ জুন ২০২৫, ০৭:৪৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

হজের শিক্ষা ধরে রাখুন সারা জীবন

হজের শিক্ষা ধরে রাখুন সারা জীবন

হজ মানুষের অতীতের সব পাপ ধুয়েমুছে সাফ করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনোরূপ অশ্লীল কথা বা গুনাহর কাজে লিপ্ত না হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হজ সম্পন্ন করে, সে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে।’ (বোখারি: ১৫২১)। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে এ বছরের পবিত্র হজ পালন এবং দেশে ফিরতে শুরু করেছেন বায়তুল্লাহর মুসাফিররা। হাজিদের স্বজনরা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন সালাম-মুসাফাহা ও হজের বরকত লাভের জন্য। কারণ হজফেরত হাজিরা হন নিষ্পাপ। তাদের দোয়া আল্লাহতায়ালা কবুল করে থাকেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তুমি যখন কোনো হাজির দেখা পাবে তখন তাকে সালাম দেবে, মুসাফাহা করবে এবং তাকে অনুরোধ করবে তিনি যেন ঘরে প্রবেশের আগেই তোমার জন্য আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফের দোয়া করেন। তারা দোয়া করলে তা কবুল হয়ে যায় এবং গুনাহ মাফ চাইলে তা মাফ করে দেওয়া হয়।’ (ইবনে মাজাহ: ২৮৯২)। হজের মাধ্যমে হাজিরা যে শুভ্র-সফেদ আত্মার অধিকারী হন, তা যেন গুনাহের কালো দাগে জর্জরিত না হয়ে পড়ে, সেজন্য হাজিদের হতে হবে আত্মার সাধক। পবিত্রতার সাধনায় মগ্ন থাকতে হবে সর্বক্ষণ। এমন চরিত্রের অধিকারী হতে হবে তাদের দেখলেই যেন আল্লাহভোলাদের আল্লাহকে স্মরণ হয়ে যায়। হজ থেকে ফিরে এসে আগের মতো জীবনযাপন করা যাবে না। যে পরিমাণ আমলের অভ্যস্ততা হজের আগে ছিল, হজের পরে তার পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিতে হবে।

গুনাহমুক্ত জীবনযাপন: হাজিরা সর্বক্ষণ গুনাহ থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করবেন। কেননা গুনাহের প্রতি বেপরোয়া মনোভাব মানুষকে কুফরির স্তরে উপনীত করে। তাই গুনাহের ব্যাপারে সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের সংশোধনের দায়িত্ব তোমাদের নিজেদেরই ওপর। তোমরা যদি সঠিক পথ অবলম্বন করো, তাহলে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহর কাছেই তোমাদের সবার ফিরে আসা। এরপর তিনি সে সম্পর্কে জানাবেন যা তোমরা করতে।’ (সুরা মায়েদা: ১০৫)

নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায়: ‘নফসে আম্মারা’ মানুষকে গুনাহের দিকে ধাবিত করে। ফলে মানুষ কামনা-বাসনার বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন পাপে লিপ্ত হয়। আর সেই নফসে আম্মারার প্রতিবন্ধক হলো কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদের নামাজ। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদ) তোমাদের ওপর বিধিবদ্ধ করে নাও। কেননা তা হচ্ছে তোমাদের নেক লোকদের অভ্যাস ও ঐতিহ্য, তোমাদের প্রভুর নৈকট্য লাভের উপায়, গুনাহগুলোর কাফফারা এবং নফসের প্রতিবন্ধক।’ (তিরমিজি: ৩০৮০)

সত্যবাদিতা অবলম্বন করা: সত্যবাদিতা মুমিন জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সত্যবাদিতা, মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, মাগফিরাত ও জান্নাতের পথে পরিচালিত করে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সত্যবাদিতা পুণ্য ও নেক আমলের পথ দেখায় আর নেক আমল জান্নাতের পথ দেখায়। সত্য বলতে বলতে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ‘সিদ্দিক’ হিসেবে পরিগণিত হয়। আর মিথ্যা পাপের পথ দেখায়, পাপ পাপীকে জাহান্নামে নিয়ে ফেলে এবং মিথ্যা বলতে বলতে ব্যক্তি আল্লাহর খাতায় ‘কাজজাব’ বলে চিহ্নিত হয়ে যায়।’ (বোখারি: ৬০৯৪; মুসলিম: ১০৩)

গুনাহ থেকে বাঁচতে আল্লাহর আশ্রয়: আল্লাহতায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া শুধু সাধনার মাধ্যমেই কারও পক্ষে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এজন্য চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রার্থনাও করতে হবে। রাসুল (সা.) গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার দোয়া শিখিয়েছেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাওরি বাদাল কাওফুর, অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে ভালোর পর মন্দে পতিত হওয়া থেকে পানাহ চাই।’ (তিরমিজি: ৩৪৩৯; ইবনে মাজাহ: ৩৮৮৮)

গুনাহ হয়ে গেলে অনতিবিলম্বে তওবা করা: অভিশপ্ত শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে যদিও কখনো কেউ গুনাহের কাজে জড়িয়ে যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে নেওয়া উচিত। কেননা তওবা হচ্ছে গুনাহ মাফের একমাত্র মহৌষধ। এজন্যই আল্লাহতায়ালা মুমিনদের তওবা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আছে তওবা করো, নিশ্চয়ই তোমরা সফলকাম হবে।’ (সুরা নুর: ৩১)। এসব আমল ছাড়াও আরও কিছু আমল আছে, যার মাধ্যমে হজের সওয়াব লাভ হয়। যারা হজ পালন করেছেন, তারাও এসব আমল ধরে রাখবেন; যারা হজে যেতে পারেননি, তারাও এসব আমলের মাধ্যমে হজের সওয়াব লাভ করবেন।

পিতা-মাতার খেদমত: সন্তানের ওপর পিতা-মাতার হক সবচেয়ে বেশি। হাদিস শরিফে পিতার সন্তুষ্টিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টিকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি বলা হয়েছে (জামে তিরমিজি, হাদিস: ১৮৯৯)। অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত।’ (মুখতাসারুল মাকাসেদ, হাদিস: ৩৪৮)। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে পিতা-মাতার খেদমত করে হজ ও ওমরাহর সওয়াব পাওয়া যায়। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আমি জিহাদের প্রতি খুবই আগ্রহী, কিন্তু আমার জিহাদ করার সামর্থ্য নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার পিতা-মাতার কেউ কি জীবিত আছেন? সে বলল, আমার মাতা জীবিত আছেন। তখন তিনি বললেন, তাহলে মাতার সেবা করার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক স্থাপন করো। এটা যদি করতে পারো এবং তোমার মা যদি তোমার ওপর সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে হজ, ওমরাহ ও জিহাদ করার সওয়াব পেয়ে যাবে।’ (মুজামুল আওসাত, হাদিস: ২৯১৫)

দ্বীন শিখতে মসজিদে গমন: ফরজ পরিমাণ দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক। এই দ্বীনি জ্ঞান শেখা বা শেখানোর জন্য মসজিদে গমন করলে হজের সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়। হজরত আবু উমামা বাহিলি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ভালো কথা শেখা বা শেখানোর জন্য মসজিদে যাবে, সে পরিপূর্ণ হজ আদায়কারীর মতো সওয়াব পাবে।’ (মুজামে কাবির, হাদিস: ৭৪৭৩)।

ইশরাকের নামাজ: ফজরের ওয়াক্ত শেষে সূর্য উদিত হওয়ার পর দুই রাকাত নফলকে ইশরাকের নামাজ বলা হয়। এ নামাজ আদায় করলে হজের সওয়াব পাওয়া যায়। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, অতঃপর সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর জিকিরে লিপ্ত থাকে, এরপর দুই রাকাত নামাজ আদায় করে, সে একটি হজ ও ওমরাহর সওয়াব পাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, পূর্ণ, পূর্ণ, পূর্ণ হজ ও ওমরাহর সওয়াব পাবে।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস: ৫৮৬)

ওজু করে মসজিদে গমন: দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মুসলিম নারী-পুরুষের ওপর ফরজ। পুরুষের জন্য মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করা উত্তম। ফরজ নামাজের উদ্দেশে ওজু করে মসজিদে গেলে হজের সওয়াব পাওয়া যায়। হজরত আবু উমামা বাহিলি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ওজু করে ফরজ নামাজের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হবে, সে হজের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৫৫৮)

মানুষের সহযোগিতা: মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, বিপদাপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যতক্ষণ কেউ অন্য মুসলমান ভাইকে সহযোগিতা করবে, আল্লাহতায়ালাও তাকে সাহায্য করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৯৯)। কোনো মুসলমানকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে হজের সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়। বিশিষ্ট তাবেয়ি হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘কোনো মুসলমান ভাইয়ের সহযোগিতায় এগিয়ে যাওয়া একের পর এক হজ করা থেকেও উত্তম।’ (লতাইফুল মাআরিফ: ২৫০)।

সবিশেষ মহামহিম আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা, হজের শেষেও যেন হাজিদের নেক আমলের ধারা অব্যাহত থাকে। তাদের প্রতিটি কাজই যেন হয় প্রভুপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। হজের মাধ্যমে প্রভুপ্রেমের যে গভীর ভালোবাসা তাদের গহিনে জন্ম হয়েছে, সেই ভালোবাসাকে যেন গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রেখে এবং বেশি বেশি নেক আমল করার মাধ্যমে আমৃত্যু বুকে ধারণ করে রাখতে পারেন। আল্লাহ সবাইকে তওফিক দান করুন।

লেখক: ইমাম ও খতিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শান্তির ডাকে যুদ্ধ আরও জটিল রূপ নিচ্ছে না তো?

ট্রাম্পের হম্বিতম্বির নেপথ্যে কী

নতুন দায়িত্ব নেওয়া ইরানি ড্রোন কমান্ডারকেও মেরে ফেলল ইসরায়েল

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মতুয়া সম্প্রদায়ের পাশে পূজা উদযাপন পরিষদ

ময়মনসিংহে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১১

থানায় রক্ষিত বাক্স ভেঙে বের করা হয় এইচএসসির প্রশ্নপত্র

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত / ৫৭ দেশের সহস্রাধিক মুসলিম নেতা বৈঠকে বসছেন আজ

নতুনবাজার অবরোধ করলেন ইউআইইউর শিক্ষার্থীরা

ছাত্রাবাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

ইরানের ভূকম্পন কি গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা?

১০

দিনে কতবার প্রস্রাব হওয়া স্বাভাবিক? কিডনি সমস্যার লক্ষণ নয়তো

১১

ইরানের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের পরস্পরবিরোধী বার্তা

১২

‘চা-নাশতার’ খরচে মিলছে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি

১৩

তুরস্কে গেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১৪

‘পুরো বিশ্বের সামনে ইসরায়েলকে নত করাবে ইরানের বাহিনী’

১৫

ইরান বলছে কূটনীতির দরজা খোলা, ইসরায়েল জানাল হামলা চলবে

১৬

ঢাকায় বৃষ্টি হলে বাড়বে তাপমাত্রা

১৭

সেপটিক ট্যাংক থেকে দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধার 

১৮

আগে বিচার ও সংস্কার পরে নির্বাচন : মুজিবুর রহমান

১৯

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

২০
X