কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বর্ষবিদায়ে মুমিনের সময়ের হিসাব

মাওলানা আবদুল হাকিম
বর্ষবিদায়ে মুমিনের সময়ের হিসাব

দিন-মাস পেরিয়ে বছরের শেষ সময়ে উপনীত আমরা। সময় আমাদের জীবনেরই অংশ। তাই সময়ের হিসাব রাখা মুমিনের কর্তব্য। ‘সময়’ শব্দটি তিন অক্ষরের হলেও এর ব্যাপ্তিকাল অনেক বড়। সৌরবছরে ৩৬৫ দিন আর চন্দ্রবছরে ৩৫৪ দিন। ঘণ্টার হিসাবে ২৪ ঘণ্টা এবং মিনিটের হিসাবের দিক দিয়ে ১ হাজার ৪৪০ মিনিট। এ সময় হতে ১ ঘণ্টা বা ১ মিনিট চলে যাওয়া মানে প্রকৃতপক্ষে জীবনের একটা মূল্যবান অংশ কমে যাওয়া। এ কারণে সময়ের যথাযথ ব্যবহার একান্ত অপরিহার্য। সময়ের সমষ্টিই জীবন। মানুষ তার দুনিয়ার জীবন কীভাবে অতিবাহিত করেছে, আখিরাতে সে হিসাব প্রদান করতে হবে। সময় একটি মানদণ্ড, যেখানে ঘটনাগুলো অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের পানে বা অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতে সন্নিবেশ করা যায়। কোরআনে সময় অপচয় ও অনর্থক কাজে ব্যয় করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সময়ের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য আল্লাহতায়ালা কোরআনে অনেক প্রতিশব্দ ব্যবহার করে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মহামহিম আল্লাহ সূর্যকে তৈরি করেছেন বিচ্ছুরিত আলোর উৎসরূপে আর চাঁদকে করেছেন জ্যোতির্ময় (সে আলোর প্রতিফলন)। তিনি চাঁদের কক্ষপথ ও কলাকাল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর, দিন ও সময়ের হিসাব নির্ণয় করতে পারো। আল্লাহ এসব অনর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানীদের জন্য তিনি তার বাণী বিশদভাবে বয়ান করেন।’ (সুরা ইউনুস: ৫)।

সময় মহান আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। এটি ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না। তবে এর বাস্তবতাও অস্বীকার করা যায় না। কারণ, সৃষ্টিজগৎ সময়ের ভেতর দিয়েই অতিক্রম করে চলে। সময়ের আদি-অন্ত সম্পর্কেও মানুষ পরিষ্কাররূপে কিছু বলতে পারে না, এর প্রকৃত জ্ঞান রয়েছে শুধু মহান আল্লাহর। মহান আল্লাহ নিজের অস্তিত্বের একাংশকেই সময় বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং সময়ের শপথ করেছেন। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন স্থানে এর যথার্থ মূল্যায়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামে এ কারণে সময় ব্যবস্থাপনাকে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মানুষকে সময়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝানোর জন্য কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ সময়ের কসম করেছেন। যেমন—‘শপথ রজনির, যখন তা আচ্ছন্ন হয়ে যায়’, ‘শপথ দিনের, যখন তারা আলোকিত হয়’, ‘শপথ ফজরের, শপথ দশটি রাতের’, ‘সকালের উজ্জ্বল আলোর শপথ’, ‘রাতের শপথ যখন তা হয় শান্ত নিঝুম’; মহান আল্লাহ কোনো তুচ্ছ বিষয়কে নিয়ে শপথ করেন না। আর তার সময় নিয়ে কসম করায় সময়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। মহানবী (সা.) সময়কে গুরুত্ব দিতে এবং একে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে অনেক তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, প্রতিটি মানুষকে কেয়ামতের দিন সময়ের হিসাব দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, কেয়ামতের দিন কোনো মানুষ চারটি প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত সামনে যেতে পারবে না—১. সে তার জীবনকালে কোন কাজে ব্যয় করেছে; ২. তার যৌবনকাল কোথায় ক্ষয় করেছে; ৩. তার সম্পদ কোথা থেকে আয় করে কোথায় ব্যয় করেছে এবং ৪. তার অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী সে আমল করেছে কি না (তিরমিজি: ২৪১৬)। এ চার বিষয়ই সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)কে প্রশ্ন করা হলো, ‘সৌভাগ্যবান কারা?’ তিনি বললেন, ‘সৌভাগ্যবান তারা, যারা দীর্ঘায়ু লাভ করেছে এবং তা নেক আমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করেছে।’ পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, ‘দুর্ভাগা কারা?’ তিনি বললেন, ‘দুর্ভাগা তারা, যারা দীর্ঘায়ু পেয়েছে এবং তা বদ আমলে কাটিয়েছে বা আমলবিহীন অতিবাহিত করেছে।’ (তিরমিজি: ২৩২৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৭৭৩৪)।

পরকালে মানুষ যে বিষয়ে সবচেয়ে অনুতপ্ত হবে তা হলো, অবসর সময়ের সদ্ব্যবহার না করা। সময় কাজে লাগিয়ে নেক আমল করলে বান্দার অবস্থার উন্নয়ন হবে, বদ আমল করলে তার অবনতি হবে। আমল ছাড়া সময় পার করলে তাও তার জন্য প্রকারান্তরে ক্ষতি হিসেবেই গণ্য হবে। কারণ, মানুষের আয়ুষ্কাল প্রবহমান নদীর মতো। তা যদি সৎকর্মে ব্যয় হয়, তবে নেক আমল হিসেবে গণ্য হবে আর যদি নেক আমলবিহীন চলে যায়, তা বদ আমল হিসেবেই পরিগণিত হবে। যেহেতু নিষ্ক্রিয়তা বা অকর্মণ্যতাও একটি ক্রিয়া। নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসকে তার বিপরীত পাঁচটি জিনিসের পূর্বে মূল্যায়ন করো ও তার সদ্ব্যবহার করো—১. তোমার যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে; ২. সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে; ৩. সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের পূর্বে; ৪. অবসরকে ব্যস্ততার পূর্বে; ৫. জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে।’ (বায়হাকি, শোয়াবুল ইমান: ১০২৪৮; আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব: ৪/২০৩)।

ইসলামের আলোকে সময়ের ধারণা দিলে প্রথমেই চোখে পড়ে মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবনযাত্রা। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সময় হয়তো সকাল-দুপুর-বিকেল অথবা দিন-মাস-বছরের হিসাব; কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিতে সময় হচ্ছে হায়াতের প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি আমলের সুযোগ, যা একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না। আল্লাহতায়ালা কোরআনে বিভিন্নভাবে সময়কে ব্যবহার করেছেন মানুষের অন্তর জাগ্রত করার জন্য—কখনো সময়ের কসম করে, কখনো সময়ের পরিবর্তনশীলতা দেখিয়ে, কখনো দিনের-রাতের চক্র ব্যাখ্যা করে আর কখনো মানুষের হায়াতের ক্ষুদ্রতা স্মরণ করিয়ে। বিশেষত সুরা আল-আসরের সূচনা—‘ওয়াল-আসর’ অর্থাৎ, সময়ের শপথ ইসলামী সভ্যতার জ্ঞানতত্ত্বে সময়ের অবস্থানকে মহামহিমান্বিত করে তুলেছে। মহান আল্লাহ কোনো সাধারণ বিষয়ের শপথ করেন না; তিনি শপথ করেন শুধু সেই বিষয়ের প্রতি, যা মানুষের জীবনে সীমাহীন গুরুত্ব বহন করে। এখানে সময়কে শপথ করা মানে মানুষের সামনে সময়কে এমন এক আয়না হিসেবে তুলে ধরা, যেখানে সে নিজেকে, নিজের আমলকে, নিজের লক্ষ্যকে এবং নিজের পরিণতি স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। তাফসিরকারীরা বলেছেন, এখানে ‘আসর’ শুধু বিকেলের সময় নয়; বরং মানবজীবনের পুরো সময়কাল, যুগের পরিক্রমা, মানুষের জীবনচক্র—সবকিছুই এর আওতায় আসে। ইসলামে সময়ের গুরুত্ব শুধু আধ্যাত্মিক কোনো বক্তব্য নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যেমন—আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষ ক্ষতির মধ্যে থাকেই, যদি না সে ইমান আনে, সৎকর্ম করে, সত্যের উপদেশ দেয় এবং ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ অর্থাৎ, সময়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ঠিকমতো গড়া না হলে সে স্বভাবতই ক্ষতিগ্রস্ত। সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে মানুষ ইহকালে ব্যর্থ আর পরকালে শাস্তিপ্রাপ্ত।

মুমিনের জীবনে সময় একেকটি রত্নের মতো। মুমিনের প্রতিটি সকাল তার কাছে নতুন দায়িত্ব, নতুন আমল, নতুন সুযোগ। তাই নবীজি (সা.) সাবধান করে বলেছেন, ‘দুটি নিয়ামত রয়েছে, অনেক মানুষ যার মূল্যায়ন করে না—স্বাস্থ্য এবং অবসরের সময়।’ এখানে সময়কে দায়বদ্ধতার এক বিশেষ নিয়ামত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ মানুষের হাতে শুধু সময়ই দিয়েছেন আর কিছুই নয়। শরীর, সম্পদ, জ্ঞান—সবই সময়ের ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। মানুষের জীবন, মৃত্যু এবং সময়ের সম্পর্কও ইসলামে অত্যন্ত গভীর। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে পরিক্রমা, তা মূলত সময়ের মাধ্যমে নির্ধারিত। আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুস্বাদ গ্রহণ করবে।’ এ মৃত্যু সময়েরই ঘোষণা। মানুষের হায়াত নির্দিষ্ট; তার সময়ের পাতায় প্রতিটি মুহূর্ত লেখা। তাই মৃত্যু ও সময়ের সামঞ্জস্যতা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় সময় নষ্ট করার মতো কোনো সুযোগ ইসলামে অনুমোদিত নয়। প্রতিটি নিঃশ্বাসই একটি বিনিয়োগ, প্রতিটি দিনই একটি পরীক্ষা এবং প্রতিটি রাতই হিসাব-নিকাশের জায়গা।

সময় এমন একটি সম্পদ, যা মানুষের কবর পর্যন্ত তার সঙ্গী। মৃত্যু এসে শেষ সময়ের ঘোষণা দেয়, আর পরকাল শুরু হয় সময়ের হিসাব থেকে। তাই সময়ের সঠিক ব্যবহারই মুমিনের পরিপূর্ণ সফলতা। সুরা আসরের চূড়ান্ত বার্তা তাই—মানুষ ক্ষতির মধ্যে, যদি না সে সময়কে ইমান, আমল, সত্য ও ধৈর্যের পথে ব্যবহার করে। এ পৃথিবীতে সময়ই মানুষের একমাত্র মূলধন। এটি হারিয়ে গেলে সব হারায়। আর এ সময়ই যদি আল্লাহর পথে নিবেদিত হয়, তবে মানুষের জীবন হয় নান্দনিক, শান্তিপূর্ণ, সফল এবং চিরস্থায়ী মুক্তির পথপ্রদর্শক। ইসলাম সময়কে শুধু বলে দেয়নি; সময়কে মানুষের আত্মার আলো করে তুলেছে। তাই সময়ের প্রকৃত মূল্য শেখা, সময়কে কাজে লাগানো এবং সময়ের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়াই আজকের মুসলমানের জন্য সবচেয়ে জরুরি দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদের সময়কে হেদায়েতের পথে ব্যবহার করার তওফিক দান করুন।

লেখক: ইমাম ও খতিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজ ৩০০ ফিটের সব বর্জ্য অপসারণ করবে বিএনপি

শীতে কাঁপছে চুয়াডাঙ্গা, তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রির ঘরে

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন

‘পাসপোর্ট-টিকিট লুট হয়ে গেল, এখন বিদেশে ফিরতে পারছি না’

ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় তদন্তে নেমেছে তুরস্ক ও লিবিয়া

কুয়াশার চাদরে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা, কমেছে তাপমাত্রা

আলোচনা না যুদ্ধবিরতি? কোন পথে যাচ্ছে সুদান

আজ যেসব কর্মসূচি তারেক রহমানের

ঢাবি বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা আজ

সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর শরীয়তপুর-চাঁদপুর রুটে ফেরি চলাচল শুরু

১০

ভুয়া সনদ বানিয়ে কোটিপতি বনে যান শাওন

১১

আজ সারা দিন গ্যাসের চাপ কম থাকবে যেসব এলাকায়

১২

শুক্রবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৩

২৬ ডিসেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৪

তারেক রহমানের আগমনকে ঘিরে প্রস্তুত জাতীয় স্মৃতিসৌধ

১৫

শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ

১৬

যেভাবে ভোট দিতে পারবেন কারাবন্দিরা

১৭

রাজবাড়ীতে গণপিটুনিতে একজন নিহতের ঘটনায় যা জানাল সরকার

১৮

তারেক রহমানের আগামী ২ দিন কোথায় কোন কর্মসূচি

১৯

পাত্রী দেখে ফেরার পথে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্মী গ্রেপ্তার

২০
X