সরকারি চাকরিতে বেতন কাঠামোর নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে (আগের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির) মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত বহালে উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতিবাদে এবং ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে লাগাতার কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার গণপদযাত্রা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। এর আগে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। হামলা-মামলা-গ্রেপ্তারেও আন্দোলন থামেনি। ওই অবস্থায় ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বাতিল হবে বলে জানান। তবে তা কার্যকর না হওয়ায় আন্দোলন অব্যাহত থাকে। এরপর ৪ অক্টোবর নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বাতিল হওয়ার পর গত ৫ জুন সেই কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। আন্দোলনকারীদের মতে, এর মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ এ কোটা পদ্ধতি সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতি একটি অবিচার। তারা চান অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করা হোক।
আমরা মনে করি, আন্দোলনকারীদের দাবি অযৌক্তিক নয় মোটেই। সেইসঙ্গে এ কথাও সত্যি যে, সমাজের পিছিয়ে পড়া তথা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার জন্য সীমিত আকারে কোটাপ্রথা চালুর যুক্তি অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার মাধ্যমে তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। শুধু আমাদের দেশে নয়, অনেক দেশেই এ নিয়ম চালু আছে। আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সুবিধাবঞ্চিত। এসব জনগোষ্ঠীর জন্য সীমিত আকারে কোটা থাকতে হবে। আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য কোটা বরাদ্দ আছে। এটাও যৌক্তিক। এগুলো বাতিল করার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলো—সমগ্র কোটা পদ্ধতিকে সংস্কার করা। অর্থাৎ সীমিত পরিমাণ কোটা রাখতে হবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার জন্য। তা ছাড়া এমন একটি বিধান রাখতে হবে যদি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কোটা অপূর্ণ থেকে যায়, তাহলে সে চাকরিগুলো মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পূরণ করা। এভাবে একটি যৌক্তিক কোটা পদ্ধতি চালু হলে অসন্তোষ দূর হবে বলে আশা করা যায়।
আরেকটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন এবং তা হলো—দেশে বর্তমানে ভয়াবহ বেকার সমস্যা। তীব্র বেকার সমস্যার কারণে কোটা সংস্কারের জোর দাবি উঠেছে। বেকার সমস্যা যতই গভীর হবে, কর্মহীন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাবে, সমাজ ততই অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে, সংকট হবে ঘনীভূত। আজ যদি শিক্ষিত যুবাদের পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়তো কোটা সংস্কার আন্দোলন এতটা বেগবান হতো না। একজন মেধাবী তরুণ যদি শুধু অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতির কারণে চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন, তাহলে স্বভাবতই তিনি হতাশ হবেন, তার মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। শিক্ষার্থীরা দেখেছেন, অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতির কারণে বহু মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরিপ্রার্থী তরুণ নিয়োগ পাচ্ছেন না। প্রচলিত কোটা পদ্ধতি তাই তাদের বিক্ষুব্ধ করেছে। এজন্যই তারা কোটাসংস্কার আন্দোলনে নেমেছেন। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে নয়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার জন্য তারা আন্দোলন করছেন না। তারা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজপথে নামেননি। তাই তাদের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের আমলে নেওয়া প্রয়োজন। ইস্যুটি ঝুলিয়ে রাখলে নানামুখী সংকট বাড়বে, বৈ কমবে না।