প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ উপার্জন করা আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদিত কাজ। একই সঙ্গে সম্পদ উপার্জনের উপায়ও হালাল ও বৈধ হওয়া আল্লাহর নির্দেশ। হালাল ও বৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন করলে আল্লাহ দুনিয়ায় বরকত দান করেন; পরকালে পুরস্কৃত করবেন। আর হারাম ও অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত ধ্বংসের কারণ হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে মুমিনরা, আহার করো আমি তোমাদের যে হালাল রিজিক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর করো, যদি তোমরা তারই ইবাদত করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৭২)। এই আয়াতে মহান আল্লাহ আমাদের জন্য হালাল খাবার, হালাল উপার্জন ফরজ করেছেন। এখানে অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জনের ক্ষতি ও শাস্তি নিয়ে আলোচনা করা হলো।
আল্লাহর অসন্তুষ্টি: পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর সঙ্গে করা প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য খরিদ করে, আখেরাতে তাদের কোনো অংশ নেই। আর আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না কেয়ামতের দিন। আর তাদের পরিশুদ্ধও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৭)
রাসুল (সা.)-এর অভিশাপ: যারা সুদভিত্তিক লেনদেনে লিপ্ত, রাসুল (সা.) তাদের অভিশাপ দিয়েছেন। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) সুদখোর, সুদদাতা, সুদের লেখক ও তার সাক্ষীদ্বয়ের ওপর অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, এরা সবাই সমান অপরাধী। (মুসলিম, হাদিস: ৩৯৮৫)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ঘুষদাতা ও গ্রহীতার ওপর আল্লাহর অভিশাপ। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৩১৩)
দোয়া কবুল হয় না: যারা হারাম পন্থায় উপার্জন করে, মহান আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত ও সারা শরীর ধুলিমলিন। সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এমতাবস্থায় তার দোয়া কীভাবে কবুল হতে পারে? (তিরমিজি, হাদিস: ২৯৮৯)
বরকত কমে যায়: মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন আর দান-সদকা বাড়িয়ে দেন।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত : ২৭৬)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদরা বলেন, ‘যে সম্পদের সঙ্গে সুদ মিশ্রিত হয়ে যায়, বেশিরভাগ সময় সেগুলো ধ্বংস হয়, অধিকন্তু আগে যা ছিল, তাও সঙ্গে নিয়ে যায়। সুদ ও জুয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, অজস্র পুঁজির মালিক কোটিপতি দেখতে দেখতে দেউলিয়া ও ফকিরে পরিণত হয়। এভাবে হারাম উপার্জন মানুষের রিজিক কমিয়ে দেয়।
দান-সদকা কবুল হয় না: অনেকে মনে করে, হারাম পথে উপার্জন করে সেখান থেকে কিছু সদকা করে দিলে হয়তো শাস্তি কিছুটা হালকা হবে। অথবা আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু ব্যাপারটা এরকম নয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা পবিত্রতা ছাড়া কোনো নামাজ কবুল করেন না এবং অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের সদকা গ্রহণ করেন না।’ (নাসায়ি, হাদিস: ১৩৯)
চূড়ান্ত ক্ষতি ও ধ্বংস: হারাম উপার্জন মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। মহান আল্লাহ হারাম উপার্জনকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও। অতঃপর যদি তোমরা না করো, তাহলে আল্লাহ ও তার রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৮-২৭৯)
কবরের শাস্তি: হারাম উপার্জন মানুষকে যেভাবে দুনিয়ায় শাস্তি দেয়, তেমনি কবরেও তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি। হজরত সামুরাহ ইবনে জুনদুব (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি, দুই ব্যক্তি আমার কাছে আগমন করে আমাকে এক পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে এক রক্তের নদীর কাছে পৌঁছলাম। নদীর মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং আরেক ব্যক্তি নদীর তীরে, তার সামনে পাথর পড়ে রয়েছে। নদীর মাঝখানের লোকটি যখন বের হয়ে আসতে চায় তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথরখণ্ড নিক্ষেপ করে তাকে সস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে যতবার সে বেরিয়ে আসতে চায় ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে আর সে সস্থানে ফিরে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ব্যক্তি কে? সে বলল, যাকে আপনি (রক্তের) নদীতে দেখেছেন, সে হলো সুদখোর। (বোখারি, হাদিস: ২০৮৫)
আখেরাতের শাস্তি: আখেরাতেও অবৈধ উপার্জনকারী কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। হজরত খাওলা আনসারিয়া (রা.) বলেন, ‘আমি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কিছু লোক আল্লাহর দেওয়া সম্পদ অন্যায়ভাবে ব্যয় করে, কেয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত।’ (বোখারি, হাদিস: ৩১১৮)।
অতএব আমাদের সবার উচিত, হারাম উপার্জন থেকে দূরে থাকা। কারণ এর দ্বারা সাময়িক সচ্ছলতা অর্জিত হলেও এর ক্ষতি ও ধ্বংস চিরস্থায়ী। এর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আল্লাহতায়ালা সবাইকে বোঝার ও আমল করার তওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব