একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনুকরণীয় শিক্ষক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু একজন শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব এবং জীবনাচরণ যখন একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন, ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন এমনকি কর্মপরবর্তী জীবনের ভাবনাকেও প্রভাবিত করতে পারে, সেখানেই বোধহয় একজন শিক্ষকের প্রকৃত সার্থকতা। হ্যাঁ, আমার ক্ষেত্রে সেই শিক্ষক হলেন আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ড. তাসনিম সিদ্দিকী। ম্যাডামের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিরতিহীনভাবে ৩২ বছরের। ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিলাম। সেই সুবাদে ম্যাডামকে প্রথম দেখি সম্ভবত ১৯৯২ সালের কোনো একদিন কলাভবনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের করিডোর দিয়ে চুলের পেছনে লাল রঙের বো ক্লিপ এবং থ্রি-পিসের এক সাইডে ওড়না দিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছুটা দ্রুতগতিতে হেঁটে যেতে। ম্যাডামের চলার মধ্যে কেমনভাবে যেন প্রতিফলিত হচ্ছিল একটা আত্মপ্রত্যয়ী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভঙ্গি। এরপর থেকে নিয়মিতই দেখতাম আর ম্যাডামের সঙ্গে আমাদের ক্লাস শুরু হয় ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালে। ম্যাডাম যখন ক্লাস নিতেন কিংবা বিভাগের করিডোর দিয়ে হেঁটে ক্লাস নিতে যেতেন, খেয়াল করতাম ম্যাডামের ব্যক্তিত্ব আমাদের দুষ্টু বন্ধুদের মুখও যেন আটকে দিত, যারা সাজপোশাকে একটু ব্যতিক্রম দেখলেই যে কাউকে টিজ করতে ছাড়ত না। উপরন্তু তাদের চোখেমুখে প্রস্ফুটিত হতো শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টি। যতদূর মনে পড়ছে, ম্যাডাম আমাদের Qualitative & Quantitative Approach to Study Politics, Mordenization of Political Development and Social Change—এ কোর্সগুলো পড়াতেন। আমার সুস্পষ্টভাবেই মনে পড়ে যে, অনেক কঠিন বিষয়ও ম্যাডাম অনেক বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে ক্লাসের শেষের দিকে পুরো বিষয়বস্তু গুছিয়ে এনে ছোট্ট করে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিতেন। তেমনি আমাদের কাছ থেকে পড়া বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। যেখানে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। এককথায় শিক্ষার মান বজায় রাখতে তিনি ছিলেন আপসহীন। ম্যাডামের পাঠদান কৌশল এবং দক্ষতা সম্পর্কে আমার এটা সেই সময়ের সুস্পষ্ট অনুভূতি।
এসব অনুভূতি নিয়েই ১৯৯৯ সালে ম্যাডামকে আমি পাই আমার এমফিলের সুপারভাইজার হিসেবে। শুরু হয় আমার মেন্টর হিসেবে ম্যাডামকে জানার ও বোঝার। আমার গবেষণাসংক্রান্ত হাতেখড়ি ম্যাডামের মাধ্যমেই। গবেষণার ছোটখাটো প্রতিটি বিষয় ম্যাডামের শতব্যস্ততার মধ্যেও অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতেন। পরে ২০০১ সালে আমি এএসপি হিসেবে পুলিশে যোগদান করায় সঠিকভাবে পড়ালেখায় সময় দিতে পারতাম না। ম্যাডামের উৎসাহ ও সহযোগিতায় ২০০৫ সালে আমি এমফিল সম্পন্ন করি। ২০০৬ সালে Chevening Scholarship নিয়ে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করতে যাই। সেখানে থাকাকালে আমার Dissertation লেখার সময়ও ম্যাডামের পরামর্শ নিতাম। এমবিএ সম্পন্ন করে দেশে ফিরে ২০০৮ সালে ম্যাডামের তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হই। যেহেতু আমি চাকরির কারণে খুব একটা সময় পাই না, তাই ম্যাডাম পরামর্শ দিলেন আমার এমবিএর Dissertation Topic-এর সঙ্গে মিল রেখে পিএইচডির Research Topic নিতে। সে অনুযায়ী পিএইচডি টপিক নির্ধারিত হলো, শুরু হলো আমার গবেষণা কাজ। যার মাধ্যমে ম্যাডামের সঙ্গে যেন আমার অনন্তকালের সম্পর্কের একটি সেতুবন্ধ তৈরি হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ঠিকই কিন্তু মন আমার টানে বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার। বিষয়টি ম্যাডামকে জানাই এবং আমার পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হওয়া সত্ত্বেও ম্যাডাম বলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখো এবং আমাকে কী করতে হবে বলো।’ আমি বললাম, ম্যাডাম আপনাকে Referee হিসেবে দিতে চাই। ম্যাডাম বললেন, ‘অবশ্যই, কী লিখতে হবে লিখে নিয়ে আসো, স্বাক্ষর করে দিচ্ছি।’ সেদিন ম্যাডামের সে কথার মাধ্যমে তিনি আমার অন্তরে ‘একজন উদার এবং উন্নতমনের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত’ হলেন। এভাবেই এদিকে একটু একটু কাজ করি, সময় বাড়াই, চাকরি করি আর ফাঁকে ফাঁকে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করি। কিন্তু ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব তিমুর এবং ইতালিতে দুই দফায় চার বছর জাতিসংঘে চাকরি করার কারণে পড়ালেখাসংক্রান্ত কাজে মনোনিবেশ করা খুব একটা সম্ভব হয়নি। অতঃপর ইতালি থেকে দেশে ফিরে চাঁদপুর জেলার এসপি থাকাবস্থায় ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডির অফার পেয়েও যাওয়া হয়নি। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় বাড়ানোর খুব বেশি সুযোগ নেই। জেলার এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিদেশে পিএইচডি করার চিন্তা বাদ দিয়ে অবশেষে মনস্থির করে ম্যাডামের উদারতা এবং আমাকে দেওয়া সাহস ও উৎসাহের কারণেই গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করি। এর ধারাবাহিকতায় ম্যাডামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ মোতাবেক আমি আমার গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করে ২০২১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি।
আর এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পড়ালেখার পাশাপাশি জীবনের চ্যালেঞ্জ এবং জীবনাচরণ সংক্রান্ত অনেক কিছুই ম্যাডামের সঙ্গে শেয়ার করা হয়। যার মাধ্যমে ম্যাডাম শিক্ষক থেকে মেন্টর এবং মেন্টর থেকে আমার মনে একজন বন্ধুতে পরিণত হয়ে যান। ম্যাডামের সঙ্গে আমার বিরতিহীন ৩২ বছরের স্মৃতি তিন মিনিটে সীমাবদ্ধ করা কঠিন বললে ভুল হবে, আসলেই অসম্ভব। একটি উদাহরণ—পড়ানোর ফাঁকে কোনো কিছুই ম্যাডামের দৃষ্টি এড়াত না। একদিন আমি আর আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে কাছের বান্ধবী (স্বপ্না) টিউটোরিয়াল পরীক্ষা দিচ্ছি দেখাদেখি করে পাশাপাশি বসে। ম্যাডাম আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে বললেন, ‘দুই বন্ধু সবসময় একসঙ্গে কিন্তু পরীক্ষার সময় তো একসঙ্গে বসা যাবে না।’ ম্যাডামের সেই কথার মাধ্যমে আমার অনুভূত হয়েছিল, একদিকে স্নেহ অন্যদিকে শাসন আর সবচেয়ে আকৃষ্ট হয়েছিলাম যখন ম্যাডাম আমাদের দুই বান্ধবী না বলে দুই বন্ধু বলে সম্বোধন করলেন। যার মাধ্যমে আমার মনে হয়েছিল, আমাদের সমাজসৃষ্ট সীমাবদ্ধ চিন্তাচেতনার ঊর্ধ্বে ম্যাডামের অবস্থান।
সর্বোপরি, ম্যাডামের মেধা, পাঠদানের দক্ষতা, কথা বলার ধরন, চলার ভঙ্গি এবং মনের বিশালতা আর ম্যাডাম যেভাবে ইংরেজিতে কথা বলেন—সবকিছুই আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করে। আর সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হই তার ব্যক্তিগত পরিপাটি সংসার আর যেভাবে ম্যাডাম তার স্বামী, সন্তানদের এবং নাতি-নাতনিদের সময় দেন সেটা দেখে। এ দেখাই আমার ব্যক্তিজীবন, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন এমনকি কর্মপরবর্তী জীবনের ভাবনাকেও প্রভাবিত করে। এখানেই ম্যাডামের সার্থকতা। এভাবেই ড. তাসনিম সিদ্দিকী একজন সফল-সার্থক শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থী মনে সুপ্রতিষ্ঠিত।
লেখক: অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ