মুসলমানদের প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মোট ১৭ রাকাত ফরজ ও তিন রাকাত বিতর এবং ১২ রাকাত সুন্নত নামাজ পড়তে হয়। এ ছাড়া আরও কিছু নির্ধারিত-অনির্ধারিত নফল নামাজ রয়েছে। যেমন—তাহাজ্জুদ নামাজ, ইশরাক নামাজ, চাশতের নামাজ, আওয়াবিন নামাজ এবং সাধারণ নফল নামাজ। মোটকথা ফরজ ওয়াজিব সুন্নত নামাজের অতিরিক্ত নামাজকে নফল নামাজ বলা হয়। নফল নামাজ আদায়ে অনেক ফজিলত। এ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন, গুনাহ মুক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি, ফরজের ঘাটতি পূরণসহ নানা উপকার রয়েছে নফল নামাজের।
নফল ইবাদত আবশ্যক কোনো বিষয় নয়, এটি ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ ‘অতিরিক্ত’ হিসেবে কোনো মানুষ নিজের ইচ্ছায় এ ইবাদত করে থাকেন। এর মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে। আর বুদ্ধিমান মুমিন কল্যাণের প্রতি ধাবিত হয়। যেসব কাজে আল্লাহতায়ালা সন্তুষ্ট হন, যেসব কাজ তার নিকটবর্তী করে, সেসব কাজে আগ্রহী হয়। যেসব কাজ তার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তা এড়িয়ে চলে। বিরত থাকে সেসব কাজ থেকেও, যা তার দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতির কারণ হয়। যে জিনিসের নৈকট্য উপকারী, তার কাছাকাছি থাকতে হবে। আর যে জিনিসের নৈকট্য ক্ষতিকর, তা থেকে দূরত্বে অবস্থান করতে হবে। এটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। আল্লাহতায়ালার নৈকট্যই সবচেয়ে উপকারী। যারা আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জনে অগ্রসর হয়, আল্লাহতায়ালা তাদের প্রশংসা করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা আপন রব পর্যন্ত পৌঁছার উপায় তালাশ করে। এ উদ্দেশ্যে যে, কে তার সবচেয়ে নিকটবর্তী হতে পারে। তারা তার রহমতের আশা রাখে ও তার আজাবের ভয় করে।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৫৭)। তিনি আরও বলেন, ‘যারা অগ্রগামী, তারা তো অগ্রগামীই। তারাই আল্লাহর বিশেষ নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা।’ (সুরা ওয়াকিয়া: ১০-১১)
নফল নামাজের দ্বারা আল্লাহর প্রতি বান্দার মহব্বতের পরিমাপ করা হয়। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহকে ভালোবাসার বিষয়টি যাচাই হয়। বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে এভাবে বোঝানো যায় যে, মালিকের পক্ষ থেকে কর্মচারীদের দৈনিক কাজের রুটিন ঠিক করে দেওয়া হয়, যা তাকে অবশ্যই করতে হবে। আর মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত ফরজ। তবে নফলের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর অধিকতর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করে। আর নফল ইবাদতের মধ্যে নফল নামাজ আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। পাঁচ ওয়াক্তের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত নামাজের বাইরেও কিছু নফল নামাজ রয়েছে। হাদিসে যেসব নামাজের ব্যাপারে বিশেষভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে, যেমন—এক সাহাবি প্রশ্ন করেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ কী? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি আল্লাহর জন্য বেশি বেশি সিজদা করবে (বেশি বেশি নফল নামাজ পড়বে); কারণ তুমি যখনই আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করো তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তোমার একটি পাপ মোচন করেন।’ (সহিহ মুসলিম: ১/৩৫৩)
নফল নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভ হয়। হাদিসে কুদসিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আমার বান্দা নফলের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে, একপর্যায়ে আমি তাকে মহব্বত করতে থাকি। যখন তাকে মহব্বত করতে থাকি, তখন তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে, আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে, আমি তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে আঘাত করে। আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে হাঁটে। যদি সে আমার কাছে কোনো প্রার্থনা করে আমি তার প্রার্থনা কবুল করি। যদি সে আমার আশ্রয় প্রার্থনা করে, অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দিই।’ (বোখারি: ৬১৩৭)
নফল ইবাদতে মুমিনের গুনাহ মুক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং ফরজের ঘাটতি পূরণ হয়। আমরা অনেক সময় ফরজ বিধানগুলো যথাযথ আদায় করতে পারি না। কিছু না কিছু ঘাটতি থেকেই যায়। তাই নফল নামাজ পড়া উচিত। কারণ কেয়ামতের দিন আমলনামা হিসাবের সময় ফরজ ইবাদতের ঘাটতিগুলো নফল দিয়ে পূরণ করা হবে। এ মর্মে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার ফরজ নামাজের হিসাব নেবেন। যদি ফরজ নামাজে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে তাহলে তিনি ফেরেশতাদের বলবেন, দেখো, আমার বান্দার কোনো নফল ইবাদত আছে কি না? নফল ইবাদত থাকলে আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দেবেন, তোমরা ফরজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো নফল দ্বারা পূর্ণ করে দাও। তারপর আল্লাহতায়ালা পূর্ণ অবস্থায় বান্দার আমল গ্রহণ করবেন।’ (আবু দাউদ: ৮৬৪)
তা ছাড়া নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যুক্তির দাবিও বটে। কেননা আমরা দুনিয়াতে দেখি, যে কর্মচারী মালিকের দেওয়া দায়িত্ব পালন করার পর অতিরিক্ত কাজ করে মালিককে সহযোগিতা করে, সে মালিকের প্রিয়পাত্র হয়ে যায়। তদ্রূপ যে বান্দা মালিকের পক্ষ থেকে দেওয়া ফরজ বিধানগুলো আদায়ের পর, মালিকের খুশির জন্য অতিরিক্ত আমলে ব্যস্ত থাকে, সেও আল্লাহর প্রিয় বান্দা হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করে তার ভালোবাসা ও নৈকট্য অর্জন করার তওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব