কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৪, ০৩:০১ এএম
আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২৪, ০৯:০১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সেলিম জাহান

প্রসঙ্গ ব্যাংক খাতের সংস্কার

প্রসঙ্গ ব্যাংক খাতের সংস্কার

মোটাদাগে যদি বলি, আমাদের ব্যাংক খাতে আমি ছয়টি সমস্যা দেখি। প্রথমত—অনাদায়ি বা খেলাপি ঋণ, যার পরিমাণ বিশাল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২৮ সালের জুন মাসের শেষে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, কোনো একটি দেশের অর্থনীতি স্বাস্থ্যের অবস্থা সবল থাকলে মোট ঋণের ২ বা ৩ শতাংশের বেশি খেলাপি হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে সেটা ৯ শতাংশ। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ঋণ যদি অনাদায়ি থাকে তাহলে ব্যাংক খাতের আয়ে সেটা একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, ব্যাংক খাতের নাজুকতা বেড়ে যাবে।

দ্বিতীয়ত—ব্যাংক খাতে আয়-ব্যয়ের আমরা যে হিসাব করি, তার মধ্যে নানান উল্টোপাল্টা উপস্থাপন রয়েছে। আমরা জানি যে, ঋণের মধ্যে সুস্থ ও বাজে ঋণ রয়েছে। বাজে ঋণগুলোকে অনেক সময় সুস্থ ঋণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বাজে ঋণগুলো যদি যথাযথভাবে হিসাব-নিকাশে উপস্থাপিত হয়, তাহলে ব্যাংক খাতে প্রকৃত চিত্রের বদলে অন্যরকম চিত্র ফুটে উঠবে। বাজে ঋণের বিশালত্ব এবং সুশাসনের অভাব ব্যাংক খাতের অন্যতম সমস্যা।

তৃতীয়ত—বাংলাদেশে সব ব্যাংকের ভিত্তিভূমি সবল নয়, সেখানে দুর্বল ভিত্তির ব্যাংকও রয়েছে। পর্যালোচিত ৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যার মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোকে একত্রীভূত করা হয়েছে। এর ফলে, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে আমানত আকর্ষণ করতে শুরু হচ্ছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো কোনো দুর্বল ব্যাংক আমানতের ওপর সর্বোচ্চ ১৩-১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেওয়ার প্রস্তাব করছে। সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের উচ্চ সুদে আমানত নিলে সেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চলতি নিয়ম অনুসারে ন্যূনতম ১৬-১৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হবে। এই অসম প্রতিযোগিতার কারণে ঋণের সুদও বেড়ে যাচ্ছে।

এতে অসুবিধায় পড়বেন ঋণগ্রহীতারা। তাদের ঋণব্যয় বেড়ে যাবে। সমস্যা আরও আছে। উচ্চ সুদের ঋণের অর্থ ফেরত আসবে কি না, সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই। অতীতে দেখা গেছে যে, উচ্চসুদে আমানত নিয়ে পরে সুদ-আসল দুটোই খোয়া গেছে। অর্থাৎ এভাবে অস্বাভাবিক সুদে আমানত নিলে সেখানে সুদ তো দূরে থাক, মূল টাকাও ফেরত পাওয়ার আশা হ্রাস পায়।

চতুর্থত—অনেকে বলছেন, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট আছে। গত এক বছরে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার কাছে ওঠানামা করেছে। কিন্তু অনপেক্ষ এ পরিমাণটা কত সেটি বড় কথা নয়, কথা হচ্ছে যে, এ পরিমাণটি কত দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। অনেকের ধারণা, এটি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থা তারল্যের সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় আরও ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে। ফলে পুরো ব্যাপারটির মধ্যেই ভঙ্গুরতা কাজ করছে।

পঞ্চমত—ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে জালিয়াতি রয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে লাপাত্তা, পুরো ঋণ লোপাট হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে খবর বেরিয়েছিল, কোনো কোনো ব্যাংক থেকে ৫০টি প্রতিষ্ঠান ৭ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ নিয়েছে, তারপর তাদের আর কোনো হদিসই মেলেনি।

ব্যাংক প্রতিষ্ঠা বা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব বা বিবেচনা কাজ করে। এর মাধ্যমে বহু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ব্যাংক স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যেসব ব্যাংকের সবল ভিত্তি নেই। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে যারা দুর্বল ব্যাংক এবং যারা বিধিনিষেধ মানছে না এমন ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা না নেওয়া এবং তাদের বন্ধ করে না দেওয়া বা নতুন কোনো ব্যাংক রাজনৈতিক কারণে স্থাপনের অনুমতি দেওয়া এগুলোর কোনোটাই নেই। টাকা পাচার হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় দুর্বল ভিত্তি ভূমির কারণে কিছুদিন আগে দেশে বেশ কিছু ব্যাংকের একীভূতকরণ ঘটেছে। সারা বিশ্বে ব্যাংক, শিল্প কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একত্রীভূতকরণ নতুন কিছু নয়। নানান অর্থনীতিতে নানান সময়ে এটা ঘটেছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক টালমাটালের সময়। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময়েও এটা আমরা লক্ষ করেছি। সাধারণত তিনটি কারণে এ জাতীয় একত্রীভূতকরণ ঘটে থাকে। এক, ক্ষমতার বলয় প্রসারণের জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠান ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আত্তীভূত করে থাকে; দুই, প্রতিযোগিতাকে হ্রাস করে একচেটিয়া বাজার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাস করে এবং তিন, আর্থিক সমস্যাসংকুল নানান প্রতিষ্ঠানকে অন্যান্য ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একত্রীভূত করে বাজারে স্থিতিশীলতা ও আস্থা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে।

প্রশ্ন উঠেছে যে, আমাদের দেশে ব্যাংকের একত্রীভূতকরণ ঘটল কেন? অনেকেই বলছেন যে, বর্তমান সময়ে ব্যাংক খাতে যে সমস্যাসমূহ এবং অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান, সেটাকে হ্রাস করার জন্যই এ একত্রীভূতকরণ। সেইসঙ্গে এটাও বলা হচ্ছে যে, অর্থনীতিতে আস্থা বৃদ্ধির জন্য এটার প্রয়োজন ছিল। কেউ কেউ মত দিয়েছেন যে, কোনো কোনো ব্যাংককে বাঁচানোর জন্যই এ পদক্ষেপ। কোনো একটি ব্যাংক যদি গণেশ ওল্টায়, তাহলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটা টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

সাধারণভাবে, বাংলাদেশে ব্যাংকসমূহের একীভূতকরণ সম্পর্কে পাঁচটি কথা মনে রাখা দরকার। প্রথমত—প্রতিযোগিতা ও দক্ষতার নিয়মে সাধারণ কোনো ব্যাংক যদি আর্থিক দিক থেকে অকৃতকার্য হয়, তাহলে তাকে স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্ত হতে দেওয়া ভালো। যদি না সে ব্যাংকটি এমন বড় ও গুরুত্বপূর্ণ হয় যে, তার মৃত্যু পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার সামষ্টিক স্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে।

দ্বিতীয়ত—বিভিন্ন ব্যাংকের একীভূতকরণ যদি একচেটিয়া বাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হয়, তবে তা পরিত্যাজ্য। একচেটিয়া বাজার গ্রাহককে প্রতিযোগিতামূলক সেবা দেবে না এবং এর ফলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেইসঙ্গে ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ ঘটলে তা সামগ্রিক অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও কী রকম প্রভাব ফেলবে, তাও মূল্যায়িত হওয়া দরকার।

তৃতীয়ত—বাংলাদেশে বর্তমান ব্যাংক খাতে যেসব মৌলিক সমস্যা রয়েছে, তার জন্য কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। সেসব কষ্টকর কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিকল্প একীভূতকরণ হতে পারে না।

চতুর্থত—ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ ঘটলে দুর্বলতর ব্যাংকটির কর্মীদল, তাদের কর্মনিরাপত্তা, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

পঞ্চমত—একটি অর্থনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটে একটি ব্যাংক খাতের অনুকূল সংখ্যা আছে। মোট ব্যাংকের সংখ্যা সে সংখ্যাকে অতিক্রম করে গেলে সেখানে একটি নাজুকতার জন্ম হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নাজুকতা ও অস্থিতিশীলতা থাকা সত্ত্বেও কেন নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, তা পর্যালোচিত হওয়া প্রয়োজন। অন্য ভাষায়, একীভূতকরণের (অর্থাৎ ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনা) মাধ্যমে যখন ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য সুরক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেখানে নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমোদনের যৌক্তিকতা কোথায়?

শেষত বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুশাসনের বিরাট সমস্যা আছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেহেতু অর্থের সঙ্গে জড়িত, সেহেতু এখানে উচ্চস্তরের দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। সেটা নিশ্চিত করা এবং বিধিনিষেধগুলো ঠিকমতো চালিত করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব। বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, নানান ব্যাংক প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের আওতার মধ্যে আনা দরকার কিন্তু আনা যাচ্ছে না।

ব্যাংক প্রতিষ্ঠা বা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব বা বিবেচনা কাজ করে। এর মাধ্যমে বহু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ব্যাংক স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যেসব ব্যাংকের সবল ভিত্তি নেই। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে যারা দুর্বল ব্যাংক এবং যারা বিধিনিষেধ মানছে না, এমন ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা না নেওয়া এবং তাদের বন্ধ করে না দেওয়া বা নতুন কোনো ব্যাংক রাজনৈতিক কারণে স্থাপনের অনুমতি দেওয়া এগুলোর কোনোটাই নেই। এটি না হওয়ার কারণে আমরা ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব দেখছি।

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যদি সুশাসন না আসে, এর কাঠামোগত সংস্কার যদি না গ্রহণ করা হয় এবং ব্যাংক খাতে গ্রাহক বা সাধারণ মানুষদের আস্থার জায়গাটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু অর্থনীতির ভিত দুর্বল হয়ে যাবে।

লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক

মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

সুদ দিতে না পারায় বসতঘরে তালা, বারান্দায় রিকশাচালকের পরিবার

দেশ বাঁচাতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে : চরমোনাই পীর

এএসপির বাসায় চাঁদাবাজি-ভাঙচুর, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

জেলের জালে বড় ইলিশ, ৯ হাজারে বিক্রি 

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন নিয়ে নতুন নির্দেশনা

আগামী সংসদ প্রথম তিন মাস ‘সংবিধান সংস্কার সভা’ হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব

১০

ধরলার তীব্র ভাঙন, টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি

১১

নেতা ও ভোটারের জবাবদিহিই হবে শ্রেষ্ঠ সংস্কার : মঈন খান

১২

পাপের ফল ওদের ভোগ করতেই হবে : রাশেদ খান

১৩

ক্ষমা চাইলেন স্বাধীন খসরু 

১৪

স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত : আমিনুল হক

১৫

ঢাকায় উদযাপিত হলো রাশিয়ান পতাকা দিবস

১৬

একাদশে ভর্তিতে কোনো শিক্ষার্থী পায়নি ৩৭৮ কলেজ

১৭

৫০ হাজারে শ্লীলতাহানির রফাদফা করলেন সভাপতি-প্রধান শিক্ষক

১৮

কে বেশি টাকা দেয়, ফেসবুক নাকি ইউটিউব

১৯

অর্ধ বিলিয়ন জরিমানা থেকে রেহাই পেলেন ট্রাম্প

২০
X