সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন দিন কয়েকের মধ্যে জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়। আমাদের দেশে বৈষম্য শুধু চাকরির কোটায় নয়, পুরো সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রে আজ চরম বৈষম্য বিরাজমান। ধনী-গরিব বৈষম্য, শ্রেণি বৈষম্য, উন্নয়ন অগ্রাধিকার বৈষম্য, সর্বস্তরে-সবখানে শুধু বৈষম্য—যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ৫ আগস্ট, ২৪—এক ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন তথা গণবিস্ফোরণের মুখে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পদত্যাগ। অতঃপর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে দেশে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির নিরসন ঘটে এবং দীর্ঘদিনের অমানিষা কেটে জাতীয় জীবনে সুদিনের সম্ভাবনা সূচিত হয়।
দীর্ঘদিনের শোষণ-নিপীড়ন এবং অন্যায়-অনিয়মের অচলায়তন ভেঙে একটি আদর্শিক জনকল্যাণমুখী ও উন্নত বাংলাদেশ গঠন করার জন্য সবার আগে চাই রাষ্ট্র সংস্কার। অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তন না হলে ইউনূস সরকারের গৃহীত সব আশু পদক্ষেপ ভেস্তে যাবে এবং দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র আবার মুখ থুবড়ে পড়বে এবং দেশে নতুন করে স্বৈরাচারের আবির্ভাব ঘটবে। যার ফলে অনাগত তরুণ প্রজন্মের রক্ত ঝরবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এজন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সংস্কার অনিবার্য। উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতিই হতে পারে সমৃদ্ধ বাংলাদেশে গঠনের মূল সোপান।
শহীদদের এই বিরল আত্মত্যাগ একটি শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের বার্তা বহন করে। এমন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিতে আমূল পরিবর্তন জরুরি বলে আমি মনে করি। বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো বিগত এক দশকে জনগণের ভোটাধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাবরণ করেছে। অসংখ্য নেতাকর্মী অগণিত গায়েবি মামলা কাঁধে নিয়ে ফেরারি জীবনযাপন করেছে, অনেকে মৃত্যুবরণ করেছে। দলের চেয়ারপারসন ও দেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দীর্ঘ সময় কেটেছে কারাগারে, তথাকথিত মামলার রায়ে দণ্ডিত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশ থেকে বিতারিত এবং গণমাধ্যমে তার বক্তৃতা প্রচার নিষিদ্ধ। মোট কথা, বিএনপিকে গত ১৫ বছর কোথাও একদণ্ড দাঁড়াতে দেয়নি সরকার। সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতা, সবাই সরকারের অমানুষিক নির্যাতন ও নিষ্পেষণের শিকার হয়েছে। বিএনপি ভাঙার জন্য আওয়ামী লীগ সব ধরনের কর্মকৌশল প্রয়োগ করেছে, পুলিশের লাঠিচার্জ থেকে শুরু করে আদালতের ফরমায়েশি রায় সবই জুটেছে বিএনপির কপালে। তবু নুয়ে পড়েনি বিএনপি। নেতাকর্মীদের অপরিসীম ত্যাগ, অসীম সাহস, দলের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য এবং সর্বোপরি, দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর অকুণ্ঠ সমর্থনে দলটি সব বাধা-বিপত্তি জয় করে আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী অবয়বে টিকে আছে।
সাম্প্রতিককালে আন্দোলনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন দিয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে রাজপথে অবস্থান নিয়েছে, চূড়ান্ত বিজয়ে তাদের নেপথ্য অবদান রয়েছে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন শুধু তরুণদের আন্দোলনের ফসল, সাফল্যের কৃতিত্ব শতভাগ অকুতোভয় তারুণ্যের। তারা রক্ত দিয়েছে, বোনদের রক্ষার্থে ভায়েরা নিজেদের বুক আগলে দিয়েছে, তারা আজকের প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা। কত সাহসী ও মর্মস্পর্শী ঘটনা আমাদের মনকে বিদীর্ণ করে যায়। একজন শহীদ আবু সাঈদকে পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে দেখেছি, শরীরে বুলেট বিদ্ধ শহীদ মুগ্ধ বোতলভর্তি পানির ব্যাগ নিয়ে ‘পানি, পানি লাগবে’ বলে ছুটতে ছুটতে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে দেখেছি, মধ্যযুগের চেয়েও চরম নিষ্ঠুরতায় পুলিশের গাড়ি থেকে শহীদ ইয়ামিনকে মৃতপ্রায় অবস্থায় রাস্তায় ফেলে নির্মম পাশবিকতায় হত্যা করতে দেখেছি। আমরা দেখেছি মায়েরা অবধারিত মৃত্যুর শঙ্কা জেনেও ছেলেমেয়েদের মিছিলে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছে, যারা অনেকে আর ঘরে ফিরে আসেনি। মায়েদের তাদের শহীদ সন্তানদের লাশের পাশে বসে কাঁদতে দেখিনি। শত শত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান। শহীদদের বুকের পাঁজর হতে মাটিতে নুয়ে পড়া রক্তে অর্জিত এই ঐতিহাসিক বিজয় তারুণ্যের। এ বিজয় ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন বুদ্ধিদীপ্ত উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি—বিএনপি এর জন্য কতটা প্রস্তুত?
বিএনপির দীর্ঘদিনের সরকার পতনের আন্দোলন দেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করলেও সফলতা আসেনি। কোটি তারুণ্যের অদম্য সাহস, মনোবল, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় অনাচারের অবসান ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপি উদ্বেলিত, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্ত, নেতাকর্মীরা জেল থেকে বাড়ি ফিরছে, দলের মধ্যে একটি চাঙ্গাভাব ফুটে উঠেছে। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা শুরু থেকেই কিছু রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছে। তারা প্রথমে শহীদদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতেন, আহতদের খোঁজখবর নিতেন, তারপর পল্টনে জনসভা করতে পারতেন, এতে তারুণ্যের ত্যাগের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা হতো। দীর্ঘদিন পর খালেদা জিয়ার বক্তব্য দলের নেতাকর্মীদের দারুণভাবে আন্দোলিত করেছে ও উজ্জীবিত করেছে এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভার্চুয়াল ভাষণও সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছে ও সাহস জুগিয়েছে, সন্দেহ নেই। তবে এসব আরও কিছুদিন পর হলে দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের কাছে তার আবেগগত মূল্য বেশি হতো। দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েও বিএনপি প্রতিশোধপরায়ণ হয়নি। প্রায় পুলিশবিহীন দেশে তারা জননিরাপত্তায় সহায়তা করেছে, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, মন্দির পাহারা দিয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। তবু বলতে হয়, বিএনপিদলীয় আনুষ্ঠানিকতার বাইরে থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একযোগে দেশের জন্য কাজ করলে তা আরও প্রশংসনীয় হতো।
তারুণ্যের বিপ্লব বদলে দিয়েছে বাংলাদেশ, বদলে যাওয়া বাংলাদেশে বিএনপিকে বদলাতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে জনগণের ভোটে আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। তবে তারুণ্যের স্বপ্নের সঙ্গে তাদের ক্ষমতালাভের স্বপ্ন যদি সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে এই দল ক্ষমতায় এলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে। বিএনপিকে সাজতে হবে নতুন অবয়বে, সুবিধাভোগী, দুর্নীতিবাজ নেতাদের দল থেকে সরাতে হবে, দেশপ্রেমিক, আদর্শবান ও যোগ্যদের সামনে আনতে হবে, সৎ ও মেধাবীদের রাজনীতিতে আসার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। ছাত্রদের হাতে অস্ত্র নয়, কলম তুলে দিতে হবে, মেধাবী, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিক প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে দলের রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের দখল ও সিন্ডিকেট বাণিজ্য বন্ধ করে জনকল্যাণমুখী ও সর্বজনীন রাজনীতির পথ সুগম করতে হবে, রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরিয়ে আনতে হবে। মহান জাতীয় সংসদকে ব্যবসায়িক স্বার্থের কেন্দ্রস্থল থেকে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার জন্য সৎ ও যোগ্য প্রতিনিধিদের কণ্ঠস্বরের রূপান্তর ঘটাতে হবে। এজন্য গোটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন জরুরি, এসব পরিবর্তনের ব্রত নিয়ে বিএনপিকে আগামীর পথে চলতে হবে। না হলে, বারবার হোঁচট খেতে হবে।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সাংবাদিক