গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং এরপর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর তাদের সামনে এখন রাষ্ট্র সংস্কারের পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ। এসবের মধ্যে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ নিঃসন্দেহে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। সভায় প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ‘যৌক্তিক’ সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত হয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর এ অবস্থান বাস্তবিকই প্রতীয়মান হচ্ছে সব মহলে।
শনিবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা মতবিনিময়কালে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারসহ নির্বাচনের বিষয়ে মতামত প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক দলের নেতারা জানান, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। কোরআন-সুন্নাহ এবং ইসলামবিরোধী কোনো আইন বা পদক্ষেপ না নেওয়ার দাবিও জানান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত অসম চুক্তিসমূহ বাতিলের পাশাপাশি একই ব্যক্তি যাতে দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন, সেই প্রস্তাবনা দেন রাজনীতিকরা। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আলাদাভাবে বিভিন্ন প্রস্তাবনা লিখিতভাবে উপস্থাপন করেন। নেতাদের এসব বক্তব্য ও প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টা গুরুত্ব সহকারে শোনেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান। মতবিনিময় সভা শেষে বিভিন্ন দলের নেতারা গণমাধ্যমের কাছে এসব বিষয় তুলে ধরেন।
অন্তর্বর্তী সরকার এখন তৎপর রাষ্ট্রের সামগ্রিক সংস্কার নিয়ে। এরই অংশ হিসেবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গত ১২ আগস্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেদিনও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেন তিনি। সে বৈঠকেও আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে বর্তমান সরকারকে ‘যৌক্তিক’ সময় দেওয়ার পক্ষে অনেকটাই একমত পোষণ করে দলগুলো।
আমরা সবাই জানি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। তবে দেশের বিরাজমান প্রেক্ষাপট একটি সর্বজনগ্রহণযোগ্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনবান্ধব নয়। গত দেড় দশকে বিগত সরকারের অপশাসন ও দুঃশাসনে নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের যে হাল হয়েছে, তার ব্যাপক সংস্কার ছাড়া এটি অসম্ভব। ফলে সবার আগে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় যে সংস্কার জরুরি—তা বলাই বাহুল্য। কেননা রাষ্ট্র পরিচালনায় আবার কোনো শাসকশ্রেণি ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠুক, তা কারোই কাম্য নয়।
আমাদের প্রত্যাশা, দেশের চলমান বাস্তবতা বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ এবং ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ তৈরির জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের যে উপযুক্ত সময় প্রয়োজন, রাজনৈতিক দলগুলো দেশের ভবিষ্যৎ কল্যাণের কথা চিন্তা করে সহযোগিতা করবে। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল উদ্দেশ্যই যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তর করা, সেহেতু তাদেরও উচিত হবে একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে এ দায়িত্ব সম্পন্ন করা—এটিই নিয়মতান্ত্রিক পথ।