দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর পরবর্তী অমাবস্যার রাতেই দীপাবলির আয়োজন। দীপাবলির রাতে অনুষ্ঠিত হয় দীপান্বিতা কালীপূজা। এ ছাড়া মাঘ মাসে রটন্তি কালীপূজা এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যায় এবং বিভিন্ন সিদ্ধ অমাবস্যায় কালীপূজা করা হয়। ‘দিওয়ালি’ নামেও পরিচিত দীপাবলি। অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করার প্রয়াস মানুষ সেই আদিকাল থেকেই করে আসছে। অমাবস্যা রজনীর সমস্ত অন্ধকার দূর করে পৃথিবীকে আলোকিত করার অভিপ্রায়ে এই প্রদীপ প্রজ্বালন। পৃথিবীর সকল অমানিশা দূর করতেই এ আয়োজন। অশুভ শক্তির হাত থেকে প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে রক্ষা করতেই এ আলোকিত করা। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যায় এবং বিভিন্ন সিদ্ধ অমাবস্যায় কালীপূজা করা হয়।
মুণ্ডক উপনিষদে (২/২/১১) বর্ণিত আছে, ‘ব্রহ্মৈবেদং বিশ্বমিদং বরিষ্ঠম’ অর্থাৎ এই জগৎ শ্রেষ্ঠতম ব্রহ্মই। দেবীসূক্তে বলা হয়েছে, ব্রহ্মময়ী দেবী পৃথিবী ও আকাশের অতীত হয়েও পরিদৃশ্যমান বিশ্বরূপ ধারণ করেছেন। মহামায়া দেবী মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী ও মহাকালী—এ তিন রূপে প্রকাশিতা। মহাকালী তামসী ও ঋক্বেদ রূপা। মহালক্ষ্মী রাজসী ও যজুর্বেদরূপা। মহাসরস্বতী সাত্বিকী ও সামবেদ রূপা।
দেবী ভাগবতে বলা হয়েছে—
সদৈকত্বং ন ভেদোহস্তি সরব মমাস্য চ।
যোহসৌ সাহম অহং যাসৌ ভেদোহস্তি মতিবিভ্রমাৎ।।
অর্থাৎ, আমি ও ব্রহ্ম এক। উভয়ের মধ্যে ভেদ নেই। যিনি ব্রহ্ম তিনিই আমি। আমি যাহা, তিনিও তাহাই। এই ভেদ ভ্রমকল্পিত, বাস্তব নহে।
দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী কালী। অশুভ শক্তির বিনাশকারী শুভ শক্তিদাত্রী দেবী কালী। অসুর শুম্ভ ও নিশুম্ভের অত্যাচার এতটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে যে, দেবতারাও এদের ভয়ে ত্রস্ত হয়ে স্বর্গ ত্যাগের উপক্রম হয়। শুম্ভ ও নিশুম্ভের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পেতে শুম্ভ ও নিশুম্ভের নিধনের উদ্দেশ্যে দেবরাজ ইন্দ্র দেবী পার্বতীর শরণাপন্ন হন। দেবী পার্বতী শুম্ভ ও নিশুম্ভের নিধনের জন্য নিজ শরীরের কোষ থেকে অন্য এক ভয়ংকরী দেবী সৃষ্টি করেন, যা দেবী কালীর আদি রূপ। দেবী কালী শিবের শক্তিরূপে আবির্ভূত হন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, কালী দেবীর নানা রূপে অতীত পৃথিবী ও আকাশের বর্ণনা আছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে উল্লেখ আছে, তিনি বিভিন্ন রূপে অসুরদের ধ্বংস করে স্বর্গের দেবতাদের রক্ষা করেন। ইন্দ্রসহ সকল দেবতা, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দেবী অম্বিকার কাছে প্রার্থনা করেন। বিস্তারিত শুনে অম্বিকা ক্রোধে উন্মত্ত হলেন। তখন দুই রূপ হলো তার—অম্বিকা ও কালিকা বা কালী। শুম্ভ ও নিশুম্ভের অনুচর চণ্ড ও মুণ্ডকে দেবী কালী বধ করেন। এ কারণে তার আর এক নাম হয় চামুণ্ডা।
কালীপূজার কালী শব্দটি কাল শব্দের স্ত্রীর রূপ, যার অর্থ হলো কৃষ্ণ বর্ণ বা গুরু বর্ণ। বিভিন্ন পুরাণ থেকে থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মা দুর্গার অন্য একটি রূপ হলো কালী। মহাভারতে কালীর উল্লেখ রয়েছে, সেখানে যোদ্ধা এবং পশুদের আত্মা বহন করেন যিনি, সেই তিনিই কালরাত্রি কালী নামে পরিচিত। নবদ্বীপের এক তান্ত্রিক, যার নাম কৃষ্ণানন্দ, তিনি বাংলায় প্রথম কালীমূর্তি বা প্রতিমা পূজার প্রচলন করেন। তার আগে মা কালীর উপাসকরা তাম্র পটে বা খোদাই করে কালীর মূর্তি এঁকে মা কালী সাধনা করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এভাবে মা কালীর প্রতিমা পূজার প্রচলন শুরু।
কালী সংহারমূর্তি। কিন্তু এ সংহার নিষ্ঠুর ধ্বংস নয়। এ সংহার সংহরণ অর্থাৎ আপনার মধ্যে আকর্ষণ। সমুদ্রের তরঙ্গমালার উদ্ভব সমুদ্র থেকেই। আবার সেই তরঙ্গমালার লয়ও হয় সমুদ্রবক্ষে। সংহার তেমনই একটি ব্যাপার। এটি হলো তার নাশিনী শক্তি। আবার আদ্যাশক্তি বিশ্বপ্রসবকারিণী মায়ের উদর থেকেই জগৎ প্রপঞ্চের সৃষ্টি। তখন তিনি সৃজনী শক্তি। দেবী কালী অসুর বিনাশে ভয়ংকরী। পৃথিবীর সকল অন্যায় ও অত্যাচার দূর করতে দেবী কালী অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করেন। কালী দেবতা শিবের সহধর্মিণী এবং বিশেষ শক্তি। তিনি কাল ও মৃত্যুর দেবীরূপে আত্মপ্রকাশ করার কারণে তাকে শ্মশানকালী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ ছাড়া দেবী কালীর অনেক নাম রয়েছে। যেমন— ভদ্রকালী, দক্ষিণাকালী, মা তারা, শ্যামা, মহাকালী ইত্যাদি।
দুর্গাপূজার মতো কালীপূজাও গৃহে বা মণ্ডপে প্রতিমা নির্মাণ করে সম্পন্ন করা হয়। দেবী কালীকে ধ্যান, পূজা, আরতি, ভোগ প্রভৃতি কর্ম সম্পাদন করে সবশেষে প্রণাম করা হয়।
কালী পূজার ধ্যানঃ
ওঁ শবারূঢ়াং মহাভীমাং ঘোর-দংষ্ট্রাবরপ্রদাম্।
হাস্যযুক্তাং ত্রিনেত্রাঞ্চ কপালকর্তৃকাকরাম॥
মুক্তকেশীং লোলজিহ্বাং পিবন্তীং রুধিরং মুহূঃ।
চতুর্বাহুযুতাং দেবীং বরাভয়করাং স্মরেৎ॥
সরলার্থ: দেবী কালী শবারূঢ়া, ভীমা ভয়ংকরী, তিনি ত্রিনয়নী, ভয়ানক তার দাঁত, লোল জিহ্বা তার। তিনি মুক্তকেশী, হাতে নরকপাল ও কর্তৃকা (কাটারি)। অপর দুহাতে বর ও অভয় মুদ্রা, দেবী আবার হাস্যময়ী। এখানে কোমল ও কঠোর রূপে দেবী কালীর রূপ বর্ণিত হয়েছে।
দেবী কালী অন্যায় প্রতিরোধ করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার ভক্তদের কল্যাণে নিয়োজিত। তার কাছ থেকে আমরা মঙ্গল সাধন করার শিক্ষা পাই। দেবী কালীর কাছে আমরা অন্যায়ের কাছে কঠোর, সহজের কাছে কোমল হওয়ার শিক্ষা পাই। অন্যায়কারীর কাছে দেবী রাগী, ভয়ংকরী। ভক্তের কাছে স্নেহময়ী জননী।
আর্থসামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক জীবনে কালীপূজার প্রভাব পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন—দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গ্রহকালী, চামুণ্ডা, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি। মহাকাল সংহিতা অনুসারে, মা কালীর আবার নবরূপের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন—কালকালী, কঙ্কালকালী, চিকাকালী এমন সব রূপের পরিচয়ও পাওয়া যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্দিরে ব্রহ্মময়ী, আনন্দময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী ইত্যাদি নামেও মা কালীর পূজা বা উপাসনা করা হয়।
দেবী কালী ক্ষমতা ও শক্তির আধার। তিনি একাধারে কঠোর, অন্যদিকে মমতাময়ী মা। তিনি এ বিশ্বের সকল অশুভ শক্তি ধ্বংস করে সবার মধ্যে মঙ্গলবার্তা ছড়িয়ে দিয়ে থাকেন। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা দেবী কালীকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজা করে থাকেন। এ পূজার মাধ্যমে আমাদের আর্থসামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক জীবনে অনেক ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
ওঁ কালি কালি মহাকালি কালিকে পাপহারিণি।
ধর্ম্মকামপ্রদে দেবি নারায়ণি নমোহস্তুতে।।
মহিষঘ্নি মহামায়ে চামুণ্ডে মুণ্ডমালিনি।
আয়ুরারোগ্যবিজয়ং দেহি দেবি নমোহস্তুতে।
লেখক: ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কমিটির উপদেষ্টা পুরোহিত, সম্পাদক জয়বাবা লোকনাথ পঞ্জিকা এবং অতিরিক্ত সচিব (অব.)