অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৩ এএম
আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

তরুণ প্রজন্ম এবং ৭ নভেম্বরের বিপ্লব

তরুণ প্রজন্ম এবং ৭ নভেম্বরের বিপ্লব

বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৫ বয়সী কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীর সংখ্যা তিন কোটির ঘরে, যা জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। ছাত্র-জনতার জুলাই ’২৪ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তারা আমাদের সবার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অর্জন করেছে। অকুতোভয় আন্দোলনকারীরা বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছে; হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি, নির্যাতন-গুম তাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। পকেটে নাম-ঠিকানা, পিতা-মাতার নাম লেখা কাগজ নিয়ে রাস্তায় নেমেছে; তাদের অনেকে ঘরে ফিরে আসেনি। তাদের সংকল্প এবং আত্মত্যাগ পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং ছাত্র-জনতার যৌথ আন্দোলন শেখ হাসিনার রাষ্ট্র ধ্বংসকারী ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনটি দিন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং বাংলাদেশকে একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম এবং আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র গঠনের ধারায় ফিরিয়ে এনেছে। দিবস তিনটি হলো—৭ নভেম্বর ১৯৭৫, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ ও ৫ আগস্ট ২০২৪। ৭ নভেম্বরের তাৎপর্য আমরা প্রবীণরা যেভাবে উপলব্ধি করতে পারি, আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য তা সহজ নয়। তাদের জন্ম ২০০০ থেকে ২০১০-এর মধ্যে এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দূর অতীতের কথা। আশার কথা, আমাদের কিশোর এবং তরুণরা অনেক তথ্য-উপাত্ত নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করে এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচারের চেষ্টা করে। তা না হলে মুজিবময় পাঠ্যপুস্তক, শপথবাক্য আর আওয়ামী লীগ সরকারের মুজিব বন্দনার বিপরীতে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠত না।

৭ নভেম্বরের পটভূমি রচিত হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনালগ্নে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়, সে রাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এ ক্রান্তিকালে ২৬ মার্চ বিহ্বল জাতি মেজর জিয়াউর রহমানের চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায় সম্বিত খুঁজে পায়। অথচ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার যে কোনো ছুতায় জিয়াউর রহমানের মর্যাদাহানিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি, চক্ষুলজ্জারও ধার ধারেনি। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আদালতের রায়ের আড়ালে মেজর জিয়াউর রহমানের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছে।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার জিয়াউর রহমানের সম্মানহানি এবং তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে এতটাই মনোযোগী ছিল যে, অনেক সত্য ঘটনা জনগণের কাছে অজানা থেকে গেছে। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড মেজর ফারুক সম্পর্কে খালেদ মোশাররফের ভাগনে এবং তার ছত্রছায়ায় ঢাকা সেনানিবাসে দম্ভের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। তার চেয়েও ভয়ংকর কথা হলো, ১৯৭৩ সালে তিনি অভ্যুত্থানচেষ্টা করে ব্যর্থ হন, যা সেনাবাহিনী জ্ঞাত ছিল। তবু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং মিশর থেকে উপহার পাওয়া নতুন ৩২টি ট্যাঙ্ক তার হাতেই ন্যস্ত করা হয়। মেজর ফারুকের ট্যাঙ্ক বাহিনী সরাসরি সেনাপ্রধানের কমান্ডে ছিল। অন্যদিকে অভ্যুত্থানে মেজর ফারুকের প্রধান সহযোগী মেজর রশীদ সম্পর্কে ফারুকের ভায়রা ভাই। প্রশিক্ষণ শেষে তার পোস্টিং নিয়মিতভাবে যশোরে হয়েছিল। কিন্তু ফারুক খালেদ মোশাররফকে ধরে রশীদের পোস্টিং বাতিল করে ঢাকায় রাখার বন্দোবস্ত করেন।

২ অথবা ৩ নভেম্বর মাঝরাতে শাফায়াত জামিল তার অধীনে পদাতিক বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করেন। প্রথমেই সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তার ঘরে অন্তরীণ করা হয়। রেডিও-টিভি স্টেশন দখল করা হয়, টেলিফোন এক্সচেঞ্জে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। বঙ্গভবন পাহারায় নিয়োজিত ইউনিটকে সেনানিবাসে ফেরত আনা হয়। এরপর খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহের নিয়ন্ত্রণ নেন। রাষ্ট্রপতি ও অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য সারা দিন যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার সশব্দে বঙ্গভবনের ওপর চক্কর দিতে থাকে। খালেদ মোশাররফ মেজরদের সেনানিবাসে ফেরত আসার নির্দেশ দেন। সারা দিনের উত্তপ্ত বাদানুবাদ শেষে মেজর মহিউদ্দিন ছাড়া বাকি ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় পরিবারসহ থাইল্যান্ডে চলে যায়। এরই মধ্যে জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র সংগ্রহ করা হয়।

তাহেরের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ঢাকা সেনানিবাসে ৪ নভেম্বর থেকে ১২ দফা দাবি সংবলিত লিফলেট বিতরণ শুরু করে। সিপাহিদের ন্যায্য কিছু দাবির সঙ্গে সুকৌশলে তার সমাজতান্ত্রিক দাবি ঢুকিয়ে দেন। সঙ্গে রং চড়িয়ে খালেদ মোশাররফ এবং শাফায়াত জামিলের আওয়ামী লীগ ও ভারতপ্রীতির গুজব ছড়ানো হয়। সিপাহিরা উত্তেজিত হতে থাকে। তারা প্রথম থেকেই জিয়াউর রহমানের আটক এবং পদত্যাগ ভালোভাবে নেয়নি। ৬-৭ নভেম্বর মাঝরাতে ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সিপাহিরা ফাঁকা গুলি করে বিদ্রোহের জানান দেয়। এর পর ঘটনা দ্রুত ঘটতে শুরু করে। ৪৬ ব্রিগেডের যে তিনটি পদাতিক ইউনিট খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল পরিচালিত অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। মেজর মহিউদ্দিন (১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে জড়িত দেশে থেকে যাওয়া একমাত্র অফিসার) এবং সুবেদার মেজর আনিসুল হক তাদের অনুগত কিছু সৈনিকসহ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি থেকে উদ্ধার করে তাদের সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিয়ে আসেন। অনেকে প্রচার করেন তাহেরের সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করে, যা সত্য নয়। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিদ্রোহ অনুঘটন হিসেবে কাজ করলেও জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেন এ দুজন সেনা কর্মকর্তা। সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে অবস্থানকালে এ রেজিমেন্ট এবং চতুর্থ বেঙ্গলের অফিসার, নন-কমিশন্ড অফিসার এবং সিপাহিরা জিয়াকে আগলে রাখে। এখানে উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে ফারুকের ট্যাঙ্ক ইউনিটের সঙ্গে রশীদের সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্ট অংশগ্রহণ করেছিল। চতুর্থ বেঙ্গল শাফায়াত জামিলের সঙ্গে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। ৭ নভেম্বর তারা সবাই জিয়ার চারদিকে প্রতিরক্ষা তৈরি করে।

সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিজের অবস্থান সংহত করার পর জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে অবস্থানরত সব সিনিয়র অফিসারকে তার কাছে হাজির করার আদেশ দেন। সৈনিকরা নিজ উদ্যোগে সেনানিবাসের সব অফিসারকে খুঁজে জিয়ার সামনে হাজির করে। তাদের মাঝে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী বীরউত্তম। তিনি সে সময় যশোর সেনানিবাসের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন এবং ৬ নভেম্বর ঢাকার মিটিংয়ে যোগ দিতে এসেছিলেন। এসব অফিসার ও অনুগত সৈনিক জিয়ার চারদিকে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে এবং তাকে সুরক্ষিত রাখে উচ্ছৃঙ্খল সিপাহি এবং সেনানিবাসে অনুপ্রবেশকারী তাহেরের সন্ত্রাসীদের থেকে।

তাহের ৭ নভেম্বর ভোররাতে সেনানিবাসে এসে জিয়াউর রহমানকে রেডিও স্টেশনে উপস্থিত হয়ে ভাষণ দিতে আহ্বান করেন এবং সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান। তাহেরের অভিসন্ধি উপলব্ধি করে এবং জিয়াউর রহমানের প্রাণহানির আশঙ্কায় উপস্থিত সেনা কর্মকর্তারা জিয়াউর রহমানকে সেনানিবাসের বাইরে যেতে বাধা দেন এবং রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। তাহেরের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তাহের বিফল হয়ে ফেরত যান। তৎকালীন সেনাবাহিনীতে কর্মরত সব জ্যেষ্ঠ অফিসার পরবর্তীকালে সর্বসম্মতভাবে মত দিয়েছেন, তাহেরের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সেনানিবাস থেকে বের না হওয়া সঠিক ছিল। এর ফলে দেশ গৃহযুদ্ধ থেকে বেঁচে যায়। জিয়াউর রহমান তাহেরের আয়ত্তে চলে গেলে তাকে জিম্মি করে নিজের মতো ভাষণ আদায় করে নিতেন এবং জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তায় সওয়ার হয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিতেন। এমন ধারণা অবাস্তব শোনালেও সমাজতন্ত্রীরা যে কোনো উপায়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনকে বৈধ মনে করে। উপরন্তু তাহের উগ্রপন্থি রাজনীতিতে এরই মধ্যে জড়িত ছিলেন। জিয়াউর রহমান হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর তাহের তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেন অফিসার হত্যায় সিপাহিদের উৎসাহ দিয়ে, যার ফল ছিল মর্মান্তিক।

৭ নভেম্বর না হলে বাংলাদেশ উদার গণতন্ত্র এবং সুশাসনের ধারায় ফিরত না। অভাব, দারিদ্র্য, দুর্নীতি এবং অরাজকতায় জর্জরিত হয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। সিপাহি-জনতার বিপ্লবের আদর্শ ধারণ করে আমাদের তরুণদের ৫ আগস্ট ’২৪ বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে হবে। কাজ মাত্র শুরু। হাজার শহীদের রক্ত বৃথা যাবে যদি আমরা সফল হতে না পারি। আমরা সবাই বিপ্লব সফল করতে বদ্ধপরিকর।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ অধ্যাপক। বিএনপির গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক, বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য এবং ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউট্যাব) মহাসচিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তাইওয়ান ইস্যুতে জাপানের বক্তব্য, পাল্টা অবস্থান চীনের

পানি কি সত্যিই ত্বক উজ্জ্বল করে

তিশার বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রযোজকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

ভূমিকম্প / বুয়েট বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ঢাবিতে হল পরিদর্শন শুরু

কংক্রিট নির্ভর উন্নয়ন ঢাকাকে অনিরাপদ করেছে : পরিবেশ উপদেষ্টা

সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য রুপালি বরখাস্ত, এলাকায় মিষ্টি বিতরণ

মহাসড়কের পাশে মিলল কাপড়ে মোড়ানো নবজাতক 

ইউআইইউতে ভূমিকম্পের ঝুঁকি এবং নিরসন বিষয়ক সেমিনার

বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের সেনা-বিজিপির ৫ সদস্য

হাওর থেকে যুবকের মরদেহ উদ্ধার

১০

র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার অপহরণ মামলার আসামি সম্রাট

১১

স্মার্টফোন যেভাবে ভূমিকম্প শনাক্ত করে

১২

ছাত্রদলের ১ ইউনিটের কমিটি স্থগিত

১৩

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনে নেবে ১ হাজার ১৫২ জন

১৪

এরিয়া সেলস ম্যানেজার পদে নিয়োগ দিচ্ছে ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্স

১৫

বাংলাদেশ সি-সুইট অ্যাওয়ার্ডসের ‘সিইও অব দ্য ইয়ার ২০২৫’ সিটি ব্যাংকের মাসরুর আরেফিন

১৬

ইসরায়েলসহ মিত্রদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি, ১৭ জনের মৃত্যুদণ্ড

১৭

জাতীয় ইমাম-খতিব সম্মেলনে চরমোনাই পীর / আলেমদেরকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহারের কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না

১৮

ইপিআই টিকাকেন্দ্রে আগুন

১৯

কৃষি ব্যাংক স্টাফ কলেজে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স অনুষ্ঠিত

২০
X