শাহ আহমদ রেজা
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ এএম
আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ভাসানী

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ভাসানী

পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ উত্থাপিত বিভিন্ন দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে খাজনা-ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করা হবে জানিয়ে মওলানা ভাসানী তার বিখ্যাত ‘ঘেরাও আন্দোলন’-এর কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন।

ঘেরাও আন্দোলনের সূচনাও ঘটেছিল সেদিনই,Ñ৬ ডিসেম্বর। মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দান থেকে জনসভার মানুষকে নিয়ে গভর্নর হাউস তথা বর্তমান বঙ্গভবন ঘেরাও করেছিলেন। ঘেরাওকারী জনতার ওপর পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করাসহ প্রচণ্ড নির্যাতন চালায়। প্রতিবাদে পরদিন, ১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী ঢাকায় হরতাল আহ্বান করেন। এই হরতাল পালনকালে পুলিশের গুলিতে দুজন নিহত ও ১৬ জন আহত হওয়ায় ৮ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেন। সে হরতালও সফলভাবে পালিত হয়। মওলানা ভাসানী ১৪৪ ধারা অমান্য করে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে লক্ষাধিক মানুষকে নিয়ে শহীদদের গায়েবানা জানাজায় ইমামতি করেছিলেন।

ঘেরাও আন্দোলন অচিরেই পূর্ব পাকিস্তানের সব অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে ছিল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সূচিত সফল এই ঘেরাও আন্দোলন প্রদেশের বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত ছাত্র সমাজকেও ঐক্যবদ্ধ হতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) সমন্বয়ে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’র পক্ষ থেকে ১৪ জানুয়ারি ঘোষিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ১১ দফা। ছাত্রসমাজের কর্মসূচি হলেও ১১ দফার মধ্যে শ্রমিক-কৃষকসহ সব শ্রেণির মানুষের দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে ছিল শাসনতন্ত্র বা সংবিধান ও পররাষ্ট্রনীতিসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাব। প্রথম দফায় শিক্ষাসংক্রান্ত ১৭টি দাবি উল্লেখ করার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা দুটিতে শাসনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল।

সব শ্রেণির মানুষের কর্মসূচি হওয়ায় ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র সর্বাত্মক গণঅভ্যুত্থান ঘটতে থাকে এবং ভাসানীপন্থি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান, স্কুলছাত্র মতিউর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাসহ শতাধিক সংগ্রামীর মৃত্যু মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে আইয়ুব সরকারের ভিত্তিকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দেয়। গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে সর্বত্র মানুষ ঘেরাও-মিছিল ও ভাঙচুরের মতো কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিতে এগিয়ে আসতে থাকে। ওই দিনগুলোতে গ্রামে গ্রামে মানুষ বিডি মেম্বারদের ঘেরাও করেছে। আইয়ুবের দালাল হিসেবে পরিচিত বিডি মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে। অনেক এলাকায় তহশিল অফিসও পুড়িয়ে দিয়েছে তারা। মানুষ একই সঙ্গে খাজনা-ট্যাক্স দেওয়াও বন্ধ করেছিল।

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ১১ দফার সমর্থনে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও আন্তরিক ভূমিকা পালন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। বিরামহীন সফর, ভাষণ এবং ঘেরাও মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলেন। অভ্যুত্থান ব্যাপক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এতে ৬ দফাপন্থি আওয়ামী লীগও অংশ নিয়েছিল। কিন্তু দলটির অংশগ্রহণ এবং ১১ দফার প্রতি সমর্থন সর্বাত্মক বা প্রশ্নাতীত হতে পারেনি। এর কারণ, ১১ দফা ঘোষিত হওয়ার পরপর ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক অন্য সাতটি দলের সঙ্গে আটদলীয় জোট ‘ড্যাক’ বা ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠন করেছিল। ড্যাকের আট দফা কর্মসূচিতে সেকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় দাবি স্বায়ত্তশাসন শব্দটি পর্যন্ত ছিল না, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিও অনুপস্থিত ছিল। তা ছাড়া দুই পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাশাপাশি শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করা হয়েছিল পঞ্চম তথা (ঙ) দফায়। উল্লেখ্য, ড্যাকের শরিক দলগুলো ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলাম পার্টি, পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগ, এনডিএফ এবং জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম। পশ্চিম পাকিস্তানের ধুরন্ধর রাজনীতিক এবং শেখ মুজিববিরোধী পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগ নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানকে ড্যাকের আহ্বায়ক বানানো হয়েছিল।

গণঅভ্যুত্থানের প্রচণ্ডতায় বিপন্ন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আত্মরক্ষার কৌশল থেকে ড্যাকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তিনি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ১ ফেব্রুয়ারি। ড্যাকের পক্ষ থেকে অনুকূল সাড়া এসেছিল তাৎক্ষণিকভাবে, বন্দি নেতা শেখ মুজিবও প্যারোলে বৈঠকে যোগ দিতে সম্মতি জানিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী তাকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা। আইয়ুবের প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মওলানা ভাসানী। গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকে তিনি ‘আত্মহত্যার শামিল’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় মওলানা ভাসানী ‘চরমপত্র’ উচ্চারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজন হলে ফরাসি বিপ্লবের মতো ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করা হবে।’ মওলানা ভাসানীর এ ঘোষণায় গণঅভ্যুত্থান আরও বেগবান ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে। সেদিন হতাহত হয় অজানা সংখ্যক আন্দোলনকারী। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকারকে কারফিউ প্রত্যাহার করতে হয়। গণঅভ্যুত্থানের প্রচণ্ড চাপে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করেন, শেখ মুজিবসহ সব অভিযুক্ত মুক্তি পান। অন্য রাজনৈতিক নেতাদেরও মুক্তি দেওয়া হয়।

কিন্তু শেখ মুজিব মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই নিশ্চিত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান বিভ্রান্ত এবং স্তিমিত হতে শুরু করে। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার উদ্দেশে ‘নিশ্চিন্ত থাকার’ আহ্বান জানিয়ে মুক্তি লাভের চার দিনের মধ্যেই শেখ মুজিব আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন (২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯)। সেখানে তিনি ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন আরও পরে ১০ মার্চ। অত্যন্ত লজ্জাকর ওই ভাষণে ১১ দফার কথা উচ্চারণ করলেও শেখ মুজিব নিজের বিস্মৃতপ্রায় কর্মসূচি ৬ দফার ভিত্তিতে মূল বক্তব্য এবং বিভিন্ন প্রস্তাব উপস্থিত করেছিলেন। গোলটেবিল চলাকালে শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্তি দিয়ে গোপন সমঝোতারও প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একদিকে মওলানা ভাসানীর তীব্র বিরোধিতা এবং অন্যদিকে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে চলমান প্রচণ্ড গণঅভ্যুত্থানের চাপে এ সমঝোতা চেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায়। সংসদীয় সরকার পদ্ধতি ও প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি দিয়েও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শেষরক্ষা করতে ব্যর্থ হন। সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের কাছে তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হয়, পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো প্রবর্তিত হয় সামরিক শাসন (২৫ মার্চ, ১৯৬৯)।

আইয়ুব সরকারের পতন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ও সংসদীয় সরকার পদ্ধতির নীতিগত স্বীকৃতি আদায় ছিল ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ সাফল্য। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, বিপুল আত্মত্যাগ এবং অসম সাহসী সংগ্রাম সত্ত্বেও ১১ দফার তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মূল দাবিগুলোর কোনো একটিও অর্জিত হয়নি। আইয়ুব সরকারের দমনপীড়ন ও হত্যা এবং পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক রাজনীতিকদের অন্তর্ঘাতী তৎপরতার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনবিমুখ নীতি ও কার্যক্রম ছিল মহান সে গণঅভ্যুত্থানের ব্যর্থতার প্রধান কারণ। এ দেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শেষদিকে আন্দোলন আবর্তিত হয়েছিল প্রধানত শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিকে কেন্দ্র করে। ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা ছিল, মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিব তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিব ছাত্র-জনতাকে নিরাশ ও বিভ্রান্ত করেছিলেন। কারণ, পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সরকারের পতন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হলেও গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিব অংশ নেওয়ায় আইয়ুব খান তখনকার মতো বেঁচে গিয়েছিলেন।

(নিবন্ধটির শেষ অংশ প্রকাশ হবে আগামীকাল)

লেখক: সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আগামী ৫ দিন আবহাওয়া কেমন থাকবে, জানাল অধিদপ্তর

আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে আবারও ধাক্কা খেল বাংলাদেশ 

অর্থ আত্মসাৎ : বিএনপি নেত্রী আফরোজার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা অনুমোদন

প্লট দুর্নীতি  / শেখ হাসিনা-জয়-পুতুলের বিরুদ্ধে তিন বাদীর সাক্ষ্য শেষ

গণপিটুনিতে জামাই-শ্বশুর নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৪

ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে যুবক আটক

মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়লের প্রধান উপদেষ্টা 

ভারতে ভুয়া পুলিশের অফিসে আসল পুলিশের হানা

আমরা মরলে অর্ধেক দুনিয়া সঙ্গে নিয়ে যাব, যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান

ঘরে বসে সহজ পদ্ধতিতে কিডনির পরীক্ষা করতে পারবেন

১০

ভারতে রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আটক

১১

যুবকদের বড় সুখবর দিল সরকার

১২

ফিলিস্তিনিকে স্বীকৃতি / বাড়তি নজর কাড়ছে নিউজিল্যান্ড

১৩

মহাসড়ক বন্ধ করে নবীনবরণ অনুষ্ঠান

১৪

ওয়ানডেতে রোহিত-কোহলির খেলা নিয়ে যা বললেন গাঙ্গুলি

১৫

পল্লবী থানা হেফাজতে জনি হত্যা : দুই পুলিশ কর্মকর্তার যাবজ্জীবন দণ্ড বহাল

১৬

গানের টিজারেই ঝড় তুললেন হৃতিক আর জুনিয়র এনটিআর

১৭

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস জিনিয়াসে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সাফল্য 

১৮

মিরপুরে পিচ পরিদর্শনে হেমিং, চোখে পড়ল ‘পুঁই বাগান’

১৯

ত্বকের যেসব লক্ষণে বুঝবেন শরীরে কোলেস্টেরল বাড়ছে

২০
X