সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৪ জুন ২০২৩, ০৮:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৃষ্টিতে রাজধানীবাসীর ভোগান্তি

জনদুর্ভোগ কমাতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

জনদুর্ভোগ কমাতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

জামায়াতে ইসলামী কাগজে-কলমে একটি বৈধ রাজনৈতিক দল হলেও তারা আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির বিষবৃক্ষ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে দুধকলা দিয়ে এ কালসাপ পুষেছে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এই দলটি বাংলাদেশ চায়নি। একাত্তর সালে বেশিরভাগ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আসলে একটা জনযুদ্ধ ছিল। যারা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তাদের পাশে ছিলেন দেশের কোটি আপামর মানুষ। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন, তথ্য দিয়েছেন। এ কারণেই শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনারা জিততে পারেনি। তবে একাত্তরেও এ বাংলাদেশের কিছু মানুষ স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর ছিল। একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যেও দুটি পক্ষ ছিল। একপক্ষ নিজেদের আদর্শিক অবস্থান থেকে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। কিন্তু তারা কোনো অপরাধে জড়ায়নি বা পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা করেনি। আরেকটি পক্ষ ছিল যারা স্বাধীনতা বিরোধিতার পাশাপাশি সরাসরি পাকিস্তানি হানাদারদের পাশে থেকে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাদের সহায়তা করেছে। হত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধ করেছে। এ দ্বিতীয় পক্ষটি শুধু স্বাধীনতাবিরোধী নয়, তারা যুদ্ধাপরাধীও। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের অনেকের বিচার হয়েছে, অনেকের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। একাত্তর সালে এ যুদ্ধাপরাধীদের সাংগঠনিক আশ্রয় ছিল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ, বাংলাদেশের যার পুনরুত্থান ঘটেছে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই বিভিন্ন দণ্ড ভোগ করেছেন। ট্রাইব্যুনাল সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। আদালতের আদেশে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। তবে জনদাবি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেনি সরকার।

একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা করে, তাদের সঙ্গে মিলে যুদ্ধাপরাধ করেও ক্ষান্ত হয়নি জামায়াতে ইসলামী। বিজয়ের পরও জামায়াত নেতারা দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রাখে। তবে স্বাধীনতার পর দেশের মাটিতে জামায়াতের রাজনীতি করার সুযোগ ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে আবার ধর্ম নিয়ে রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটে। এ সুযোগে গর্তে লুকিয়ে থাকার বিষধর সাপ জামায়াতে ইসলামীও মাঠে নামে। তবে জামায়াতের চরিত্র একদমই বদলায়নি। একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘ যতটা ভয়ংকর ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্রশিবির তার চেয়ে কম ছিল না। হাত কাটা, রগ কাটার মতো নৃশংসতা ছিল ছাত্রশিবিরের ট্রেডমার্ক। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিন জোটের পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলন করে সহিংসতার পাশাপাশি নিজেদের গণতান্ত্রিক হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে জামায়াতে ইসলামী। জিয়াউর রহমানের সময়ে দেশে ফিরে আসেন জামায়াতের শীর্ষ নেতা এবং একাত্তরে তাদের যুদ্ধাপরাধের নেতা গোলাম আযম। এরশাদ পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এসে গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়। তখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে তীব্র জনমত গড়ে উঠেছিল। তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি দাবি তো মানেইনি, উল্টো জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের ২৪ সংগঠকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিয়েছিল। সেই বিএনপির সঙ্গে মিলেই ক্ষমতায় চলে আসে জামায়াতে ইসলামী। যারা একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, যুদ্ধাপরাধ করেছিল, যাদের হাতে মুক্তিকামী মানুষের রক্তের দাগ; তাদের গাড়িতেই ওড়ে শহীদের রক্তে ভেজা জাতীয় পতাকা। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ যেন নিছক বিচার নয়, জাতির গ্লানিমোচনের চেষ্টা। অনেকেই বলেছেন, আওয়ামী লীগ জানে বিএনপি-জামায়াতের ভোট এক বাক্সে জড়ো হলে তাদের নির্বাচনে জেতা সবসময়ের জন্যই কঠিন। তাই জামায়াতকে দুর্বল করতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ। ভোটের হিসাব মেলাতে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার কোনো কৌশলের অংশ নয়। এটা জাতির আকাঙ্ক্ষা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার। এটা মানতেই হবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। তাদের অধিকাংশ শীর্ষ নেতাই বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন বা শাস্তি ভোগ করেছেন। দেশি-বিদেশি নানা চাপের মুখে দীর্ঘদিনের সঙ্গী বিএনপিও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। বিপদের দিনের বন্ধুকে পাশে না পেয়ে অনেকটা একঘরে হয়ে যায় জামায়াত। কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ না হলেও জামায়াতে ইসলামী কার্যত বাংলাদেশে নিষিদ্ধই ছিল। ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির পর জামায়াতে ইসলামী আর কোনো কর্মসূচি পালনের অনুমতি পায়নি। ১০ বছর পর গত ১০ জুন শনিবার সরকারের অনুমতি নিয়ে কর্মসূচি পালনের সুযোগ পেয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এক দশক পর জামায়াতের মাঠে নামা এবং নির্বিঘ্নে কর্মসূচি পালন করতে পারা নিয়ে রাজনীতিতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অনেকেই নানা সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করছেন। জামায়াতকে মাঠে নামানো রাজনীতিতে কোনো অশনি সংকেত কি না, আলোচনা আছে তা নিয়েও। এটা ঠিক, আমরা জামায়াতে ইসলামীকে যতই অশুভ শক্তি বলি, তারা কিন্তু বাংলাদেশে নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। তাই তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুমতি দেওয়াটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ১০ বছর অনুমতি না দিয়ে সরকার এখন কেন দিচ্ছে। বাজারে অনেকরকম কথা চাউর আছে। কেউ কেউ বলছেন, জামায়াতের সঙ্গে সরকারের গোপন আঁতাত হয়েছে। বিএনপি না এলেও যাতে জামায়াত অন্য নামে হলেও আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়, এমন শর্তেই জামায়াতকে মাঠে নামার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার কারও ধারণা, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক আরও জটিল করে তুলতেই সরকার এ কৌশল নিয়েছে। কারণ ১০ বছর পর মাঠে নেমেই জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে ধরেছে। আর জামায়াতের দাবির সঙ্গে বিএনপির দাবির কোনো ভিন্নতা নেই। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, জামায়াতের মুখ দিয়ে বিএনপির কথাই বের হচ্ছে। তাই ২০ দলীয় জোট বিলুপ্তির পর বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে দূরত্বের যে ধারণা তৈরি করতে চাচ্ছে, তা হোঁচট খাবে। বাইরে যাই হোক, বিএনপি-জামায়াত যে আসলে একই, এটা প্রমাণে সরকারের সুবিধা হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আবার আগুন সন্ত্রাস করতেই জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে বিএনপি। তবে অনুমতি দিল আওয়ামী লীগ সরকার আর মাঠে নামিয়েছে বিএনপি; এ বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। অবশ্য এটা মানতেই হবে, আদর্শিকভাবে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের যতটা নৈকট্য, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তা নয়। তবে ১০ বছর পর হলেও জামায়াতকে মাঠে নামার অনুমতি দেওয়ার পেছনের আসল কারণটা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি। গত ২৪ মে ঘোষিত মার্কিন এ ভিসা নীতির ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে, এটা প্রমাণের একটা চাপ তৈরি হয়েছে সরকারের ওপর। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে গত ডিসেম্বর থেকেই জামায়াত সভা-সমাবেশের অনুমতি চেয়ে আসছিল। সেই অনুমতি পেল তারা ভিসা নীতির পর। অনুমতি না পেলেও জামায়াত খুব অখুশি হতো বলে মনে হয় না। কারণ অনুমতি না পেলেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অভিযোগ করতে পারত, দেখো বাংলাদেশে কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। আমরা বৈধ রাজনৈতিক দল হওয়ার পরও কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অনুমতি পাচ্ছি না। সরকার জামায়াতের এ ফাঁদে পা দিতে চায়নি। তাই তারা জামায়াতকে অনুমতি দিয়েছে। তবে কঠোর নজরদারির মধ্যেই ছিল দলটি। কোনো অনিয়ম করলে, সেটা সরকারের জন্য সুবিধা হতো। তারা তখন বলতে পারত, জামায়াত আসলে অপশক্তি। তারা মাঠে নামলেই সন্ত্রাস করে। আপাতত কৌশলের খেলায় দুপক্ষই জয়ী। জামায়াত নিষিদ্ধ না হলেও তারা আসলে রাজনীতির অপশক্তি। তাদের একাত্তরের ভূমিকা, সত্তর ও আশির দশকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নৃশংসতা, সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে দেশজুড়ে জামায়াতের তাণ্ডব, রাজনীতির মাঠে বিএনপিকে সামনে রেখে জামায়াতের সন্ত্রাস—মানুষ ভুলে যায়নি। তাই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করাই জনগণের দাবি। জামায়াতকে ঘুঁটি বানিয়ে খেলা, বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য শুভ কিছু বয়ে আনবে না।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বজ্রপাতে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৃত্যু

দুই বাংলাদেশি যুবককে ফেরত দিল বিএসএফ

বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী জনগণের পাশে রয়েছে : নীরব

শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা আজ

ছক্কার ঝড় তুলে ম্যাচসেরা সাইফের মুখে আত্মবিশ্বাসের কথা

আফগানদের হোয়াইটওয়াশ করে তৃপ্ত জাকের

আবারও ভারতের কাছে কুপোকাত পাকিস্তান

সাবেক যুবদল নেতার উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা সংস্কার 

আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা

কাশিয়ানীতে বিএনপির ৩১ দফার লিফলেট বিতরণ

১০

দাবি আদায়ে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চান মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও বস্তিবাসীরা

১১

নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ ১৭ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি : লায়ন ফারুক 

১২

সাইফ ঝড়ে আফগানিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করল বাংলাদেশ

১৩

আফগানদের বিরুদ্ধে জয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ

১৪

বৃষ্টিসহ আগামী ৫ দিনের পূর্বাভাস দিল আবহাওয়া অফিস

১৫

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি ও কার্টিন ইউনিভার্সিটির চুক্তি স্বাক্ষর

১৬

স্মার্ট কার্ডের সংকট কাটাতে আসছে ‘ব্ল্যাংক কার্ড’

১৭

সেই বিয়ের কথা স্বীকার করলেন পরীমনি

১৮

দুর্গোৎসবে টাইমস স্কয়ারে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের আবহ

১৯

‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ২০০৯’ সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি

২০
X