নিত্যপণ্যের মূল্য দিন দিন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কিছুতেই যেন স্থির রাখা যাচ্ছে না খাদ্যপণ্যের দাম। এক-দুদিন কমে থাকে তো তৃতীয় দিন আবার বেড়ে আগের স্থানে ফিরে যায়। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে অসহায় হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ আজ আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সংসারের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে কষ্ট হচ্ছে বেশিরভাগ ছোটখাটো চাকরিজীবীর। শ্রমজীবীদের অবস্থা আরও করুণ।
চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেলসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি পাচ্ছে বেশ কিছুকাল ধরে। দেশে উৎপাদিত কাঁচামরিচ কিছুদিন আগে প্রতি কেজি বেড়ে উঠে গেল ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায়। এখন তা কমে দেড়শ টাকায় এসেছে। শীত মৌসুমের শুরুতে বাজারে শাকসবজির সরবরাহ বাড়লেও প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে চাল, ডাল, আটার ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের প্রতিটি পরিবারে প্রতিদিন কমবেশি আটার প্রয়োজন পড়ে। হোটেল-রেস্তোরাঁয় নানা খাবার তৈরিতে আটা প্রয়োজন প্রচুর। আটার কেজি ৬০ টাকার ওপরে। বাজারে চাল প্রকারভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৯০ টাকায়। সরু চালের চেয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মোটা চালের দাম তুলনামূলক বেশি। সব রকমের ডালের দামও চড়া। সয়াবিন তেল নিয়েও কখনো চলছে অসাধু কারবার। এক লিটার খোলা ভোজ্যতেলের মূল্য ১২০-১৫০ টাকা। চিনি কেজি প্রতি ১২০-১৩০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। নিম্নবিত্তের মানুষ কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে। কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কখনো অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কর্তৃক গৃহীত নানা পদক্ষেপ তেমন কাজে আসছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব জিনিসের দাম কমে, বাংলাদেশে এর কোনো প্রভাব পড়ে না; বরং কোনো ক্ষেত্রে এর উল্টোটা হয়। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ কর তুলবে।
আলু ও পেঁয়াজ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শীর্ষে। প্রতিটি পরিবারে রান্নায় প্রতিদিন কমবেশি আলু ও পেঁয়াজ ব্যবহার হয়। ২০ টাকা কেজি পেঁয়াজের মূল্য একসময় হয়ে গেল ১০০ বা ১২০ টাকা, যা এখন সামান্য কমেছে। প্রতিটি পণ্যের এ ধরনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বাজার সিন্ডিকেট। তারা অত্যন্ত ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী। তারা যখন খুশি পণ্যের দাম বাড়িয়ে টাকা উপার্জনে মেতে ওঠেন। দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজ দেশের মানুষের চাহিদার ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ পূরণ করে থাকে। বাকি চাহিদা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে আমদানি শুল্ক এবং রেগুলেটরি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নিয়েও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক রাখতে পারেনি। আলুর বাম্পার ফলন হওয়ার পরও কম মূল্যে দীর্ঘ সময় আলু প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা ছিল, বাস্তবে তা হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ আলু পচে যাওয়ায় এবং অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মারপ্যাঁচে পড়ে আলুর দাম বেড়ে যায়। এখন বাজারে আলুর কেজি ৭০ টাকা। হিমাগারে সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় প্রতি বছর প্রচুর আলু পচে যায়। এভাবে আলুর মূল্যও দীর্ঘদিন স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয় না। দেশে প্রতি বছর আলুর চাহিদা প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টন। আবার দেশেই প্রতি বছর চাহিদার অতিরিক্ত আলু উৎপাদিত হয়। ফলে উদ্বৃত্ত আলু বিদেশে রপ্তানিও করা হয়। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, আলুই কখনো কখনো দেশে অতিরিক্ত চড়া মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। ভারত থেকে আমদানিকৃত আলু প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রির কথা থাকলে বাজারে ৬০ থেকে ৭০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। মৌসুমে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আলুর উৎপাদন কমে গেলে চাহিদার চেয়ে জোগান কম হওয়ায় দেশে আলুর দাম বৃদ্ধি পায়। আবার এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়।
মাছ-মাংসের দাম চড়া আজ। সাধারণ মানুষের পছন্দের আমিষ এককালের সহজলভ্য গরুর মাংসের কেজি ৭৫০ টাকা। খাসির মাংস হাজারের ওপরে। মাংস কেনার সংগতি হারিয়েছে নিম্নবিত্তের মানুষ। দেশে নদীর মাছের সরবরাহ কম। চাষের মাছ তেলাপিয়া বা পাঙাশের তেমন কদর নেই এখন ক্রেতার কাছে। দেশি মুরগির কেজি ৫০০ টাকার ওপরে। ব্রয়লারও ২০০ টাকা ছুঁইছুঁই। ইলিশ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে সব সময়। বছরে দুবার ইলিশ শিকার বন্ধ রেখে এর উৎপাদন বাড়লেও বাজারে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয় ১০০০ থেকে ২০০০ টাকায়। ডিমও সব সময় কম দামে পাওয়া যায় না। একবার তো ৪০ টাকা হালির ডিম ৮০ টাকা হয়ে গেল। এখনো রয়েছে ৪৮-৫০ টাকা হালি। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ডিমের হঠাৎ এমন মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে চরম বেকায়দায় ফেলে দেয়। মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি হয়ে গেল দেশ। মাত্র কদিনে অসাধু মুনাফালোভীরা হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা।
পেঁয়াজসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়েছে। নিত্যপণ্য বাজারে ওঠার আগেই একাধিকবার হাত বদল হয়। এক শ্রেণির অসাধু ফটকাবাজ বিনা পুঁজিতে কামিয়ে নেয় অর্থ। পণ্য পরিবহনের পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। এর প্রভাব পড়ে বাজার মূল্যে, ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্রেতাসাধারণ। দেশে পর্যাপ্ত চাল উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও ভর্তুকি দিয়েও চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আনা যায় না। আবার চালের দাম বেশি কমে গেলে কৃষক পড়ে যান মহাসংকটে। উৎপাদন ব্যয়ও তারা ঘরে তুলতে পারেন না। চালের বিক্রয়মূল্য দিয়েই তো দেশের কৃষক সম্প্রদায়কে তাদের জীবনের সব প্রয়োজন মেটাতে হয়। দেশে প্রধান দানাশস্য উৎপাদনে কৃষক সম্প্রদায়কে কৃষিপণ্যের আবাদে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। দিতে হবে কৃষিঋণ সহায়তা। কৃষকের কাছে কম মূল্যে যথাসময়ে পর্যাপ্ত বীজ, সার, কীটনাশক, বিদ্যুৎ ও ডিজেল পৌঁছে দিতে হবে। খাদ্যপণ্যের দাম থাকতে হবে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্রয়সীমার মধ্যে। দেশের কোটি মানুষের জন্য চালসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। ভেঙে দিতে হবে বাজার সিন্ডিকেট। অসাধু, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিতে হবে আইনগত ব্যবস্থা। দেশে পণ্য ব্যবসায়ীরা পণ্য কেনাবেচায় কোনো পাকা রসিদ রাখেন না। ফলে কত টাকা ক্রয়মূল্যের পণ্য কত টাকায় বিক্রি করে কত মুনাফা হলো, সেসবের কোনো হিসাব থাকে না। দোকানে প্রতিটি পণ্যের মূল্যতালিকা টাঙিয়ে রাখার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী তা মানেন না। ফলে বিক্রেতা যার কাছ থেকে যে দাম নিতে পারেন, তা-ই নিয়ে থাকেন। ব্যবসায়ীদের কারসাজির কাছে ভোক্তারা অসহায়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিভাগের বাজার মনিটরিংয়ে প্রায়ই এ ধরনের পরিস্থিতি লক্ষ করা যায়। মনিটরিংয়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা অসাধু ব্যবসায়ীদের কখনো জেল-জরিমানা করে থাকেন। কিন্তু বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে এর খুব একটা প্রভাব পড়ে না। মনিটরিং থেমে গেলেই বাজারমূল্য আগের অবস্থায় ফিরে আসে। মুক্তবাজার অর্থনীতির এ সময়ে নিশ্চিত করতে হবে খাদ্য নিরাপত্তা, বাড়াতে হবে কৃষি উৎপাদন। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হলে এবং বাজার ব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হলে পণ্যমূল্যে স্বস্তি ফিরে আসবে। এ ছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে ব্যবসায় নতুন, সৎ ব্যবসায়ীদের আগমনে উৎসাহিত করতে হবে। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজার তদারকি ও নজরদারি বাড়াতে হবে। বন্ধ করতে হবে বাজারে বিদ্যমান সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী