দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক ক্রান্তিকাল ছিল ১৯৪৪ সাল। এ বছর অন্যান্য অনেক দেশের পাশাপাশি ইতালিতেও নানা কারণে অভিযান চালায় হিটলার তথা জার্মান সেনাবাহিনী। এমনি এক অভিযানে ইতালির মধ্যাঞ্চল তাসকানির পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত সান্ত’আনা ডি স্ট্যাজেমা গ্রামে ১২ আগস্ট ১৯৪৪ তারিখে সংঘটিত হয় এক মর্মান্তিক গণহত্যা। এদিনে ৫৬০ জনকে হত্যা করা হয় সান্ত’আনা ডি স্ট্যাজেমা গ্রামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালি ও তার পারিপার্শ্বিক বহু এলাকায় যখন ক্রমাগত বোমাবর্ষণ হচ্ছিল, তখন ভীত গ্রামবাসী ও অসহায় কিছু মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ সমতল ভূমি ছেড়ে পাহাড়ে সান্ত’আনা ডি স্ট্যাজেমা গ্রামে আশ্রয় নেয়। পাহাড়ি এলাকা নিরাপদ ভেবে দূর-দূরান্তের অনেকেই সেই গ্রামে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে উঠেছিল।
১৯৪৪ সালের ১২ আগস্ট, শনিবার সকালে জার্মান ১৬ পাঞ্জার ডিভিশনের অধীন ৩৫ নম্বর পাঞ্জার রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন সৈন্যরা সান্ত’আনা ডি স্ট্যাজেমা গ্রামে প্রবেশ করে। একই সময়ে তাদের সঙ্গে জার্মান সৈন্যদের পোশাক পরে আরও যোগ দেয় ইতালির ৩৬ নম্বর ব্রিগাদা নেড়ার একদল প্যারামিলিটারি সৈন্য তথা রাজাকার বাহিনী। প্রথমে ওই সৈন্যরা গ্রামটি ঘিরে ফেলে এবং গ্রামে ঢোকার তিনটি রাস্তা তাদের দখলে নেয়। এরপর বিভিন্ন ঘর, গুদাম, ঘোড়া আস্তাবলসহ সব স্থাপনায় তল্লাশি করে সেখানে আশ্রয় নেওয়া ও পালিয়ে থাকা উদ্বাস্তুদের খুঁজে বের করে। পরবর্তী সময়ে তাদের দলবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে মূলত মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া মাটির নিচে থাকা ঘর বা বেজমেন্টে তাদের দলবদ্ধ করে ঢুকিয়ে এবং তাদের ওপর একের পর এক গ্রেনেড ছুড়ে বহু শরণার্থীর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
গ্রামের একটি চার্চে তখন শতাধিক গ্রামবাসী সমবেত হয়েছিল। জার্মানরা প্রথমে চার্চের ধর্মযাজককে হত্যা করে। তারপর মেশিনগানের অনবরত গুলি ঝাঁজরা করে দেয় শতাধিক গ্রামবাসীর দেহ। এই আক্রমণে ২০ দিন বয়সী শিশুসহ ১৩০ শিশুকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া নিহত হয় বহু নারী, যাদের মধ্যে ১৮ জন ছিল অন্তঃসত্ত্বা। জার্মানরা মাঠের পর মাঠভর্তি ফসল জ্বালিয়ে দেয় এবং বহু গবাদি পশু ধরে নিয়ে যায়। মাত্র তিন ঘণ্টায় সম্পূর্ণ গ্রাম যেন একটি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয় আর জার্মানরা গ্রামটির পুরোপুরি ধ্বংস নিশ্চিত করে গ্রামের বাইরে খোলা প্রান্তরে আরামে দুপুরের খাবার খেতে বসে।
এ গণহত্যার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই অভিযুক্ত ১৬ পাঞ্জার ডিভিশনের কমান্ডার ম্যাক্স সুমনের বিচার হয়। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে, নতুন করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অপরাধীদের বিচার শুরু হলে দোষীসাব্যস্ত ১১ জনকে আজীবন জেলে কাটানোর রায় দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির জড়িত থাকার প্রমাণ নষ্ট করার জন্য এ হৃদয়বিদারক ঘটনাসহ বহু ঘটন-অঘটনের প্রামাণ্য দলিল যুদ্ধ-পরবর্তী ইতালির সামরিক কর্তৃপক্ষ গায়েব করে ফেলে। ষাটের দশক পর্যন্ত এ গণহত্যা নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। ১৯৯৪ সালে হঠাৎ করেই ইতালির ‘রোম মিলিটারি কোর্ট’ এলাকার একটি ভবনের নিচে বেজমেন্টে থাকা একটি লোহার আলমারিতে ৭০০ ফাইল বা রিপোর্ট পাওয়া যায়, যা ইতিহাসের আয়নায় মানুষকে লজ্জায় ফেলে। এ আলমারিকে তাই পরবর্তীকালে ‘লজ্জার আলমারি’ (কাপবোর্ড অফ সেইম) নামে চিহ্নিত করা হয়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাকে উপজীব্য করে বহু বই লেখা হয়েছে এবং চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেন্ট আন্না স্টেজ জিমা এলাকায় ন্যাশনাল পার্ক অব পিস নির্মিত হয়েছে, যেখানে মনোরম পাহাড়ি এলাকায় প্রকৃতি, স্মৃতি ও ইতিহাসকে এক সুতোয় গাঁথা হয়েছে।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
মন্তব্য করুন