পূর্ব আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র বুরুন্ডি। দেশটিতে ৮৫ শতাংশ হুতু ও ১৪ শতাংশ টুটসি সম্প্রদায়ের বসবাস। একসময় সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেশটিকে এবং পার্শ্ববর্তী দেশ কঙ্গোকে নরকে পরিণত করে। কঙ্গোর সীমান্তবর্তী কিভু শহরে জাতিগত দাঙ্গা তীব্র আকার ধারণ করলে সেখানকার টুটসি ও বানিয়ামুলেঙ্গে গোত্রের কয়েক হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু জীবন বাঁচাতে নিজ বসতভিটা ছেড়ে পাশের দেশ বুরুন্ডির সীমান্তবর্তী গাতুম্বা শহরে স্থাপিত ‘গাতুম্বা শরণার্থী ক্যাম্পে’ আশ্রয় নেয়। ২০০৪ সালের ১৩ আগস্ট রাতে ক্যাম্পে ঘুমিয়ে ছিল এই শরণার্থীরা। এ সময় বুরুন্ডি ও কঙ্গো সীমান্তের নিকটবর্তী বুজুম্বুরা (বুরুন্ডি) শহরে ঢুকে পড়ে একদল সশস্ত্র যোদ্ধা, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ফোর্সেস ফর ন্যাশনাল লিবারেশনের (এফএনএল) সদস্য বা হুতু সম্প্রদায়ের সন্তান। এই যোদ্ধারা এদিন শহরের গাতুম্বা শরণার্থী শিবিরে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে কয়েকশ নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। আহত, নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তরা ছিল মূলত বানিয়ামুলেঙ্গে গোত্রের, যাদের সখ্য ছিল টুটসিদের সঙ্গে। ১৩ আগস্টের গণহত্যা শুধু জীবনহানিই ঘটায়নি, সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতায় আঘাত হেনেছিল। কেননা, এই আক্রমণ এমন সময়ে সংঘটিত হয়, যখন উভয়পক্ষের মধ্যে একটি শান্তি প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। বুরুন্ডি এবং কঙ্গো, উভয় দেশের মধ্যেই ক্ষমতার জন্য বিভিন্ন জাতিসত্তা, দল, উপদল ও গোষ্ঠী পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত ছিল। তাই এমন আক্রমণের বিষয়টি সব পক্ষ নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এই আক্রমণের ফলে নানামুখী সশস্ত্র সংঘর্ষের সম্ভাবনা ও তীব্রতা বেড়ে যায় এবং নিরীহ বেসামরিক লোকের জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঘটনার কিছুদিন আগেই জাতিসংঘের (ইউএন) শান্তিরক্ষা বাহিনীর সৈন্যরা ওই শহরে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু যথাসময়ে খবর না পাওয়ায় তাদের পক্ষে বেসামরিক নাগরিকদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বুরুন্ডির সশস্ত্র বাহিনীর সৈন্য এবং পুলিশও নাগরিকদের জীবন রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিল, যদিও বলা হয় তারা আক্রান্ত ক্যাম্পের কাছেই ছিল। বুরুন্ডি এবং রুয়ান্ডা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং কঙ্গোলিজ র্যালি ফর ডেমোক্রেসি-গোমা নামক সংগঠনের নেতারা সবাই মনে করেন, এই গণহত্যাটি কঙ্গো থেকে আসা একটি বৃহৎ ও সুসংগঠিত বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে আরও যোগ দেয় কঙ্গোর মাইমাই গোষ্ঠী, রুয়ান্ডার ইন্টারহামওয়ে এবং বুরুন্ডির এফএনএল দল। পরে এফএনএল হামলার দায় স্বীকার করে। একই সঙ্গে তারা দাবি করে, শরণার্থী শিবিরে তাদের শত্রুপক্ষ বানিয়ামুলেঙ্গে যোদ্ধারা আশ্রয় নেয় এবং কঙ্গোর বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এমনটি ঘটে। বুরুন্ডির সেনাবাহিনী শরণার্থী শিবিরের ভেতর থেকে গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করে বলে, বিদ্রোহীদের হামলা ইচ্ছাকৃত ছিল। কঙ্গোর কিভু অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা বানিয়ামুলেঞ্জে শরণার্থীদের দাবি, ক্যাম্পে হামলার পরিকল্পনা অনেক আগেই করা হয়েছিল এবং আক্রমণকারীরা শিবিরে স্বাক্ষরবিহীন লিফলেট পাঠিয়ে বানিয়ামুলেঞ্জে শরণার্থীদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। আনুমানিক ২০ হাজার কঙ্গো শরণার্থীর প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য বুরুন্ডিতে কঙ্গোর চারজন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও টুটসি সম্প্রদায়ের একজন সদস্যের দুদিনের সফরের পর এই হামলা হয়।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
মন্তব্য করুন