রাজনৈতিক আদর্শের কথা শুনলে অনেকে এখন হাসেন। তাদের মতে, রাজনীতি থেকে আদর্শ হারিয়ে গেছে। তাই আদর্শ নামের মূল্যবোধটির অস্তিত্ব এখন আর রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায় সাহিত্যিক রোমেনা আফাজের ‘হারানো মানিক’ উপন্যাসটি পড়েছিলাম। এখন কেন যেন রাজনৈতিক আদর্শকে ‘হারানো মানিক’ বলেই মনে হয়। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রফিক সাহেব চব্বিশ বছর পর তার হারিয়ে যাওয়া পুত্রকে খুঁজে পেলেও আমাদের দেশে রাজনৈতিক আদর্শকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। কথায় আছে, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’। যতই দিন গড়াচ্ছে, রাজনীতির আঙিনা থেকে নীতি-আদর্শ কর্পূরের মতো উধাও হয়ে যাচ্ছে। নীতি-আদর্শের জায়গা দখল করছে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসিকতা।
বিগত বছরগুলোতে আমরা একটি দলের নেতাকর্মীদের দমে দমে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন’ বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা শুনতাম। কিন্তু তাদের কাজকর্মে তার কোনো প্রতিফলন ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে অনেক সিদ্ধান্ত-পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেগুলোর কোনো কোনোটি হয়তো ভুল কিংবা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীত ছিল। তার আমলে তাই দলের কতিপয় আদর্শহীন-নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। দলীয় ওইসব নেতাকর্মীর বেপরোয়া লুটপাটের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হয়ে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘আমি সারা বিশ্ব থিকা ভিক্ষা কইরা আনি, আর চাটার দল সব চাইটা খাইয়া ফালায়।’ তবে ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কেউ করতে পারেনি; যদিও দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, ওই সময়ে যারা দুর্নীতি-লুটপাটে লিপ্ত ছিল, তাদের মুখেও শোনা যেত ‘মুজিববাদ’ কায়েমের স্লোগান। তাদের কায়কারবার দেখে ভ্রম হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল যে, দুর্নীতি-লুটপাটই বোধকরি মুজিববাদের আদর্শ।
মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা সরকারে ছিলেন সর্বমোট প্রায় একুশ বছর। প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) তার সরকারেরর মন্ত্রী, এমপি এবং দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বেশুমার অভিযোগ উঠেছিল। সারা দেশে সন্ত্রাসের গডফাদারদের নেতৃত্বে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ পরিচয়দানকারীরা লিপ্ত হয়েছিল সর্বাত্মক দুর্নীতিতে। একইভাবে সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানে যবনিকাপাত হওয়া তাদের ১৫ বছরের শাসনামল ছিল আরও ভয়াবহ। দুঃশাসনের পাশাপাশি চলেছে ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচার। অবাক কাণ্ড হলো, বক্তৃতা-বিবৃতি কিংবা টিভি টকশোয় যারা ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের’ কথা গলা চড়িয়ে বলতেন, তারাই ছিলেন তাবৎ অপকর্মের হোতা। তারা সরকারি বড় বড় প্রকল্পের অর্থ লোপাট করেন, ব্যাংক ফোকলা করে অর্থনীতিকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়েছেন, অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ অবৈধ পথেই বিদেশে রপ্তানি করেছেন। আর তা দিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ নানা দেশে করেছেন বাড়ি-গাড়ি। চট্টগ্রামের এক নেতা যিনি শেখ হাসিনার মন্ত্রী ছিলেন, ব্রিটেন, আমেরিকা, দুবাইসহ কয়েকটি দেশে কয়েকশ বাড়ির মালিক। শুধু ওই একজনই নন, হাসিনা মন্ত্রিসভার সদস্য কিংবা আওয়ামী লীগের এমপি বা নেতা, প্রায় সবারই দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ সম্পদের খবর প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যম বেরোচ্ছে। ১৫ বছরের আমলটি যেন বিদেশে টাকা পাচারের স্বর্ণযুগ ছিল। আমির হোসেন আমুর মতো ‘বঙ্গবন্ধু’র স্নেহধন্য আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে যখন নগদ টাকার খনি পাওয়া যায়, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, নেতার আদর্শকে তারা কোথায় রেখেছিলেন।
বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে সবই আছে শুধু আদর্শ ছাড়া। অথচ রাজনীতির মূলমন্ত্রই নীতি ও আদর্শ। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতি কোনো পেশা নয়, ব্রত। আর দেশপ্রেম ও জনকল্যাণের মতো মূল্যবোধ সে ব্রতের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে চিন্তাভাবনা করেন, যা একটি দলের মেনিফেস্টোতে উদ্ধৃত থাকে, সেটাই হয়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট দলের আদর্শ। এই আদর্শ বাস্তবায়নে একেক দল একেকভাবে চিন্তা করে, যাকে বলা হয় কর্মসূচি। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত সে কর্মসূচি নিয়েই দলগুলো জনগণের সামনে যায়, তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু কখনো কি কেউ শুনেছে, কোনো রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় বা নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ঘুষ-দুর্নীতির প্রসার, টেন্ডারবাজি, দখল, চাঁদাবাজিকে আদর্শ ও কর্মসূচি হিসেবে উল্লেখ করেছে? এমনটি কখনো শোনা যায়নি, ভবিষ্যতেও হয়তো শোনা যাবে না। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সরকারে যাওয়ার পর মেনিফেস্টোতে বর্ণিত আদর্শ-কর্মসূচিকে একপাশে সরিয়ে রেখে নেতাকর্মীরা ওইসব অলিখিত আদর্শকেই আঁকড়ে ধরে।
গত বছর ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনাময় দলটির কতিপয় নেতাকর্মী দেশজুড়ে যেসব ঘটনার জন্ম দিয়েছে, তা কি ওই দল বা দলটির প্রতিষ্ঠাতার আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একজন সৎ ও নীতিবান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সমাদৃত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খড়গহস্ত। নিজে দুর্নীতি করেননি, কারও দুর্নীতিকে বরদাশতও করেননি। একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করছি। ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে সফরে গিয়েছিলেন। সফরসঙ্গী হিসেবে অন্যদের সঙ্গে গিয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা খোরশেদ আলম। দেশে ফেরার সময় তিনি কিনে আনলেন একটি ভিসিআর। রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গী হিসেবে ভিভিআইপি ফ্লাইটে প্রত্যাবর্তনের সুবাদে তিনি সে ভিসিআরের আমদানি শুল্ক পরিশোধ করেননি। কয়েক দিন পর রাষ্ট্রপতি জিয়া গেছেন যশোরে। ফেরার পথে প্লেনে বসে পত্রিকায় দেখলেন যুবদল নেতার শুল্ক ফাঁকি সংক্রান্ত খবর। ঢাকায় ফিরেই তিনি ভিসিআরের শুল্ক আদায় এবং সে যুবদল নেতাকে দল থেকে চিরতরে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজ যারা ‘এক জিয়া লোকান্তরে, লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে’ স্লোগান দেন, তাদের কজন তার সততা ও দেশপ্রেমের আদর্শকে অন্তরে ধারণ করেন? জিয়াউর রহমান ছিলেন সমকালীন রাজনীতির এক আদর্শবাদী নেতা; সততা ছিল যার রাজনীতির প্রধান অলংকার। আজ কজন জিয়ার সৈনিক সে আদর্শকে লালন করেন? মৌখিক আদর্শবাদীর তো অভাব নেই। অভাব মৌলিক আদর্শবাদী নেতাকর্মীর। আর আদর্শবাদী কর্মী তারাই, যাদের কাজকর্মে প্রতিফলন ঘটে নেতার আদর্শের। রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার করে বিত্ত-বেসাত গড়ার অভিপ্রায়কে পরিত্যাগ করতে না পারলে নেতার ‘আদর্শের সৈনিক’ হিসেবে পরিচয় না দেওয়াই ভালো।
রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে আলোচনাকালে একজন প্রবীণ ব্যক্তি একদিন বলেছিলেন, ‘আদর্শ এখন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বাটখারায় বিচার্য।’ কথাটি ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন, ‘আজকাল আদর্শ পরিণত হয়েছে মুখের বুলিতে, অন্তরে এর ঠাঁই নেই। এখন বেশিরভাগ দল পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে ব্যক্তিগত লাভ-অলাভের হিসাবনিকাশের ভিত্তিতে। যে দলে গেলে বা যে আদর্শের স্লোগানে গলা মেলালে লাভবান হওয়া যাবে, সে আদর্শের কথাই শোনা যায় অনেকের মুখে।’ মিলিয়ে দেখেছি, শতভাগ সত্যি বলেছেন তিনি। অবাক হয়ে ভাবি, দীর্ঘদিন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল বা নেতার আদর্শ অনুসরণ করার পর এক লহমায় কী করে কেউ কেউ একেবারে বিপরীত আদর্শের সৈনিক হয়ে যায়!
আদর্শ পরিবর্তনের জোয়ার এসেছিল স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। জিয়ার আদর্শের রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া, শামসুল হুদা চৌধুরী, ডা. এম এ মতিন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিব আদর্শের কোরবান আলী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, বাম আদর্শের কাজী জাফর আহমদ, আনোয়ার জাহিদ, সিরাজুল হোসেন খানদের মতো বিশিষ্ট রাজনীতিকরা সব নদীর সাগরে মেশার মতো এরশাদের আদর্শের মোহনায় মিশে গিয়েছিলেন। তারা সবাই গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতন্ত্র হরণকারী স্বৈরশাসকের সঙ্গে হাত মেলাতে কসুর করেননি। তাদের এ আদর্শ পরিবর্তন যে শুধু প্রাপ্তিযোগের কারণেই সংঘটিত হয়েছিল, দেশবাসীর কাছে তা অস্পষ্ট থাকেনি।
অতিসম্প্রতি বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহী বি চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন করা ভুল ছিল বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। প্রকাশ্যে স্ব-কর্মের ভুল স্বীকার করাকে সবাই বিশেষ গুণ হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন। তবে কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে মাহী চৌধুরী ওই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, নাকি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন কোনো আদর্শকে ধারণ করার মতলবে, তা নিয়ে অনেকের সংশয় আছে। কেননা, ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাজনীতির মেঠোপথে যে পদচিহ্ন তিনি রেখেছেন, তাতে তার রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে জনমনে বিভ্রম সৃষ্টি হওয়া অসংগত নয়। পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে বিএনপি তথা জিয়ার আদর্শের ঝান্ডা হাতে নিয়ে রাজনীতি শুরু করলেও স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটায় সে আদর্শ থেকে সরে আসতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। পিতার তৈরি করা দল বিকল্পধারা নিয়ে প্রাপ্তিলাভে ব্যর্থ হয়ে এদিক-সেদিক দৌড়ঝাঁপও কম করেননি। শেষ পর্যন্ত মোক্ষলাভের আশায় স্বনিন্দিত শেখ হাসিনার পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়ে চড়ে বসেছিলেন নৌকায়। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে মধ্যরাতে ভোট ডাকাতি করে বনে গিয়েছিলেন ‘মাননীয় সংসদ সদস্য’। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, নৌকায় আরোহণের কৈফিয়ত হিসেবে বলেছিলেন, নৌকার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বহু পুরোনো। কারণ ১৯৫৪ ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার পিতামহ নৌকা মার্কা নিয়ে ইলেকশন করেছিলেন। এতদিন পর তিনি তার দাদার নৌকায় চড়েছেন। উল্লেখ্য, মাহী বি চৌধুরীর দাদা কফিলউদ্দিন চৌধুরী ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। এরপর ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ঢাকা জেলার শ্রীনগর, সিরাজদীখান ও লৌহজং থানা নিয়ে গঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আসনে কফিলউদ্দিন চৌধুরীকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। ‘দাদার নৌকায়’ নাতির এ আরোহণের পেছনে যে কোনো আদর্শিক বিষয় ছিল না, ছিল প্রাপ্তিযোগের ব্যাপার—তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকের সন্দেহ, তিনি বোধকরি নতুন কোনো প্রাপ্তিযোগের সন্ধানে আছেন।
রাজনীতির কিছু মানুষের আদর্শহীনতা সাধারণ মানুষকে এ জনহিতকর কর্মটি থেকে বিমুখ করে তুলেছে। রাজনীতি তাদের কাছে এখন কতিপয় নীতিহীন মানুষের ভাগ্য গড়ার মাধ্যম। মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ তারা যা চাক্ষুষ করে, তাই তো বিশ্বাস করবে!
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক