১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। ইসলামিক শরিয়াহ মোতাবেক ব্যাংকিং লেনদেন পরিচালনা এবং কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তন, এই দুই দর্শন নিয়ে বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থায় সর্বপ্রথম এই ব্যাংকের যাত্রা ছিল একটি আলোকিত অধ্যায়।
পর্যায়ক্রমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এই ব্যাংকের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হিসেবে, আমানতকারী হিসেবে, বিনিয়োগ গ্রাহক হিসেবে, বিশেষ গ্রাহক হিসেবে (ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক ব্যাংকিং প্রয়োজনে) এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। পাশাপাশি ইসলামিক শরিয়াহ মোতাবেক ব্যাংকিং লেনদেন পরিচালনা করতে দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে ও গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। শরিয়াহ কমপ্লায়েন্স মনিটরিং করার জন্য অভ্যন্তরীণভাবে শরিয়াহ মনিটরিং এবং এক্সটার্নাল শরিয়াহ কমিটির মাধ্যমে মনিটরিংয়ের সিস্টেম ডেভেলপ করে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সাধারণত খুব কমই রক্ষা হয়। ইসলামী ব্যাংক প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে লভ্যাংশ প্রদান করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় ও সচেষ্ট হয়। ইসলামী ব্যাংকের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রি করেও ক্যাপিটাল গেইন করার সুযোগ পায়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, গ্রাহক, প্রবাসে রেমিট্যান্স যোদ্ধাসহ সব প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারদের ভালোবাসা এবং আনুগত্য, এ ব্যাংকটিকে একসময় স্থান করে দেয় ‘ইসলামী ব্যাংক আমার ব্যাংক’ হিসেবে।
এ ব্যাংকটি বাংলাদেশের বেস্ট ব্যাংক, বেস্ট ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন হিসেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেকবার অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। ১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম এ ব্যাংকটি গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন থেকে বেস্ট ব্যাংক অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। এই ধারা চলতে থাকে ২০০০, ২০০৪, ২০০৫ এবং ২০০৮-১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশের বেস্ট ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন হিসেবে অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। যে দুই দর্শন নিয়ে এ ব্যাংকটি শুরু করে, তা বাস্তবে রূপদান করতে চেষ্টার সাক্ষর রেখে বাংলাদেশের এক নম্বর ব্যাংক হয়ে ওঠে, ইসলামী ব্যাংক।
এ ব্যাংকটির পদচিহ্ন অনুসরণ করে বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থায় আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। অনেক নতুন ইসলামিক ব্যাংক বাজারে আসে, অনেক নন-ইসলামিক ব্যাংক ইসলামিক ব্যাংক হিসেবে পরিবর্তিত হয়, অনেক নন-ইসলামিক ব্যাংক, ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো বা শাখা চালু করে। শুধু তাই নয়, ব্যাংকিং সেক্টর ছেড়ে গিয়ে ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স, ইসলামিক ফাইন্যান্স, ইসলামিক সিকিউরিটিসসহ আরও অনেক ইসলামিক বিজনেস যুক্ত হয় বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থায়। এমনকি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও ইসলামিক শরিয়াহ ইনডেক্স (DSES) চালু করে ইসলামিক কোম্পানিগুলোকে নিয়ে। এ ব্যাপক পরিবর্তনের অংশীদার বা কৃতিত্ব পায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি।
ইসলামিক ব্যাংকিং ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে শুধু এই ব্যাংক নয়, অন্যান্য ইসলামিক ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনের এমপ্লয়িজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ বা ট্রেনিং এবং গবেষণার সুযোগ করে। ইসলামিক ব্যাংক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মেডিকেল কলেজ, হসপিটাল, স্কুল-কলেজসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের মানুষের কল্যাণের কাজে সবসময় ছিল অগ্রণী। তবে এমপ্লয়িজদের কম্পেটিটিভ ওয়েলফেয়ার (বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা) প্রদান, পরিবেশগত দায়বদ্ধতা এবং শরিয়াহ নিয়মনীতি যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে কিছু প্রশ্ন সমাজের মানুষের কাছে ছিল এবং এখনো আছে।
২০১৭ সালে এ ব্যাংকটির মালিকানায়, পরিচালনায়, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। ডেইলি স্টারের একটি সংবাদে যাকে বলা হয় বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে একটা ‘perfect robbery’ বা নিখুঁত ডাকাতি। মূল দর্শন থেকে ছিটকে পড়ে এ ব্যাংকটি। সেই থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটি পত্রিকায় শিরোনাম হয় কখনো ঋণখেলাপিদের আঁতুড়ঘর হিসেবে, কখনো আর্থিকভাবে দুর্বল হিসেবে, কখনো সুশাসনবিহীন ব্যাংক হিসেবে। ২০১৭ সালের ধাক্কায় বা পরিকল্পনায় শুধু এ ব্যাংকটি নয়, সব ইসলামিক ব্যাংকগুলোই হয়ে যায় বা করা হয় দুর্বল ব্যাংক।
একটি বেস্ট ব্যাংক কীভাবে দুর্বল হয়ে গেল, কীভাবে দখল বা পুনর্দখলের খেলায় জড়িয়ে গেল, তা ব্যাংকিংয়ের ছাত্র না হয়েও অতি সহজে মানুষ বুঝতে সক্ষম হয়। এমনকি ৫ আগস্টের পর দিবালোকে এ ব্যাংকটিতে দ্বিতীয়বার ‘নিখুঁত ডাকাতি’ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন? শুধুই কি সাধারণ মানুষের গচ্ছিত টাকা নিয়ে যাওয়া বা স্থাবর সম্পদ দখল করার জন্য? যদি তাই হয় তাহলে ষাটের বেশি ব্যাংক বাংলাদেশে আছে, সেই ব্যাংকগুলোতে একই তরিকায় আক্রমণ হয় না কেন? রাজনীতির মাঠে, অর্থনীতিতে, এ ব্যাংকটিকে দখল নিতে বা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে অনেক পক্ষের বাসনা থাকে বা দেখা যায়। মূলত ইসলামিক ব্যাংকিং বা ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করা, মানুষের কাছে এই কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে আস্থার সংকট তৈরি করা এবং তার অগ্রগতি ব্যাহত করাই প্রধানতম কারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব রেগুলেটরের অর্থবহ ভূমিকা রাখতে পারলে এ ব্যাংক দখল সংস্কৃতি আশকারা পায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব রেগুলেটর, পুনর্গঠিত পরিচালনা বোর্ড, শরিয়াহ বোর্ড, ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং সব জনবলের দায়িত্ব হবে এ ব্যাংকটিকে অন্যায়ভাবে দখল করার সুযোগ থেকে বিরত রাখতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। কারও কোলে ফিরিয়ে না দিয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করে ভিশন এবং মিশন রিসেট করা কীভাবে এ ব্যাংকটি একটি নতুন মডেল হবে: (১) সুশাসন প্রতিষ্ঠায়, (২) সম্পূর্ণ শরিয়াহ গাইডলাইনস মেনে চলায় (৩) এমপ্লয়িদের বেতন এবং তাদের অন্যান্য কল্যাণ সাধনে এবং (৪) সামাজিক এবং পরিবেশগত দায়বদ্ধ একটি কল্যাণমুখী ব্যাংক হিসেবে। আর তাতেই নিহিত আছে বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকিং সেক্টরের ভবিষ্যৎ।
লেখক: সিপিএ। সহকারী অধ্যাপক, RMIT ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া