দেশের পুরো বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট দীর্ঘদিনের একটি বহুল উচ্চারিত শব্দ। মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমে খবর, নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কয়েকটি করপোরেট কোম্পানি অল্প কয়েক দিনের মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। কারা বা কোন কোন শিল্প গ্রুপ এসব চক্রের সঙ্গে জড়িত, তা প্রায় সর্বজনবিদিত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সরকারসংশ্লিষ্ট বা বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকা দায়িত্বশীল জায়গা—এমনকি খোদ দেশের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও নানা তোড়জোড়, হাঁকডাক বা হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও আজও প্রতিকার সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিঃসন্দেহে হতাশার।
সিন্ডিকেটের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) একটি অভিযোগে। শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা অভিযোগ করেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে করপোরেট কোম্পানিগুলো মুরগির বাচ্চা ও ফিড বিক্রি করে বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করছে। তাদের মতে, বাজারের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে থাকায় কমছে না ডিম-মুরগির দাম। যতদিন পর্যন্ত সরকার এ সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাজারে স্বস্তি আসবে না।
আসন্ন রমজান সামনে রেখে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ১২ জানুয়ারি থেকে রাজধানীর ২০টি পয়েন্ট ও পর্যায়ক্রমে ১০০ পয়েন্টে ন্যায্যমূল্যে ডিম-মুরগি বিক্রি করা হবে। স্মার্ট বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব পয়েন্টে সীমিত লাভে ডিম, ফ্রোজেন মুরগি এবং অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি শুরু হতে যাচ্ছে। এতে বিপিএর সাপ্লাই চেইনে দক্ষ ব্যক্তি ও উদ্যোক্তা যুক্ত হবেন। সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ, বিশ্ববাজারে ফিডের দাম কমেছে, কিন্তু দেশের বাজারে কমছে না। এতে প্রভাব পড়ছে মুরগির দামে। সরকারের নীতিনির্ধারণী বৈঠকে প্রান্তিক খামারিদের রাখার আহ্বান জানান তারা। প্রান্তিক খামারিরা ডিম ও মুরগির দাম সহনীয় রাখতে সরকারকে সহযোগিতা করতে চান বলে তারা উল্লেখ করেন। এটা ভালো দিক। গুটিকয় করপোরেট কোম্পানিকে দায়ী করে বিপিএ নেতারা সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে সরকারি হস্তক্ষেপের দাবির পাশাপাশি বাজারে স্বস্তি আনতে পোলট্রি বোর্ড গঠনসহ ১০ দফা দাবি জানান।
বিগত বিভিন্ন সরকারের সময় শুধু নয়; সম্প্রতি দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন একটি অভ্যুত্থান ঘটে গেল। কত ছাত্র-জনতার প্রাণ ঝরল। নতুন করে আশার সঞ্চার হলো—এবার বুঝি দুষ্কৃতকারীদের হুঁশ হবে। কিন্তু না। আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও বাজারে দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য থামেনি। অতিসম্প্রতি ডিমের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ পকেটে পুরল বিশেষ কয়েকটি শিল্পীগোষ্ঠী। সংগতকারণেই প্রশ্ন, এ চক্রের হাত থেকে কি পরিত্রাণ নেই? তাদের কি বিনাশ নেই! এখনো ডিমের বাজারে চলছে অস্থিরতা। এ ডিম সাধারণ, শ্রমজীবী মানুষের অল্প খরচে ব্যাপক পরিমাণে পুষ্টি চাহিদা মেটায়। আমরা জানি, হাতেগোনা কয়েকটি শিল্প গ্রুপ তাদের সিন্ডিকেট শক্তিশালী করতে যে নানামুখী তৎপরতা চালায়, তার একটি হচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক বা খামারিদের আর্থিক সহযোগিতা করে এক ধরনের জিম্মিদশায় ফেলা। ফলে তারা এ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য দিতে বাধ্য থাকে। আর এ গোষ্ঠী তাদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের দুষ্টচিন্তায় তাড়িত হয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। সরকারসংশ্লিষ্টদের আমরা বলতে চাই, সাধারণ খামারিরা যেন জিম্মিদশা থেকে বের হতে পারে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। সর্বোপরি পুরো বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগের ব্যাপারে তৎপর হবে।