নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে।।
৩ মাঘ। শ্রী পঞ্চমী। শীতের সকালে শ্বেত বা বাসন্তী শাড়িতে অথবা শাস্ত্রানুগ শুদ্ধ পোশাকে বিদ্যার জন্য সনাতন ধর্মচারী আবালবৃদ্ধবনিতার প্রার্থনা। মনুষ্যত্বের জ্ঞানভান্ডারের সাধনা। ব্রহ্মাণ্ডের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সাধনা। মানবিক পৃথিবী গড়ার প্রচেষ্টা। এসবই অপার্থিব সম্পদ। তারই সন্ধানে ব্রতী সবাই। জ্ঞান, শিল্পকলা, ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের প্রতিভূ দেবী সরস্বতী। তার কাছে সনাতনী ভক্তদের সাংবাৎসরিক শুদ্ধতম নিবেদন, সশ্রদ্ধ যাচনা।
শ্বেতবরণ অঙ্গ, হাতে বীণা, বাহন রাজহাঁস, সাদা পদ্মফুলের আসন। তার ডানহাতে বরাভয় মুদ্রা। তিনি অভয়দাত্রী। বিদ্যা, জ্ঞান ও সংস্কৃতির পথযাত্রার তিনি দিকনির্দেশক। তিনি বাগদেবী সরস্বতী। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয়। এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যথা: অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শীষ। পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়।
পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার পূর্বে কুল (বড়ই) খাননা। এর সপক্ষে পৌরাণিক কারণ রয়েছে। পূজার দিন কিছু পূজারির লেখালেখির বারণ। কারণ দেবীর কাছে বই, খাতা ইত্যাদি আশীর্বাদ লাভের জন্য পুজোর দিন সমর্পিত থাকে। পুজোর উপাসনার পর দিনটি ফাঁকা থাকে বিধায় দুপুর থেকে শিশুরা ঘুড়ি ওড়ায় এই দিন। আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিক্ষা- সংস্কৃতির সঙ্গে ক্রীড়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে নিবিড়ভাবে। এই দিন সনাতনী শিশুদের হাতেখড়ি দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু হয়।
পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদনের জন্য শুদ্ধবস্ত্র পরিহিত বিদ্যার্থী ও সব বয়সের পূজারিরা উপবাস অনুশীলন করে দেবীর করকমলে অঞ্জলি নিবেদনের জন্য অধীর আগ্রহে পূজা মণ্ডপে উপাসনায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। পুরোহিত শাস্ত্রসম্মত বিধি অনুযায়ী পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। পূজা শেষে উপস্থিত পূজারিরা চন্দন চর্চিত পুষ্প, বিল্বপত্র সহযোগে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে দেবীকে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করে তার আশীর্বাণী প্রার্থনা করেন।
হলুদ রংকে একই সঙ্গে বাসন্তী রংও বলা হয়ে থাকে। বসন্ত পঞ্চমী থেকেই শীতকালের শেষ ও বসন্তকালের শুরু। প্রকৃতিতেও তার আঁচ মেলে শ্রী পঞ্চমীর প্রভাতে। বাস্তুমতে হলুদ রঙের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সবার জীবনে একেকটি রঙের একেক রকমের প্রভাব রয়েছে। হলুদ রং যে কোনো ব্যক্তির অন্তরের আত্মাকে শান্ত রাখে এবং নিয়ন্ত্রিত রাখে। শুধু তাই নয়, বাস্তুমতে হলুদ রঙের অর্থ কোনো কিছুর নতুন সূচনা। এটি আশার রং হিসেবেও পরিচিত। হলুদ রং শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীকও। পূজার পরদিন চিড়া ও দইমিশ্রিত করে দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়। এরপর পূজা সমাপ্ত হয়। সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।
দেবী সরস্বতী একসময়ে শুধু বিদ্যার দেবী রূপেই পরিচিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন জীবনদায়িনী নদীরূপে পরিচিত; তিনি ছিলেন অন্নদায়িনী, এমনকি শত্রুবিনাশিনী রূপেও পরিচিত! পুরাণে কথিত আছে, পৃথিবী সৃষ্টির পর সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা দেখেন তাকে ছাড়া প্রায় সব দেবদেবীর পুজো হয় মর্ত্যে। তাদের তীর্থস্থানও আছে। শুধু নেই তার কোনো মন্দির। কোথায় ব্রহ্মাতীর্থ করা যায় সেই নিয়ে চিন্তায় পড়েন সৃষ্টিকর্তা। সেই লক্ষ্যেই ‘সর্বরত্নময়ী শিলা’ ছুড়ে দেন বসুন্ধরার বুকে। সেই শিলা এসে পড়ে চমৎকারপুর নামে একটি স্থানে। জায়গা তো পাওয়া গেল, কিন্তু সেখানে নিত্যপূজার জন্য দরকার নদী। তখনই দেবী সরস্বতীকে সেই জায়গায় যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু নদীর সঙ্গে বিদ্যার দেবীর কী সম্পর্ক? চলমান জ্ঞানের জন্য দেবীকে নদীরূপেও কল্পনা করা হয়। হিমালয়ের সিমুর পর্বতে তার উৎপত্তি। সেখান থেকে হরিয়ানার আম্বালা জেলায় সমতলভূমিতে নদীরূপে অবতরণ করেন দেবী।
কিন্তু এখানেও সমস্যা। দেবী গঙ্গার অভিশাপে পাঁচ হাজার বছর ধরে নদী হিসেবে থাকতে বাধ্য হন সরস্বতী। কিন্তু মর্ত্যে তিনি বিরাজ করতে পারবেন না। লোকজনের স্পর্শে তার ভয়। সমস্যার সমাধান করেন ব্রহ্মা। চমৎকারপুরে পাতাললোকের সঙ্গে যুক্ত একটি হ্রদ খনন করেন তিনি। সেখানেই দেবী সরস্বতী বিরাজ করতে শুরু করেন অন্তঃসলিলা হয়ে।
সরস শব্দের অর্থ জল। শুধু জলযুক্ত বলেই দেবীর নাম সরস্বতী তা নয়, বৈদিক যুগের প্রথমে পুণ্যসলিলা সরস্বতী প্রধান এবং সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী হিসেবেও গণ্য ছিলেন। নদী হিসেবে গঙ্গা বা যমুনার প্রাধান্য তখনো এখনকার মতো স্বীকৃত হয়নি। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের অন্তর্গত সিমুর পর্বতে। এর তীরে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের নাম ছিল সারস্বত যজ্ঞ। সেই সময়ে এই নদীর জলে পিতৃতর্পণ বিহিত ছিল।
সরস শব্দের আরও একটি অর্থ জ্যোতি। সূর্যরশ্মির তিনটি রূপ ইরা, ভারতী ও সরস্বতীর একত্রিত রূপ হলো সরস্বতী। ইনি ত্রিলোকের সর্বত্র সূর্যতেজের স্ত্রীশক্তি। ইনি স্বর্গ-মর্ত্যকে দীপ্তি দ্বারা ব্যাপ্ত করে বিরাজমান। এ কারণে সনাতন ধর্মের অপৌরুষেয় শীর্ষ ধর্মগ্রন্থ বেদে জ্যোতিরূপা সরস্বতীর উদ্দেশে অনেক শ্লোক উৎসর্গ করা হয়েছে।
দেবী সরস্বতীকে এখন আমরা প্রধানত বিদ্যাদায়িনী ও সংস্কৃতি প্রণোদিনী হিসেবে বন্দনা করি। কিন্তু বৈদিক যুগে আরও অনেক গুণের জন্য তিনি আরাধ্য ছিলেন। ‘প্রণো দেবী সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী’—তিনি বাজিনীবতী অর্থাৎ অন্নদায়িনী। সূর্যরশ্মির সাহায্যে জল মেঘরূপে বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। পৃথিবী শস্যশালিনী হয়। এভাবেই দেবী সরস্বতী কৃষি ও পশুবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে অন্নদাত্রী হয়ে ওঠেন। ঋষিদের বারবার প্রার্থনার উপজীব্য তাই সরস্বতী যেন তাদের ধন দান করেন। নদী সরস্বতীর জলে সিক্ত উর্বর মাটিতে আর্যদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। নদীর জল তাদের বাণিজ্যিক সম্পদেও বৈভবশালী করেছিল। তাই দেবী উপাসিত হলেন ধনদাত্রী হিসেবেও। পরবর্তীকালেও তাই সরস্বতীর এই গুণের কথা মুছে যায়নি। তন্ত্রশাস্ত্রে দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তার কাছে ঐশ্বর্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
তিনি দানবদলনীও বটে। যে ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আর্যসভ্যতার বিকাশ, সেখানে নদী সরস্বতী প্রাকৃতিকভাবেই প্রহরীরূপে বিরাজিত ছিলেন। তাই আত্মরক্ষার জন্য আর্যরা সরস্বতীর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। পৌরাণিক যুগেও দেবীর এই শত্রুদলনী রূপটি বর্তমান ছিল। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বলা হয়েছে, ‘সরস্বতীমনুভজে শুম্ভাদিদৈত্যার্দিনীম্।’ তার শক্তিরূপ সরস্বতী দেবী হিসেবেও প্রতিভাত।
সূর্যের তেজরূপা হওয়ার দরুন সূর্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্য তাকেই দান করা হয়েছিল। শত্রুদলনী এই দেবীর চিকিৎসক হিসেবেও ভূমিকা রয়েছে। এই কারণে তাকে সূর্য, ইন্দ্র, মরুৎ ও দেবচিকিৎসক অশ্বিনীকুমারদের সঙ্গে কল্পনা করা হয়েছে। ব্রহ্মা, পুরাণানুসারে বেদকে ধারণ করেছিলেন। জ্ঞানের উৎস এই বেদ, তাই ব্রহ্মার সঙ্গে যুক্ত হলেন সরস্বতী বা সাবিত্রী।
সাম্প্রতিককালে দেবী সরস্বতীকে আমরা সবচেয়ে বেশি আরাধনা করি বিদ্যার ও জ্ঞানের দেবী হিসেবে। পরবর্তী বৈদিক যুগে সরস্বতীর অন্য পরিচয় ছাপিয়ে কেবলমাত্র বাগদেবী হিসেবে স্বীকৃতা হলেন। অথর্ব বেদে ও ব্রাহ্মণে তিনি বাগরূপা। ‘বাক হি সরস্বতী / বাক বৈ সরস্বতী।’ তিনি যজ্ঞরূপাও। এই হিসেবে এখন থেকে তিনি ব্রহ্মা বা বৃহস্পতির স্ত্রী বলে মান্যা হলেন।
বিখ্যাত তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সমস্ত শাস্ত্র ঘেঁটে সরস্বতীর যে ছয়টি ধ্যানমন্ত্রের উল্লেখ করেছেন, তাতে দেবীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ১) তাকে তুলনা করা হয়েছে কুন্দ, চন্দ্র ও তুষার অর্থাৎ বরফের সঙ্গে। মানে তার বর্ণ এদের মতো শুভ্র; সঙ্গে তার পোশাক সাদা, তিনি বসে আছেন সাদা পদ্মফুলের ওপর। এমনকি তার বাহনও শ্বেতহংস। ২) বেশিরভাগ জায়গায় তিনি চতুর্ভুজা, পদ্ম, বীণা, বই, অক্ষমালা, কমণ্ডলু ও বরাভয় মুদ্রায় তাকে সাজানো হয়েছে। ৩) তিনি ত্রিনয়নী। তবে এই তন্ত্রশাস্ত্রেই তাকে দ্বিভুজা বলেও দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলাদেশ সন্নিহিত অঞ্চলে তিনি দ্বিভুজা রূপে পূজিত হন।
জয় জয় দেবি। চরাচর সারে।
কুচযুগ শোভিত মুক্তা হারে ।।
বীণা পুস্তক রঞ্জিত হস্তে।
ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তুতে।।
বিশ্ব চরাচরের শান্তি, স্বস্তি, সামাজিক উন্নতি অব্যাহত রক্ষার জ্ঞানদায়িনী, আনন্দ প্রদায়িনী বীণা, পুস্তকধারী বরাভয় দানকারী ভগবতী দেবী সরস্বতীকে বিনীত প্রণাম। ওঁ তৎ সৎ।
লেখক: ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কমিটির উপদেষ্টা পুরোহিত; সম্পাদক জয় বাবা লোকনাথ পঞ্জিকা এবং অতিরিক্ত সচিব (অব.)