সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৪৭ এএম
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঐতিহাসিক, তবে কোন অর্থে?

ঐতিহাসিক, তবে কোন অর্থে?

বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন ঐতিহাসিক অবশ্যই; কিন্তু কোন অর্থে? সে কি শুধু এই একক অর্থে যে, অত্যন্ত বড় ও রক্তাক্ত এবং অতিশয় তাৎপর্যমণ্ডিত এক ঘটনা ঘটেছিল বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে? সেই অর্থেও নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই একক অর্থে নয়। ঐতিহাসিক আরও এক দিক দিয়ে; এবং সেইটাই প্রধান দিক।

ভাষা আন্দোলনকে একই সঙ্গে লড়তে হয়েছে দুয়ের বিরুদ্ধে। সংস্কৃতিকে চেয়েছে মুক্ত করতে সামন্তবাদের শান্ত কিন্তু কঠিন অবরোধ থেকে, এবং উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুর লুণ্ঠনাভিলাষের আবেষ্টন থেকে। এই আন্দোলনকে যখন বলা হয় সাইনবোর্ড বদলানোর, টাইপ-রাইটার ভাঙার এবং অফিস-আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলার হুকুম নামাদি রচনা করার আন্দোলন, তখন দেখি আবার সেই সামন্তবাদী সামান্যতা ও সংকীর্ণতাতেই প্রত্যাবর্তনের ছদ্মবেশী প্রচেষ্টা চলছে। প্রসারতা আসছে একটু, ইংরেজির জায়গায় বাংলা আসছে, কিন্তু সামান্যতা ও সংকীর্ণতা থাকছে। সামন্ততন্ত্রের জগৎটা ছোট্ট ও আত্মসন্তুষ্ট, সেই খর্বাকৃতি ও আত্মসন্তুষ্ট জগতে যদি আমরা ফিরে যাই তবে ভাষা আন্দোলনের বৈপ্লবিক শক্তিকেই খাটো করে আনব আমরা। বাংলা প্রচলন গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই, কিন্তু সেটা মূল লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার নিগড় ভেঙে, সাম্রাজ্যবাদী আবেষ্টনকে ভূলুণ্ঠিত করে এগিয়ে যাওয়া, উৎপাদন ব্যবস্থায় ও উৎপাদন সম্পর্কে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যাতে মেহনতি মানুষের মুক্তি ঘটে, দারিদ্র্য দূর হয়, এবং একটা নতুন জগৎ গড়ে ওঠে পুরাতন ও অমানবিক জগতের ধ্বংসস্তূপের ওপরে। অতটাই সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা এই আন্দোলনের।

যদি এভাবে না দেখি তবে সেই না-দেখার কারণটাও সাংস্কৃতিক। এ কথা সত্য যে, ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের একাংশের অসন্তোষের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আন্দোলন সেখানে থেমে থাকেনি। জনসাধারণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়েছে, এবং যে-নতুন মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছিল বায়ান্ন সালে তা-ই পরে বিকশিত হয়ে পর্যায়ক্রমিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। দুঃখের বিষয় যেটি তা হচ্ছে, এই অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে সাংস্কৃতিক চেতনা অগ্রসর হয়নি।

আমাদের লোক-সংস্কৃতির দুর্বলতাগুলো সামন্ত-সংস্কৃতির বিশিষ্ট চরিত্রলক্ষণ। বস্তুত একই মানসিকতা বিস্তৃত উভয় ক্ষেত্রে। এবং আমরা, শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা দূরে নই এই মানসিকতা থেকে। এ মানসিকতাই নিয়ামক শক্তি আমাদের, আধুনিকতা বহিরারোপিত পোশাক মাত্র। সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিতে স্থবিরতা আছে, আছে আলস্য, উদ্যমহীনতা। সে-সংস্কৃতি সংকীর্ণ ও আত্মসন্তুষ্ট। গভীরভাবে অদৃষ্টবাদী। নীচের মানুষ উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, সকল সম্পর্কই প্রভু-ভৃত্যের। গ্রাম্য বীরপূজা তথা পৌত্তলিকতা, এবং সংস্কারাচ্ছন্ন আধ্যাত্মিকতা তার কেন্দ্রে প্রোথিত। অকিঞ্চনের সামান্য আয়োজন সেই সংস্কৃতি।

পুঁজিবাদী আধুনিকতা এমনিতে এই মানসিকতার বিরুদ্ধপক্ষ। সে উৎকেন্দ্রিক; তুচ্ছ জ্ঞান করে দেশীয় প্রথা ও অভ্যাসকে, অবজ্ঞা করে—ঘৃণাও। দেশের মধ্যে ভালো দেখতে পায় না কিছু, কিছুই হবে না বলে এদেশের, বলে চরিত্র খারাপ এদেশের মানুষের—ভীষণভাবে। এই আধুনিকতা নিজে উৎপাদন করে না, ভোগ করে, এবং সুযোগ খোঁজে কী কী সুবিধা পাওয়া যায় দেশে এবং কখন কীভাবে যাওয়া যায় বিদেশে। এই আধুনিকতাও অতিশয় সামান্যই। কিন্তু শুধু সামান্যতাতেই ঐক্য নয় উভয়ের, প্রকৃত ঐক্য—আগেই উল্লেখ করেছি—উভয়ের গণবিরোধিতায়।

যখন চরিত্র ঠিক নেই মানুষের বলে অভিযোগ করা হয় তখন সত্য কথা ও মিথ্যা কথা বলা হয় একই সঙ্গে। সত্য কথা এইদিক দিয়ে যে, সত্যি চরিত্র ঠিক নেই সুবিধাভোগকারী মধ্যবিত্তের। আবার সেটা মিথ্যা কথা এই জন্য যে, চরিত্রে ত্রুটি নেই জনসাধারণের। যত প্রকার অনাচার তা সুবিধাভোগীরাই করেন, তাদের সমাজ নোংরামির দ্বারা আচ্ছন্ন। সামাজিক আয়নায় তারা নিজেদের চেহারাই দেখেন শুধু, এবং নিজেদেরকেই সমাজের একমাত্র সত্য বলে মনে করেন যেহেতু, তাই চরিত্রহীনতা ভিন্ন অন্যকিছু দেখতে পান না। অথচ জনসাধারণ চরিত্রশক্তির পরিচয় দিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। তারাই চালু রেখেছেন উৎপাদন ব্যবস্থা, সচল রেখেছেন সামাজিক যন্ত্র। বিশেষ করে যখন সংকট আসে বড় তখন সাধারণ মানুষের মানবিক, পরিশ্রমী, ভীতিহীন গুণগুলো এমনভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে যার সামনে সুবিধাভোগীদের চরিত্রকে মনে হয় বিপরীতের আদর্শ উদাহরণ। যেমন সংকট এসেছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। সাধারণ মানুষের চরিত্রশক্তি সেদিন পরীক্ষিত হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা মূলত তাদের কারণেই এসেছে। কিন্তু যখন স্বাধীন হলো দেশ, দেখা গেল নেতারা ফিরে আসছেন তাদের নিরাপদ আশ্রয় থেকে, সেইসঙ্গে আসছে তাদের সঙ্গী-সাথিরা। তখন শুরু হলো লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতা, স্বাধীনভাবে, পূর্ণোদ্যমে। এই তৎপরতাই তাদের প্রধান কর্তব্য, কখনো গোপনে করেন, সুযোগ পেলে প্রকাশ্যে। জনসাধারণের উৎপাদন তারা নির্বিচারে ভোগ করেন এবং বলেন—চরিত্র ঠিক নেই এদেশের মানুষের।

তারা হতাশা পোষণ করেন দেশের ভবিষ্যৎ বিষয়ে, কেননা তারা নিজেদেরই দেখেন শুধু, এবং নিজেদের মধ্যে আশাব্যঞ্জক কোনো কিছুই দেখতে পান না। জনসাধারণের অসামান্য শক্তিকে, সেই শক্তির অসম্ভব-সাধন ক্ষমতাকে তারা পাশ কাটিয়ে যান, চোখে পড়লেও দেখতে চান না কিছুতেই। সেই শক্তিকে গোপনে তারা ভয়ও করেন।

সবচেয়ে ক্ষতির কথা এই হতাশাকে তারা প্রচার করেন দেশবাসীর মধ্যে, বিভিন্ন মাধ্যমের ভেতর দিয়ে। মাধ্যমগুলো তাদের করতলগত—প্রচারমাধ্যমগুলো যেমন, সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোও তেমনি। যাদের গণমাধ্যম বলা হয় তারা আসলে প্রচারমাধ্যম ভিন্ন অন্যকিছু নয়। যখন যে-সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন তার ক্ষমতায় থাকার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা এদের প্রধান দায়িত্ব। এবং সরকার যেহেতু বিশেষ শ্রেণির, তাই প্রচার মাধ্যমগুলো বিশেষ শ্রেণির পক্ষে, এবং অনিবার্য প্রতিফল হিসেবে জনসাধারণের বিরুদ্ধে, বলে। মাধ্যমগুলোর আসল চরিত্র ধরা পড়ে দেশে যখন বড় রকমের রাজনৈতিক পরিবর্তনের মুহূর্ত এগিয়ে আসে সেই মুহূর্তে। তখন খবর দেওয়া নয়, খবর লুকিয়ে রাখা, বরং যা ঘটছে তার উল্টোটা প্রচার করার দায়িত্ব এদের নিতে হয়। খবরের অভাবে গোটা দেশ তখন গুজবের জলাভূমিতে পরিণত হয়। তারপর পরিবর্তন ঘটে গেলে দেখা যায় গতকালকের সব চেয়ে বড় দুষ্কৃতকারী আজকের সব চেয়ে বড় জননেতায় পরিণত হয়েছেন। প্রচারমাধ্যমগুলো নতুন শাসনকর্তাদের পক্ষে বলতে থাকে সেই একই ভাষায়, একই পদ্ধতিতে, একই কণ্ঠে। শুধু দেখা যায় নামগুলো বদলে গেছে, অথবা অদলবদল হয়েছে। পরিবর্তনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই পর্যন্তই, নামের রদবদল শুধু। এমনকি শব্দগুলোও বদলায় না, সেই একই শব্দ ভেসে আসতে থাকে বেতারে, সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে। পূর্বলিখিত নাটকে প্রথাসিদ্ধ অভিনয় দেখা যায়।

পরিবর্তন যে ব্যাপক ও গভীর হয় না তার কারণ অবশ্য পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় না। ঘটনা যে ঘটবে, সে যে আসন্ন এমন কোনো লক্ষণ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। পরিবর্তনের পক্ষে তর্ক, বিতর্ক, মত, রচনা কোথাও দেখা যায় না; বরং বেতার, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমগুলোকে লক্ষ্য করলে মনে হবে কোনো পরিবর্তনই হবে না—আজ নয়, কোনোদিনই নয়। তবু পরিবর্তন হয়। সাধারণ মানুষ এগিয়ে যান সংস্কৃতিসেবীদের পেছনে ফেলে। তারপর ঘটনা ঘটে। ঘটার পরে সংস্কৃতিসেবীরা তৎপর হন, বলেন, ঘটবে যে আগেই তারা জানতেন। এবং ঘটনার ব্যাখ্যা দেন নিজেদের মতো করে, ঘটনা পাছে আরও এগিয়ে যায়, গিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত সুযোগ-সুবিধাগুলোকে বিপর্যস্ত করে দেয় সেই আতঙ্কে ঘটনাকে ধরে রাখতে চান যেখানে ঘটেছে সেখানেই। তাদের প্রধান অভিলাষ থাকে নতুন পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করা, নিজেদের সুযোগ-সুবিধাগুলোকে আরও সুবিস্তৃত ও সুদৃঢ় করা।

সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোও প্রচারমাধ্যমেই আসলে। সুবিধাভোগকারী শ্রেণির মানসিকতাকেই গোলামের মতো বিশ্বস্ততায় প্রচার করে তারা। এই শ্রেণির মানুষরাও সমাজকে ভয় করেন, কেননা সমাজ মানুষের শত্রুপক্ষ, সে আশ্রয় দেয় না, সুযোগ পেলেই নিরাশ্রয় করে। বৈরী সমাজের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার লক্ষ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধি করার প্রাণপণ চেষ্টা চলতে থাকে অব্যাহত। অথচ সমাজ পরিবর্তন করলে, সমাজকে মানুষের মিত্রপক্ষ হিসেবে গড়ে তুললে, এক কথায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করলে যে ভয় দূর হতে পারে মানুষের, মানুষে মানুষে শত্রুতা দূর হতে পারে—এই সত্যটি প্রচার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না এই শ্রেণি। বরং ভয় পান সকল মানুষের সমান সুযোগ স্বীকৃত হলে সকলেই গরিব হয়ে পড়বে, সীমিত সম্পদে বহু মানুষের ভাগাভাগিতে কারও ভাগে কিছু পড়বে না। কিন্তু সত্য বিপরীত প্রান্তবর্তী। সত্য এই যে, সকল মানুষের সমান সুযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধিত হবে। দেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে আবদ্ধ উৎপাদন শক্তিকে মুক্ত করা। সমাজতন্ত্রকে ভয় করা হয় আরও একটি কল্পিত কারণে। সে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার ভীতি। অথচ প্রকৃত আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সমাজতান্ত্রিক সমাজেই সম্ভবপর। কেননা সেখানে মানুষ মানুষের শত্রু নয়, পরস্পর পরস্পরের মিত্র, একের স্বার্থ অপরের স্বার্থের বিরোধী নয়, পরিপূরক। সমাজতন্ত্রভীতি সংস্কৃতির সকল এলাকাতেই সুপ্রতিষ্ঠিত, অবাধে প্রবাহিত এবং সূক্ষ্মভাবে প্রচারিত। সেই কারণে সাংস্কৃতিক উদ্যমসমূহ জনবিরোধী, পরিবর্তনভীরু ও প্রতিক্রিয়াশীল।

যেমন ধরা যাক, শিক্ষার ক্ষেত্র। সংস্কৃতিতে শিক্ষার স্থান ও গুরুত্ব সর্বাধিক। প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিক্রিয়ার উৎফুল্ল প্রজননভূমি। শিক্ষা তারাই অধিক পায় যারা বিত্তবান। শিক্ষার মাধ্যমে তারা দক্ষতা অর্জন করে, নিজেদের শ্রেণিস্বার্থকে

দৃঢ়তর করবার জন্য। উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সুবিধাভোগীদের জন্যই প্রশস্ত। নিম্নবিত্তরা আসে বটে, কিন্তু বড়লোকের ঘরে দরিদ্র ঘরজামাইয়ের মতো তারা দাসে পরিণত হয়, ব্যবস্থার দাস, ব্যবস্থার পরিবর্তন তারা চায়ও না, আনার শক্তিও রাখে না। শিক্ষা বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করছে মানুষে মানুষে, স্বার্থসচেতনতার সৃষ্টি করছে। সৃষ্টি করছে কৃত্রিম আধুনিকতার।

সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলাতেও একই তৎপরতা। এমনিতেই এ সকল মাধ্যমের মধ্যে আলস্যের প্রশ্রয় থাকে, তদুপরি যখন এরা মাধ্যম হয় অলসশ্রেণির হাতে তখন তাদের পক্ষে সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল না-হয়ে উপায় থাকে না। সাহিত্যে, সংগীতে, চিত্রকলায় বিবেক, আবেগ ও ঐক্যের স্থান দেখি সংক্ষিপ্ত, কেননা এরা অল্প ক’জন মানুষের হাতে সৃষ্ট, অল্প কিছু মানুষের উপভোগের প্রয়োজনে। শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করার সুপ্ত অভিপ্রায় শিল্পীকে বিবেকবান হতে দেয় না, আবেগকে তিনি ভয় করেন, তিনি ঐক্য চান না সকল মানুষের। এ সকল ক্ষেত্রে যে-আধুনিকতা এসেছে তা এদের উৎকেন্দ্রিক করছে, দেশের প্রবহমান জীবনধারা ও শুভবুদ্ধির সঙ্গে সংযুক্ত না-করে। যেভাবে বন্ধু-বান্ধবেরা একত্র হয়ে ফিল্ম ক্লাব গড়েন বিদেশি ফিল্ম দেখবেন বলে এবং প্রচার করেন নিজেদের সুখ সমগ্র দেশবাসীর সুখ বলে, সেভাবেই সংস্কৃতির চর্চা—চলছে দেশে। নাটক হচ্ছে বলে হৈচৈ শোনা যায়, অথচ দেখা যায় অল্প ক’জন লোক দেখছেন নাটক, ঘুরে ঘুরে তারাই। তারা স্রষ্টা, তারাই দর্শক।

সামন্ততান্ত্রিক সনাতনপন্থা ও পুঁজিবাদী আধুনিকতার মধ্যে যে গোপন আঁতাত আছে তা বোঝা যায় সমাজে মেয়েদের স্থান নিরূপণের ব্যাপারে উভয়ের ঐক্য দেখলে। পুঁজিবাদ নারীকে সর্বপ্রকার স্বাধীনতা দিয়েছে বলে আস্ফালন করে। অথচ ব্যাপার একই, উভয় ক্ষেত্রে। মেয়েদের জড়পিণ্ড বলে গণ্য করা হয় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায়, দামি ও সচল পুতুল বলে গণ্য করা হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়। ওইটুকুই তফাত। কিন্তু উভয় ব্যবস্থাই অমানবিক। জড়পিণ্ড যেমন মানুষ নয়, সচল পুতুলও তেমনি মানুষ নয়। নারীমুক্তি এদেশে ঘটেনি, নারীর অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, গৃহাভ্যন্তর থেকে তাকে কোথাও কোথাও এনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে প্রদর্শনীর প্রাঙ্গণে।

মোট কথাটা এই যে, পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ—এ দুই শত্রুকে পরাস্ত করতে না পারলে সংস্কৃতির মুক্তি নেই। সংস্কৃতি কেবল উপরকাঠামো নয়, এ ভেতরের ব্যাপারও বটে। মূল কাঠামোতে পরিবর্তনের জন্য আবশ্যক মানসিকতা সৃষ্টি করার কাজে। চেতনাকে উন্নততর স্তরে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব শুধু কিছু সংস্কৃতিসেবীর নয়, সকলেরই। সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ও পরিবর্তন ভিন্ন বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পরিবর্তন আসবে না, এলেও টিকবে না। মনের জগৎটাকে অন্ধকারে রেখে সামাজিক জগতে বিদ্যুৎশক্তি আনতে পারব না আমরা। চেষ্টা করলে পণ্ডশ্রম ঘটবে।

সংস্কৃতির গুরুত্ব এত বেশি বলেই তথাকথিত সংস্কৃতিসেবীদের হাতে একে ছেড়ে দেওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। সংস্কৃতিকে মুক্ত করার সমবেত দায়িত্ব সকল প্রগতিশীল মানুষের।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক, ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত

সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্রের সভাপতি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নারায়ণগঞ্জে বিআরটিএ কার্যালয়ে ছদ্মবেশে দুদকের অভিযান, যা মিলল

সীমান্তবর্তী ১০ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অমিত শাহর জরুরি বৈঠক

বাংলাদেশে ৬৬ ভারতীয়কে অবৈধভাবে ঠেলে দিল বিএসএফ

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিয়ে এনসিপির বিবৃতি 

ফ্যাক্ট-চেক / ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংসের ভিডিওটি পুরোনো

ভারতের হামলায় জইশ-প্রধান মাসুদ আজহারের ১০ স্বজন নিহত

সরকারি চালসহ গ্রেপ্তার সেই বিএনপি নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি

মিথ্যা মামলা করায় বাদীকে শাস্তি, আসামি খালাস 

মিয়ানমারের সেনা-বিজিপি সদস্যসহ ৪০ নাগরিককে ফেরত

প্রাভা হেলথে নতুন সিওও ডা. সিমীন এম আখতার

১০

ক্যারিয়ার সেরা অবস্থানে মিরাজ

১১

পাক-ভারত উত্তেজনার মাঝে পিএসএল নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাল পিসিবি

১২

ভারতকে জবাব দেওয়ার অনুমতি পেল পাকিস্তান সেনাবাহিনী

১৩

জবিতে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের উন্নয়নে প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত

১৪

বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটির উপাচার্যকে অব্যাহতি 

১৫

নিজেদের পদ ফিরে পেতে চান উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা

১৬

ইউরোপে বৃত্তি ও যৌথ গবেষণায় ইইউর সহযোগিতা চাইল ইউজিসি

১৭

শেখ হাসিনাকে হাজির হতে বলেছে দুদক

১৮

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হলেন রেজাউল করিম মল্লিক

১৯

মাকে স্বাগত জানানো সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন তারেক রহমান

২০
X