বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার ভাষিক উন্নয়নে সহায়ক প্রায়োগিকতা পরিকল্পনা বলতে মূলত দেশে ও বিদেশে বিদেশিদের মধ্যে দাপ্তরিক ও সামাজিক সাংজ্ঞাপনিক কার্যক্রম এবং বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের প্রচলন পরিকল্পনাকে বোঝায়। নিম্নে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রায়োগিকতা পরিকল্পনার একটি বর্ণনা নিম্নে তুলে ধরা হলো: দাপ্তরিক ও সামাজিক সাংজ্ঞাপনিক কাজে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রায়োগিকতা পরিকল্পনা বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাপ্তরিক ও সামাজিক সাংজ্ঞাপনিক কার্যক্রমে গ্রহণযোগ্যতার মতো বাংলা ভাষার আঞ্চলিক বিস্তৃতি ও ভাষিক শক্তিমত্তা যথেষ্ট নয়। আবার বাংলা ভাষার ধারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তিও যথেষ্ট নয়। কিন্তু বাংলা ভাষার বিশ্রুতি ও ভাষিক জনসংখ্যা ইত্যাদি মানদণ্ডে বাংলা ভাষার সীমিত ভাষিক শক্তিমত্তা কাজে লাগিয়ে বিদেশি হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে। এ ভাষাকে বিদেশি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
১. বাংলাদেশে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম ইত্যাদি রাজ্য হলো বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল। রাষ্ট্রীয় সীমানা অতিক্রম করে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যকার যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে, এ ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সেজন্য রাষ্ট্রীয় সীমানা অতিক্রম করে, উভয় রাষ্ট্রের জনগণ ও রাজ্য প্রশাসনের মধ্যকার বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা প্রয়োজন।
২. বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও বিদ্যায়তনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে ইংরেজি ভাষাকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশে দূতাবাসের সামাজিক ও দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিপ্রতীপ দেশের রাষ্ট্র ভাষা ও বাংলা ভাষাকে বিকল্প ভাষা হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বিদেশি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে দূতাবাসগুলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। দূতাবাসগুলো এসব অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র ও বিজ্ঞপ্তির ভাষা সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বিদেশি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পারে।
৩. পররাষ্ট্রনৈতিক, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অন্য দেশের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কোনো মন্ত্রীর নেতৃত্বে যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, তা মূলত ইংরেজি ভাষা মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ ধরনের আলোচনায় চীন ও জাপানের উদাহরণকে বিবেচনায় নিয়ে প্রতিনিধিদলের নেতার বক্তব্য বাংলা ভাষা এবং সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় দেওয়ার রেওয়াজ চালু হলে, বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রায়োগিকতা পরিকল্পনাবিশ্বের নানা দেশে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পঠনপাঠন এবং গবেষণা চলছে। তার মধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম হলো চীনের গুয়াংজু বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাপানে টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশের উচ্চবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার পঠনপাঠন চলছে। বাংলাদেশেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ইনস্টিটিউট ও ব্র্যাক ভাষা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার পঠনপাঠন ও চর্চা চলছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানেও বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। সেজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে, বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রায়োগিকতা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। নিম্নে বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রায়োগিকতা পরিকল্পনায় নিম্নোল্লিখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন:
১. বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার শিক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ নামক একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
২. বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের সুবিধার্থে গবেষক (research fellow) ও অভ্যাগত অধ্যাপক (visiting professor) পদ সৃষ্টি করে তাদের বৃত্তিসহ আমন্ত্রণ জানানো প্রয়োজন।
৩. বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে বাংলা ভাষা শিক্ষা সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
৪. বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শীত ও গ্রীষ্মকালীন ছুটির সঙ্গে মিল রেখে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য তিন সপ্তাহব্যাপী শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন আবাসিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন।
৫. বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
৬. বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক ভাষাগত দক্ষতা পরীক্ষা প্রণয়ন এবং তা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
৭. বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার পাঠ্যবই প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণ করা প্রয়োজন এবং
৮. প্রতি বছর বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা প্রয়োজন।
বাজার অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রচলন পরিকল্পনা আমরা জানি যে, বাজার অর্থনীতির যুগে বাংলাদেশের বাজারে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পণ্য আমদানি ও বাজারজাত করা হয়। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, কোরিয়া, জাপান, রাশিয়া, ভারত, জার্মান, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব ইত্যাদি।
বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রায়োগিকতাকে বিস্তৃতকরণে বাংলাদেশের বাজারে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে পণ্যের গায়ে, পণ্যের মোড়কে ও পণ্যের বিজ্ঞাপনে পণ্যের নাম, বর্ণনা ও পরিচিতি সম্পর্কিত তথ্য বাংলা ভাষায় উৎকীর্ণকরণে বাধ্যতা আরোপ করা প্রয়োজন। এ বাধ্যতা আরোপ, পণ্যের উৎস দেশে বাংলা ভাষার প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং সেজন্য সেসব উৎস দেশে বাংলা ভাষাভাষী কর্মশক্তির চাহিদা সৃষ্টি হবে। এ চাহিদা পূরণে পণ্যের উৎস দেশসমূহে বাংলাদেশি বাংলা ভাষাভাষী অথবা বাংলা ভাষায় দক্ষ পণ্যের উৎস দেশীয় কর্মীদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তার প্রভাবে সেসব দেশে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষায় দক্ষ জনশক্তি সৃজনে সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠবে। কার্যত এ প্রক্রিয়া বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার বিস্তারে সহায়ক হবে। ফলে বাংলা ভাষার শক্তিমত্তা বৃদ্ধি পাবে। বাংলা ভাষার বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। সেজন্য বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রায়োগিকতা পরিকল্পনায় বাংলাদেশের বাজারে বিদেশি পণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে পণ্যের গায়ে, পণ্যের মোড়কে ও পণ্যের বিজ্ঞাপনে পণ্যের নাম, বর্ণনা ও পরিচিতি সম্পর্কিত তথ্য বাংলা ভাষায় উৎকীর্ণকরণে বাধ্যতা আরোপ করা প্রয়োজন।
বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষায় আন্তর্জাতিক ভাষাগত দক্ষতা পরীক্ষা প্রবর্তন পরিকল্পনা আরবি, ফারসি, চীনা, জাপানি, জার্মান, স্পেনীয় ও ফরাসি ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি ভাষায় শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতা নিরূপণে সহায়ক ভাষাগত দক্ষতা পরীক্ষা চালু রয়েছে। এ পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা ভাষাগত দক্ষতা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের ভাষাগত দক্ষতা সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং এ ভাষাগত দক্ষতা অনুযায়ী তারা শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। আমরা জানি যে, কোনো ভাষার ভাষাগত দক্ষতা পরীক্ষা হলো ভাষিক দক্ষতা পরিমাপকবিশেষ। এ দক্ষতা পরিমাপক অনুযায়ী ভাষা শিক্ষার্থীর ভাষাগত দক্ষতা বাচন, শ্রবণ, লিখন ও পঠন—এ চার ভাগে বিভক্ত। শিক্ষার্থীদের এ ভাষাগত দক্ষতা প্রারম্ভিক, প্রাথমিক, প্রাক-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, উচ্চতর ক্রমোচ্চ—এই ছয় ধাপে বিভক্ত।
বাংলা ভাষা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি ভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করা সত্ত্বেও, বাংলা ভাষার ভাষিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কোনো ভাষা পরিকল্পনা গৃহীত না হওয়ায়, বাংলাদেশ সরকার বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার ভাষিক দক্ষতা পরীক্ষা চালু করেনি। তবে বাংলা ভাষার ধারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বাংলা ভাষার চর্চার অন্যতম প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট পারস্পরিক সহায়তায় বাংলা ভাষার ভাষিক দক্ষতা পরীক্ষা প্রণয়ন ও চালু করতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার ভাষিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে। ফলে ভাষিক শক্তিমত্তার সূচকে বাংলা ভাষা এগিয়ে যাবে।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়