মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কার প্রস্তাব ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার

সংস্কার প্রস্তাব ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার

বর্তমান বাংলাদেশে সংস্কার প্রস্তাব এক বহুল আলোচিত ইস্যু। রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গে গোটা দেশ আলোচনায় মুখর। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, টকশো, সভা, সেমিনার, চায়ের টেবিলসহ সর্বত্র চলছে সংস্কারবিষয়ক পর্যালোচনা। মানুষ চায় রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারসাধন। সম্প্রতি দেশে সংঘটিত হয়েছে গণআন্দোলন, যা বিপ্লবে পরিণত হয়। ফলে বিবিধ সংস্কার প্রস্তাবনার উদ্ভব। ‘জুলাই গণবিপ্লব-২০২৪’ নামে এ আন্দোলন দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হিসেবে বিবেচিত। শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটার অবসান চায়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোটা সংস্কারকরণের দাবিতেই জুলাই গণআন্দোলনের সূচনা। এ আন্দোলনে দেশের ছাত্র, শিক্ষক ও সর্বস্তরের জনতা অংশগ্রহণ করে। একপর্যায়ে গোটা জাতি শুধু কোটা সংস্কার নয়, বরং গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়। পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট সরকারের। পরবর্তীকালে দাবি ওঠে রাষ্ট্র সংস্কারের এবং গঠিত বিবিধ কমিশন। যথা—জনপ্রশাসন সংস্কার, সংবিধান সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, বিচার বিভাগের সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার, সাংবিধানিক সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সংস্কার, গণমাধ্যম সংস্কার, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার, নারীবিষয়ক সংস্কার ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার ইত্যাদি।

বিশ্বব্যাপী সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয় ষোড়শ শতকে ইউরোপে। তদসময়ে দার্শনিক মার্টিন লুথার গির্জার সংস্কার সাধন ও ধর্মতত্ত্বের পুনর্বিশ্লেষণের জন্য প্রোটেস্টান রিফরমেশন মুভমেন্টের নেতৃত্ব প্রদান করেন। জার্মানির আইজলবেন শহরে (১৪৮৩-১৫৪৬) জন্মগ্রহণকারী মার্টিন লুথার ছিলেন বাল্যকাল থেকে ধর্মানুরাগী। তিনি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে অগাস্টিনীয় সম্প্রদায়ে যোগ দেন এবং ১৫১১ খ্রিষ্টাব্দ সম্প্রদায়ের কাজে রোম সফর করেন। সেখানে তিনি গির্জার কর্মকর্তাদের জীবনপ্রণালি প্রত্যক্ষ করে বিস্মিত ও মর্মাহত হন। মার্টিন লুথার অনুভব করেন, বিধাতার সঙ্গে ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। এ সম্পর্কের জন্য পোপের মাধ্যম অনুসরণ করা অপ্রাসঙ্গিক। ক্যাথলিক গির্জা উচ্চতর কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাজাকে নিয়ন্ত্রণ, গির্জার হাতে রক্ষিত ভূসম্পত্তি ও অন্যান্য সম্পদের নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যক্তি বিবেকের স্বাধীনতাসহ বিবিধ বিষয় বিবেচনায় তিনি গির্জাভিত্তিক সংস্কারে ব্রতী হন। মার্টিন লুথারের সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম ফসল ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ প্রবর্তন, ইউরোপে ধর্মীয় গোঁড়ামির অবসান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যপূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

জনগণ অনেক সময় সংগ্রাম, প্রতিবাদ কিংবা বিক্ষুব্ধ আচরণ করে। কিন্তু মানুষ কেন আন্দোলনে জড়িয়ে যায়? কেন উত্তেজিত হয়? অন্যতম কারণ অসম রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা। মানুষ রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত বস্তুতে সমঅধিকার চায়। মানুষ যদি লক্ষ করে শুধু স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাতে রাষ্ট্রের সম্পদ, খ্যাতি ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত; তবে মানুষ সংক্ষুব্ধ হয় এবং চতুর্দিকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শুরু হয় গণআন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থান ঘটে। কিন্তু কেন গণঅভ্যুত্থান! যদি কোনো শাসক অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণের হাতিয়ার হিসেবে ‘পেশিশক্তি’কে প্রাধান্য দেয় এবং অসৎ নেতৃত্বের জন্য জনগণকে প্রতিপক্ষ মনে করে, তবেই গণঅভ্যুত্থান। তখন জনতা প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিক্ষোভ ও সহিংস আচরণ করে। মূলত সামাজিক অসমতা হতেই সব সংগ্রামের উৎপত্তি। রাষ্ট্রের সীমিত সম্পদ ও বণ্টন ব্যবস্থার অনিবার্য ফল হচ্ছে সামাজিক অসমতা। এ অবস্থায় নাগরিকরা বৈষম্যের শিকার হয় এবং পদমর্যাদা, সম্পদ অর্জন, সুযোগ প্রাপ্তি ও আন্তঃসুসম্পর্ক শুধু কতিপয় ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে সমাজব্যবস্থায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

জনগণ ক্ষমতার উৎস। জুলাই গণআন্দোলন যার অন্যতম প্রমাণ। এ আন্দোলনে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের দৈন্যদশার বহিঃপ্রকাশ। জনতাকে ধোঁকা দিয়ে বারবার অসচ্ছ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা অধিগ্রহণ করে এবং এরূপ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মূলভিত্তি কূটকৌশল, অগণতান্ত্রিক চর্চা ও অবৈধ অর্থ প্রবাহ। যে প্রক্রিয়ায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সমাবেশের, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা এবং অবাধ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ হতে বঞ্চিত হয়। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা ভোটের ক্যাম্পিং থেকে বিরত হয়ে দলীয় নমিনেশন সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রার্থীরা চান দলীয় প্রতীক এবং নিশ্চিত নির্বাচিত হওয়ার গ্যারান্টি। তারা হাইভোল্টেজ নেতাদের কাছে বড় অঙ্কের প্যাকেজ নিয়ে হাজির হন। ভেঙে পড়ে যায় দেশের নির্বাচনব্যবস্থা। বিতাড়িত হন ত্যাগী নেতারা। লোভী, মজুতদার ও অসৎ ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটে। প্রতিনিধিত্বহীন সমাজে বঞ্চিত ও অধিকারহারা জনতা উন্মাদ হয়ে সহিংসতায় লিপ্ত হয়। যার নেতৃত্বে থাকে ছাত্রসমাজ। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে পেশাজীবী, শিক্ষক, জনতা, রাজনৈতিক দলসহ সবাই।

দেশের চলমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলো এখন ঐক্যবদ্ধ। প্রত্যেক দলের অভিন্ন দাবি, কোনো অপশক্তি যেন জনগণের অধিকার হরণ করতে না পারে। দলগুলো রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার সাধনের প্রস্তাব সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা হিসেবে ৩১-দফা সংবলিত সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম সংবিধান সংস্কার, সমন্বিত রাষ্ট্রসত্তা গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা ইত্যাদি। আবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ৪১ দফা সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মূল লক্ষ্য—নাগরিকের অধিকার, কল্যাণ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়। যার অন্যতম লক্ষ্য একটি আদর্শ কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠন করা।

মানবতার ধর্ম ইসলাম। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। মহান আল্লাহ বিশ্বমানবতার কল্যাণ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নবী-রাসুলদের দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। এ বিষয়ে সুরা হাদিদের ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহর ঘোষণা—আমি রাসুলগণকে পাঠিয়েছি, বাইয়্যেনাহ দিয়েছি, মিজান দিয়েছি, কিতাব দিয়েছি। সব বিধিবিধান, ভালোমন্দ মাপার মানদণ্ডসহ সব দিয়েছি। কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র আল-কোরআনে সুরা হজের সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করেছেন। সুরা হজের ৪১ নম্বর আয়াতে যাদের পৃথিবীর ওপর ক্ষমতাবান করা হবে এবং রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্বে যারা আসবে তাদের মৌলিক দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আল-কোরআনের এ আয়াতে মহান আল্লাহ প্রিয় নবীর শানে ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য চারটি নির্দেশনা প্রদান করেন। যথা—১. নাগরিক চরিত্র গঠন করা। যাহা দৈনিক পাঁচবার সালাত কায়েমের মাধ্যমে সম্ভব; ২. জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি ও অর্থব্যবস্থা চালু করা, যাতে মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলো রাষ্ট্র পূরণ করতে পারে; ৩. সব ভালো কাজগুলো চালু করা; ৪. সব অকল্যাণকর কাজগুলো বন্ধ করে দেওয়া। একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহান আল্লাহর নির্দেশনা ও মহানবীর আদর্শ অনুসরণ করা প্রয়োজন।

একটি দেশে জনগণ স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চায়। রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান—নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। রাষ্ট্রের উপাদানগুলোর মধ্যে আন্তঃসমন্বয় জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। যার মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং জবাবদিহিমূলক নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে পারে। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অবাধ নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া পরিচালনা করা অসম্ভব। জনপ্রতিনিধিত্বহীনতা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিপর্যয় ডেকে আনে। জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ করতে পারে, যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে সরকার ও জনগণের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। কল্যাণরাষ্ট্র ব্যবস্থায় দেশে নাগরিক মর্যাদা ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি আদর্শ কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হোক সবার অঙ্গীকার।

লেখক: অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসবো একাডেমি, আগারগাঁও

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘ভুল চিকিৎসায়’ একদিনে দুই শিশুর মৃত্যু

সরকারি কর্মচারীদের জন্য সুখবর

কাভার্ডভ্যানের চাপায় মা-মেয়ের মৃত্যু

মাস্ক পরে হাসপাতালে দীপু মনি

ছাত্র সংসদের দাবিতে ‘আমরণ অনশন’ ঘিরে বিভক্ত বেরোবির শিক্ষার্থীরা

বন্ধুত্ব চাইলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করুন : লায়ন ফারুক

গাজা সীমান্তে ৪০ হাজার সেনা মোতায়েন করল মিসর

জাজিরা হাসপাতালে দুদকের অভিযান, অনিয়মে জর্জরিত স্বাস্থ্যসেবা

ডেজার সভাপতি প্রকৌশলী রুহুল আলম, সম্পাদক প্রকৌশলী চুন্নু

নানা আয়োজনে গাকৃবিতে মৎস্য সপ্তাহ উদযাপন

১০

বিপিএলের ফিক্সিং ইস্যুতে সতর্ক অবস্থানে তামিম

১১

রাকসু নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু বুধবার

১২

এবার সিলেটের উৎমাছড়া থেকে ২ লাখ ঘনফুট পাথর জব্দ

১৩

জমি রেকর্ড সংশোধনের মামলা দায়েরের শেষ সময় সেপ্টেম্বরে

১৪

পায়ের ফাঁকে বালিশ দিয়ে ঘুমালে কী হয়, জানেন কি?

১৫

জামায়াতের মুখে সংস্কার, হাস্যকর বিষয় : সোহেল

১৬

লবণ বেশি খেলে কী ঘটে শরীরে? জানালেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞ

১৭

গণতন্ত্রকামী দলগুলোর দূরত্ব তৈরি হলে ফ্যাসিবাদ সুযোগ নেবে : তারেক রহমান

১৮

বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টার

১৯

স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে ক্ষমা চাইতে হবে : এনসিপি নেতা ডা. জাহিদুল

২০
X