দেশের বৃহত্তর এলাকার আনাচে-কানাচে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরন্তর যেসব দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর খুব সামান্যই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও সমাজের অন্যরা জানতে পারছে কিংবা সেসব তাদের সবার দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাচ্ছে। আর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাওয়া গ্রামীণ জনপদের এ ধরনের কিছু লুটপাট ও নিধনযজ্ঞের আওতাধীন উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বন, বন্যপ্রাণী ও জলাশয় নিধন। স্বাধীনতা-উত্তর গত সাড়ে পাঁচ দশকের ব্যবধানে এ ক্ষেত্রে যা যা ঘটেছে, তার ক্রমপুঞ্জিত পরিমাণকে একত্রিত করলে দেখা যাবে যে, তা সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনীতির শ্বেতপত্রে চিহ্নিত দুর্নীতির পরিমাণকেও ছাড়িয়ে গেছে। এমতাবস্থায়, দেশের অর্থনীতি ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত বলে মনে করি।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান বনাঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে সুন্দরবন, ভাওয়ালের গড়, মধুপুরের গড়, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, শেরপুর, নিঝুম দ্বীপ ইত্যাদি এলাকার বনাঞ্চল। এ বনগুলোর সম্মিলিত আয়তন কত, সে বিষয়ে বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়। ফলে কোন পরিমাণটি সঠিক তথ্যের সবচেয়ে কাছাকাছি, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা খুবই মুশকিল। তবে বিভিন্ন সূত্রের তথ্য সমন্বয় করে মোটামুটিভাবে এটুকু বলা যেতে পারে যে, ওই বনাঞ্চলগুলোর আয়তন ১৯৭২ সালের তুলনায় অন্তত ৫০ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে, যা শুধু উদ্বেগজনকই নয়; বরং দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য চরম বিপজ্জনক এক হুমকিও বটে। বন বিনাশের এ ভয়ংকর প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী এক দশকের ব্যবধানে উল্লিখিত বনাঞ্চলগুলোর আয়তন ১৯৭২ সালের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশেরও নিচে নেমে আসার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্যও চরম বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বন থেকে সংগোপনে টুকটাক কাঠ কেটে নিয়ে আসার প্রবণতা এ দেশে স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকেই ছিল। তবে সে পরিমাণ কখনোই এখনকার মতো এত ধ্বংসাত্মক পর্যায়ের ছিল না। ধ্বংসাত্মক মাত্রায় বন উজাড়ের মহাযজ্ঞ বস্তুত শুরু হয় ১৯৯০-উত্তর রাজনৈতিক সরকারগুলোর যাত্রা শুরুর সময় থেকে এবং এরপর থেকে সময় যত এগিয়েছে, ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রাও ততই বেড়েছে। আর তা বাড়তে বাড়তে ২০১০ সালে এসে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিদ্যুৎকেন্দ্র (রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র) স্থাপনের মধ্য দিয়ে, তা এতটাই ভয়ংকর আকার ধারণ করে যে, সে অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য তৎকালীন সরকারকে জাতীয় সংসদে অগ্রিম দায়মুক্তি আইন পাস করতে হয়। তা, বন নিধনের এ কাজটি শুধু যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমেই ঘটেছে, তা নয়। নানা রাষ্ট্রীয় স্থাপনা গড়ে তোলা এবং ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয় ও সমর্থনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবৈধ দখলদারিত্বের আওতায়ও দেদার ঘটেছে। তবে অধিকতর হতাশার বিষয় এই যে, বিগত রাজনৈতিক সরকারের পতনের পর অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরও অবৈধ দখলদারিত্বের এ ধারা একটুকু শক্তি হারায়নি; বরং সারা দেশে এখনো তা মহাআড়ম্বরের সঙ্গেই চলছে।
বন ধ্বংস হলে বন্যপ্রাণীর জীবন এমনিতেই বিপন্ন হয়ে পড়ে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর জীবন বিপন্ন হওয়ার এর চেয়েও বড় কারণ হচ্ছে মানুষের হাতে তাদের পরিকল্পিত অবাধ নিধন। উদাহরণ হিসেবে নিঝুম দ্বীপের বনে বসবাসকারী চিত্রা হরিণের উদ্বেগজনক নিধন প্রসঙ্গে আসি। ২০১১ সালে সেখানে হরিণের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজারেরও বেশি। মাত্র এক দশক পর এখন সেখানে তা আছে মাত্র চার থেকে পাঁচ হাজার। প্রায় একই ধারা সুন্দরবনসহ দেশের অন্যান্য বনাঞ্চলেও। গত তিন দশকের ব্যবধানে সেখান থেকে বাঘ, চিতাবাঘ, হরিণ, কুমির, হাতি, ভালুক, বানর, হনুমান, বন বিড়াল, বনরুই, অজগর, বাগডাশ, শিয়াল, কাঠবিড়ালি, শকুন, চিল, চড়ুই, মাছরাঙা, বক, শালিক, প্যাঁচা ইত্যাদি প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর পেছনকার মূল কারণ হচ্ছে মানুষের লোভী ও নিষ্ঠুর আচরণ। প্রচলিত আইনে এসব পশুপাখি শিকারের ক্ষেত্রে আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ তা মানছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না বললেই চলে এবং সে ক্ষেত্রেও ঘুরেফিরে দায়ী ওই মনুষ্য আচরণই (সরকারি কর্মচারীদের আচরণ)।
এবারে আসা যাক নদনদী ও প্রাকৃতিক জলাশয় প্রসঙ্গে। গত ৫৪ বছরে এ দেশের নদনদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো রাষ্ট্রীয় সমর্থন, প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় শুধু লুণ্ঠিতই হয়নি—একই সঙ্গে লুণ্ঠনের চিহ্নগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পাঁয়তারাও চলেছে সমান গতিতে, যা ওই চতুর লুণ্ঠনকারী নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য সুকৌশলে করে রেখেছে। আর তারই ফলে খালবিল, নদীনালা, হাওর-বাঁওড় ইত্যাদির অধিকাংশই এরই মধ্যে রূপান্তরিত হয়ে গেছে বাড়িঘর, অফিস-আদলত, শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট, বাজার-বন্দর ইত্যাদিতে। এমনকি বিশ্বব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী দাতা সংস্থার সহায়তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বৃহৎ নদীকে ভরাট করে ছোট করে ফেলার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে (বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত ‘যমুনা নদী সরুকরণ প্রকল্প’)। এ সময়ের মধ্যে হাজার হাজার একর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন খাস জলাভূমি রাতারাতি ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি হিসেবে দলিলভুক্ত হয়ে গেছে। প্রথমে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য ইজারা নিয়ে পরে সেটিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড করে ফেলার নজির এত ভূরি ভূরি রয়েছে যে, তার তালিকা তৈরি করতে গেলে রীতিমতো হিমশিম খেতে হবে।
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, গত ৫৪ বছরে (যার মধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত ছয় মাসও রয়েছে) রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যেসব খাস জলাভূমি অবৈধ পন্থায় ব্যক্তিমালিকানায় স্থানান্তরিত হয়েছে, সেসবের অর্থমূল্য কত, তাহলে এর জবাব দেওয়া সত্যি কঠিন। তবে এটুকু প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এ পরিমাণ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কমিটি কর্তৃক প্রণীত শ্বেতপত্রে ঘুষ, দুর্নীতি, পাচার, লুণ্ঠন, তছরুপ ইত্যাদি বাবদ অর্থ আত্মসাতের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে অন্তত কয়েকশ গুণ বেশি। তো এত বড় যে লুণ্ঠন ও ডাকাতি, তা নিয়ে দেশে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ পরিসরে আলাপ-আলোচনা প্রায় হয়নি বললেই চলে। এর একটি বড় কারণ সম্ভবত এই যে, এ লুণ্ঠনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাগীদারের সংখ্যা নেহায়েত কম নয় এবং রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে এরা এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে, তারা প্রত্যেকেই নিজ স্বার্থে বিষয়টিকে বেমালুম চেপে যাচ্ছেন। আমি এমন একাধিকজনের কথা জানি, যারা আপাতভাবে সৎ ও ভালো মানুষ। কিন্তু তারাও ওই আত্মসাৎকৃত খাস জলাভূমির সুবিধাভোগী।
এই যখন বন, বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক জলাশয় নিধনের সংক্ষিপ্ত চিত্র, যেখানে এই তিন ক্ষেত্রের সম্মিলিত লুণ্ঠন ও আত্মসাতের পরিমাণ অর্থনীতির সাম্প্রতিক শ্বেতপত্র কিংবা দেশের কোনো একটি বৃহৎ জাতীয় বাজেটের চেয়ে শত শত গুণ বেশি, তখন এর ওপর আলাদা একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নও জরুরি বলে মনে করি। কাজটি এত বড় যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বল্পকালীন মেয়াদে এটি করে ওঠা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরবর্তী কোনো রাজনৈতিক সরকারের আমলেও এটি করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এবং সম্ভব যে হবে না, তার প্রমাণ হিসেবে বিগত সরকারের শেষ আমলের একটি ঘটনা এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
আদালতের নির্দেশে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি) দেশের ৪২টি নদনদীর ৩৮ দখলদারের একটি তালিকা তৈরি করেছিল ২০২২ সালে। কিন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সম্মতির অভাবে অদ্যাবধি সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি এবং নিকট ভবিষ্যতেও তা সম্ভব হবে কি না, সেটি নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। এখন বুঝুন, আদালতের নির্দেশে প্রণীত যে প্রতিবেদন প্রণীত হয়ে যাওয়ার পরও স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজিতে অপ্রকাশিত থেকে যায়, সেখানে উল্লিখিত তিন ক্ষেত্রের ৫৪ বছরের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের হিসাব রাজনৈতিক শাসনামলে প্রকাশ করা কতটা সম্ভব হবে? এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র শ্বেতপত্র প্রকাশের কাজ অন্তত শুরু করে দিয়ে যায়, তাহলে জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি বড় উপকার হয় বলে মনে করি। পরে ভবিষ্যতে যদি কখনো কোনো দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসে, তাহলে এ শ্বেতপত্র ধরে এ ক্ষেত্রে তারা কিছুটা হলেও উদ্যোগী ও সাহসী হওয়ার উপকরণ খুঁজে পাবে। কিন্তু এ সরকার অন্যান্য বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে যেভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তাতে করে উল্লিখিত শ্বেতপত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করা তাদের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু তার পরও বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রস্তাবটি এখানে পেরে রাখা হলো।
সে যাহোক, উল্লিখিত শ্বেতপত্র বর্তমান বা নিকট ভবিষ্যতের কোনো সরকার প্রণয়ন করুক বা না করুক—বন, বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক জলাশয় রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে এখন প্রকৃতপক্ষেই কঠিন এক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সে উদ্বেগ সত্ত্বেও কোনো সরকারই যদি বিষয়টি মোকাবিলায় এগিয়ে না আসে, তাহলে কী হবে? এ অবস্থায় এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা তৈরি এবং সাধ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে দেশের সচেতন ব্যক্তি, গণমাধ্যম ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। বর্তমান পরিবেশ উপদেষ্টা মহোদয়তো দায়িত্বে আসার আগে পরিবেশ নিয়েই কাজ করতেন। যে কাজ করার জন্য আগে তিনি সরকারকে তাগাদা দিতেন, এখন সে কাজের জন্য তিনি নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। সুতরাং এ ব্যাপারে পরিবেশ ও মন্ত্রণালয় এগিয়ে এলে কাজটি অনেকখানিই সহজ হয়ে আসে না কি?
লেখক: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্প মন্ত্রণালয়
মন্তব্য করুন