‘শিক্ষা বোঝার জন্য, মুখস্থ করার জন্য নয়।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা এখনো অনেকের জন্য মুখস্থনির্ভর হয়ে আছে। এর অন্যতম বড় কারণ হলো ভাষার সীমাবদ্ধতা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার প্রধান ভাষা ইংরেজি। এটি বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর জন্য সহজবোধ্য নয়। ফলে তারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অর্জনের বদলে মুখস্থ করার প্রবণতায় অভ্যস্ত হয়ে যায়।
আমাদের অনেক শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে। হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা করতে গিয়ে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। পাঠ্যবই, লেকচার, গবেষণাপত্র সবই ইংরেজিতে। অথচ তাদের ভাবনা ও বিশ্লেষণের ভাষা বাংলা। এতে তাদের শেখার প্রক্রিয়ায় একটি বড় বাধা তৈরি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, ক্লাসে শিক্ষক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বাংলায়, কিন্তু পরীক্ষার উত্তর লিখতে হচ্ছে ইংরেজিতে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সত্যিকারের বোঝার আগ্রহ কমে যায়। কারণ তারা জানে, মূল বিষয়টি না বুঝলেও মুখস্থ করে পাস করা সম্ভব। এই পরিস্থিতি শুধু তাদের শিক্ষাজীবনকেই কঠিন করে না, বরং দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
যদি উচ্চশিক্ষা মাতৃভাষায় হতো, তাহলে শিক্ষার্থীরা আরও স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারত। তারা বিষয়গুলো গভীরভাবে বুঝতে পারত, বিশ্লেষণ করতে পারত এবং নিজেদের ভাষায় চিন্তা করে সৃজনশীল উপায়ে উত্তর লিখতে পারত। বর্তমানে আমাদের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভালো গবেষণা করতে চাইলেও ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে পিছিয়ে পড়ে। যদি গবেষণা, ক্লাস, পরীক্ষা সব বাংলায় হতো, তাহলে তারা আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় আরও মনোযোগী হতে পারত।
এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার পক্ষে কথা বললেও আমরা কখনোই ইংরেজি শেখার গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারি না। ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। এটি বিশ্বদরবারে যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য। শুধু ইংরেজিই নয়, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, চীনা বা আরবি ভাষার মতো আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক ভাষা শেখার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। তবে এই ভাষাগুলো শেখার অর্থ এই নয় যে, মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা বন্ধ করে দিতে হবে। বরং আমাদের উচিত মাতৃভাষায় পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি একাধিক আন্তর্জাতিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা, যেন আমরা বিশ্ব প্রতিযোগিতায়ও এগিয়ে থাকতে পারি।
বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ জার্মানি, চীন, জাপান, ফ্রান্স তাদের মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রদান করে। অথচ তারা বিশ্ব দরবারে গবেষণা ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে আছে। তাদের শিক্ষার্থীরা প্রথমে নিজেদের ভাষায় জ্ঞান অর্জন করে, তারপর তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজে লাগায়। আমরাও যদি এমন ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে শিক্ষার্থীরা শুধু মুখস্থ নির্ভর না হয়ে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনে মনোযোগী হতে পারবে।
শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো দক্ষতা ও চিন্তার স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা। যদি ভাষার কারণে কেউ তার চিন্তাগুলো প্রকাশ করতে না পারে, তাহলে তা অবশ্যই শিক্ষার বড় প্রতিবন্ধকতা। তাই মাতৃভাষাকে শিক্ষার মূল মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা উচিত যেন শিক্ষার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্যে শিখতে পারে, গবেষণা করতে পারে এবং নিজেদের মেধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষা শেখার সুযোগও তৈরি করতে হবে, যেন তারা বিশ্বদরবারে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের তুলে ধরতে পারে। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে ভাষার বাধা নয়, বরং ভাষার সেতু তৈরি করতে হবে।
রিফাত রহমান
শিক্ষার্থী,পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ
মন্তব্য করুন