শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৯ আশ্বিন ১৪৩২
নূরে আলম সিদ্দিকী
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৫, ০২:৫০ এএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৪:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

অভ্যাস পাল্টাতে সময় লাগে

অভ্যাস পাল্টাতে সময় লাগে

এই তো মাত্র কিছুকাল আগেও এত এত উন্নয়ন দেশে। টিভি আর পত্রিকার পাতা খুললেই এত উন্নয়ন দেখলেই মন ভরে যেত। ভাবটা এমন হয়েছিল যেন বুড়িগঙ্গার তীরে ফল-ফ্রুট আঁকা হাফপ্যান্ট পরে আছি, কিছুক্ষণ বাদেই কচি ডাবের মধ্যে পাইপ ঢুকিয়ে চুঁ চুঁ করে টানব আর লাস ভেগাসের ফিল পাব।

সবার মুখে মুখে উন্নয়নের ফেনা দেখে মনে হতো ‘কক্সবাজার তুমি তো বৃথা, তোমাতেও এত ফেনা নেই’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ‘আর যাব না বেগুন তুলিতে’—এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে গাইতে ইচ্ছা করত ‘আর যাব না কক্সবাজারে’।

অথচ ৫ আগস্টে বেরসিক ছাত্র-জনতা রসভর্তি হাঁড়ি দিল ভেঙে। সেই রসে যে যার মতো করে আঙুল চুবিয়ে চেটেপুটে নিল। নলেনগুড় জ্বালানোর সময় কড়াইয়ের পাশে তালপাতার ‘চোঁচ’ হাতে নিয়ে বাচ্চারা যেভাবে চেটেপুটে খায়, আমাদের উন্নয়নও সেভাবে চেটেপুটে নিল। পড়ে রইল শুধু খোলস, ভাঙা হাঁড়ি। এখন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখি দামি দামি লুটপাটের খবর। জানলাম, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতি বছর দেশ থেকে পাচার হয়েছে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার, ১৭ বছরে পাচার হয়েছে ২৩৪ বিলিয়ন! ভাবা যায়! আর উন্নয়ন প্রকল্পের নামে প্রায় পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা শুধুই অপচয় বা নষ্ট হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে মূলত রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাড়তি খরচ দেখিয়ে এই বিপুল অর্থ লুটপাট করেছেন বিদায়ী ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও সুবিধাভোগীরা।

প্রকল্পের খরচ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই ঠিকাদার বিল তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!

ব্যাংকে টাকা রাখলে সকালে দেখা যেত গায়েব!

ভোট দিতে গেলে দেখা যেত, আগেই দিয়ে ফেলেছি!

বিরোধী মত দিলে রাতের আঁধারে হারিয়ে যেতাম!

সত্যি, কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!’

যে সময়টা পেরিয়ে এসেছি, তাকে ‘সুন্দর দিন’ বলা যায় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবে বর্তমান বাস্তবতা থেকে পেছনে তাকালে দেখা যায়, আমরা আসলেই এক ধরনের ‘সুন্দর’ সময়ে ছিলাম—যেখানে ভোট আগের রাতে হয়ে যেত, গুম হওয়া ছিল সাধারণ ব্যাপার, ব্যাংক ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো আর উন্নয়ন ছিল বিলবোর্ড, পত্রিকার দামি জমিনও ছিল সংবাদ সম্মেলনের নামে তেলমাখার মহড়ায় সীমাবদ্ধ। ব্যাংকের টাকা লোপাট হতে হতে একসময় মানুষের বিশ্বাসই উঠে গিয়েছিল যে টাকা রাখলে সেটা ফেরত পাওয়া যাবে। একদল ব্যবসায়ী হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করলেও, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতো না। বরং তারা ভিআইপি মর্যাদা পেত। পেটুক চাচার একটার পর একটা কাচ্চি মারার মতো ব্যাংকগুলোও গিলে ফেলত অদৃশ্য চাচারা। এসব কথা আবার কেউ লিখলে বা বললে রাতের আঁধারে গুম হয়ে যেত। সকালে পরিবারের লোকজন থানায় গেলে বলা হতো, ‘এমন কেউ ছিল না!’ সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা, বিরোধীদের মামলা দিয়ে জর্জরিত করা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। পেটের তাগিদে কার্টুনিস্টরাও মন খুলে আঁকতেও ভয় পেতেন।

বিচারব্যবস্থা ছিল ক্ষমতার হাতের পুতুল। যে রায় সরকারের পক্ষে যেত, সেটাই সত্য বলে প্রচারিত হতো। আবার প্রহসনের সেসব রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা ছিল ভয়াবহ অপরাধ! ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র শামিল! টুস করে মামলা দিয়ে ভরে দিত জেলে। ভাবখানা এমন ছিল যেন বিচারিক প্রক্রিয়ার কোনো ধাপে, কোনো অবস্থাতেই কোনো ভুল হওয়ার সুযোগ নেই। স্বয়ং বিধাতা বসেছিলেন বিচার করতে!

দেশটা স্বপ্নের মতো চলছিল। বাজারে গেলে এক টাকার আলু পাওয়া যেত, সবজির দাম কেজিপ্রতি এক টাকার নিচে। চাকরি চাইলে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হতো না, ব্যাংক থেকে ঋণ চাইলে ‘ব্যাংক ডাকাত’ নামের বিশেষ সুবিধা পাওয়া যেত। গুম হওয়ার ভয় ছিল না, কারণ তখন ‘গুম’ শব্দটাই নিষিদ্ধ ছিল!

সাংবাদিকরা ছিল এতটাই স্বাধীন যে, স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও সুযোগ ছিল না! তার চেয়ে বড় কথা কাজের ক্ষেত্রে ভীষণ স্বাধীনতা ছিল। যা যা ফরমায়েশ আসত, সেসব ছাপিয়ে দিলেই খালাস। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে কষ্ট করে মাঠপর্যায়ে যেতে হতো না। ছিল না পুলিশ বা সরকারি দলের পান্ডাদের হামলার-নির্যাতনের ভয়। দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে করা, নানা ফন্দি-ফিকিরে তথ্য-উপাত্ত খুঁজে করা লাগত না ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট। কী আরাম। শুধু প্রেস রিলিজ ছাপাও আর বেতন নাও।

তবে আফসোস! এত বছর ধরে যিনি আমাদের বুঝিয়ে এসেছেন, ‘দেশের মানুষ সুখে আছে’— তিনিই হঠাৎ করে নিজেই দেশ ছাড়লেন। সুখের দেশে সুখে থাকতে পারলেন না। এজন্যই বলে গরিবের সুখ সহ্য হয় না। সবাইকে সুখে রেখে নিজেই গেলেন চলে।

সত্যি বলতে আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! গুম, খুন, দুর্নীতি, স্বৈরাচার—এসব যেন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। এখন গণতন্ত্র, সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরতে শুরু করেছে, তাই হয়তো অভ্যাস পাল্টাতে কিছুটা সময় লাগছে।

নূরে আলম সিদ্দিকী, সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমরা পা ছেড়ে মাথার রগে ফোকাস করছি, মজার ছলে সর্ব মিত্র

নাটকীয় ম্যাচ জিতে টাইগারদের সিরিজ জয়

জবি ছাত্রদল নেতার মৃত্যুতে হাসপাতালে ভিপি সাদিক কায়েম

হঠাৎ খিঁচুনিতে জবি ছাত্রদল নেতার মৃত্যু

আবারও ইনজুরিতে ইয়ামাল

ঈদগাহের নামকরণ নিয়ে দ্বন্দ্ব, দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ

খুলনায় ছেলের হাতে বাবা খুন

চাকসু নির্বাচন / ১৫ সেকেন্ডে দিতে হবে ১ ভোট

‘ভোটের অধিকার না থাকায় শ্রমজীবীরা বেশি অমর্যাদার শিকার’

এক গ্রামে ১১ জনের শরীরে মিলল অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ

১০

থানায় জিডি করলেন সালাউদ্দিন টুকু

১১

সংস্কৃতির ভেতরেই রাজনীতির সৃজনশীলতা নিহিত : দুদু

১২

সাইফের চোখ বাঁচাতে প্রয়োজন ৩০ লাখ টাকা

১৩

সিরিজ জিততে বাংলাদেশের দরকার ১৪৮ রান

১৪

জাতিসংঘে ড. ইউনূসের সফর গণতন্ত্র ও মানবিক সংহতির বার্তা : প্রেস সচিব

১৫

বিরক্ত মেহজাবীন চৌধুরী

১৬

জামায়াত অন্তত ১৬০টি আসন পাবে : সাদ্দাম

১৭

‘মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্রী হয়রানির অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’

১৮

পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করে খোয়াব পূরণ হবে না : জাগপা

১৯

‘আসল শিবির হইলো আমার মা, বাড়ি এলেই জোর করে বোরকা পরায়’

২০
X