তারেক খান
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শুল্কযুদ্ধে ক্ষতি হবে মার্কিনিদেরই

শুল্কযুদ্ধে ক্ষতি হবে মার্কিনিদেরই

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হতে চলেছেন সাধারণ মার্কিন ভোক্তারা। তিনি ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আসা প্রায় সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে বিশ্বব্যাপী শুল্ক আরোপ করা হবে। ট্রাম্প একে বলছেন ‘আমেরিকান অর্থনীতির মুক্তি দিবস’। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এ সিদ্ধান্ত আসলে যতটা না ‘মুক্তি’ দেবে, তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ, ক্ষতি আর অস্থিতিশীল বাড়াবে।

এই ১০ শতাংশ শুল্ক হচ্ছে কেবল ভিত্তি। এর বাইরে ট্রাম্প আরও বড় ধরনের শুল্ক আরোপ করছেন। যেমন গাড়ি আমদানির ওপর এখন থেকে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এমনকি গাড়ির যন্ত্রাংশের ওপরও একই হারে শুল্ক বসানো হচ্ছে—যেটা মে মাস থেকে কার্যকর হবে।

এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে আমেরিকানরা নিজেরাই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র একটি গাড়িনির্ভর দেশ—সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, সবার জীবনযাত্রা গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। কানাডা আর মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়িশিল্প ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। সেসব দেশ থেকে আমদানি কমলে গাড়ির দাম বেড়ে যাবে, সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে। শুধু গাড়ির ক্ষেত্রেই না, এই প্রভাব পড়বে আরও অনেক পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আসা সব পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক, জাপান থেকে ২৪ শতাংশ, তাইওয়ান থেকে ৩২ শতাংশ, ভারত থেকে ২৬ শতাংশ আর ভিয়েতনাম থেকে ৪৬ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে।

এ দেশগুলোর অনেকেই আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক মিত্র। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল কয়েক বছর ধরে। এখন এসব দেশে শুল্ক বাড়ালে, তার পাল্টা প্রতিক্রিয়াও আসতে পারে। ফলে আমদানি আরও ব্যয়বহুল ও জটিল হয়ে উঠবে।

একদিকে আমেরিকা এখনো কভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধজনিত মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত। তার মধ্যেই এ নতুন শুল্ক পরিস্থিতি দেশটির বাজারে আবার মূল্যবৃদ্ধির ঢেউ তুলতে পারে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু সদস্য এখন বলছেন, কিছু শুল্ক আবার কমানো হতে পারে বা আলোচনার মাধ্যমে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আমদানিকারক আর পাইকাররা এরই মধ্যে ভাবতে শুরু করেছে—এ পণ্যে বিনিয়োগ এখন লাভজনক হবে কি না। অনেক দেশ পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে—ফলে সরবরাহ ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়বে।

সব মিলিয়ে এ বাণিজ্যনীতি যতটা ‘আমেরিকার জন্য’, আসলে তার চেয়ে বেশি আমেরিকান জনগণের ঘাড়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে—খুব দ্রুতই। আগের মার্কিন প্রেসিডেন্টদের নেতৃত্বে ওয়াশিংটন বিশ্বজুড়ে মুক্তবাণিজ্যের যুগ চালু করেছিল। তখন সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে গিয়েছিল। তবে এ নিয়ে বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলের কেউ মাথা ঘামালেও, এই কমে যাওয়া সত্ত্বেও, আমেরিকার সাধারণ ভোক্তারা কিন্তু সেই মুক্তবাণিজ্য থেকেই সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে। সেই মুক্তবাণিজ্যই আসলে সবচেয়ে বেশি উপকার এনে দিয়েছে আমেরিকার সাধারণ ভোক্তাদের জন্য। তারা কম দামে পণ্য পেয়েছে, জীবনযাত্রা সহজ হয়েছে। আর এখন, ট্রাম্প যে নতুন শুল্কনীতি চালু করছেন, তার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হবে এ ভোক্তাদেরই।

আগের যুগে যে দ্বিদলীয় সমঝোতা ছিল, সেটা নিয়ে ট্রাম্প সবসময়ই বিরূপ মন্তব্য করে আসছেন। তিনি ‘গ্লোবালিস্ট’ শব্দটা দিয়ে এক ধরনের উপহাস করেই বোঝাতে চান, আগের এ মুক্তবাণিজ্য নীতি চালিয়েছিল একদল বিশ্বমুখী লোকজন, যাদের জন্য দেশটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মতে, তিনি যখন এই নীতির বিপরীতে গিয়ে শুল্ক চাপান, তখন শেয়ারবাজারে যেটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, সেটাও এই ‘গ্লোবালিস্টদের’ প্রভাব। কিন্তু আসল মজার ব্যাপার হলো, এ মুক্তবাণিজ্য যাত্রায় আসলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে ট্রাম্পের নিজের দল রিপাবলিকান পার্টি।

আশির দশকে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান বাণিজ্যকে সরাসরি যুক্ত করেছিলেন দেশের সমৃদ্ধির সঙ্গে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদার হবে, তাদের জন্যও বাণিজ্য ছিল এক ধরনের এগিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার। সেই সময় রিগানের উপদেষ্টা ও রক্ষণশীল মহলে অত্যন্ত সম্মানিত অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান লিখেছিলেন, ‘আমাদের শুল্ক শুধু অন্যদের না, আমাদেরও ক্ষতি করে। এমনকি অন্য দেশ যদি শুল্ক না তোলে, তাও আমরা যদি নিজের শুল্ক তুলে দিই, তাতেই আমাদের লাভ হবে। খুব কম পদক্ষেপ আছে, যা ঘরে এবং বিদেশেও স্বাধীনতা বাড়াতে আমাদের এতটা সাহায্য করতে পারে।’

রিগানের সময় ডেমোক্র্যাটরা এ বাণিজ্যনীতিতে পুরোপুরি আস্থা রাখেননি। বরং অনেক পরে, যখন বিল ক্লিনটন ১৯৯৪ সালে কংগ্রেসে উত্তর আমেরিকান ফ্রি ট্রেড চুক্তি (NAFTA) উপস্থাপন করেন, তখন দেখা যায়, ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে বেশি রিপাবলিকান সিনেটর এ চুক্তির পক্ষে ভোট দেন। অথচ ট্রাম্প এখন যা করছেন, তার মধ্যে কোনোরকম কংগ্রেসীয় পর্যবেক্ষণ রাখার ইচ্ছাও দেখা যাচ্ছে না। তবু কংগ্রেসের কিছু কর্তৃত্ব এখনো আছে। ট্রাম্প যেসব শুল্ক আরোপ করছেন, সেগুলোর ভিত্তি খুব মজবুত না। তিনি বলছেন, এটা করা হচ্ছে ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে’। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ১৯৭৭ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ইকোনমিক পাওয়ারস অ্যাক্ট’ বা IEEPA ব্যবহার করছেন, যা প্রেসিডেন্টকে জরুরি অবস্থার নামে বিশেষ ক্ষমতা দেয়। এ আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন, প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ বসাতে পারেন, এমনকি আগে ট্রাম্প যেসব শুল্ক আরোপ করেছিলেন, সেগুলোর ভিত্তিও এ আইনের ওপরই দাঁড়িয়েছিল।

এ ক্ষমতা ব্যবহারের জন্য প্রেসিডেন্টকে অবশ্যই একটা ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করতে হয় এবং সেটা যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যাও করতে হয়। যদিও আজ পর্যন্ত কখনো হয়নি, তবুও কংগ্রেস চাইলে ১৯৮৫ সালের ন্যাশনাল ইমার্জেন্সিস অ্যাক্ট ব্যবহার করে এমন কোনো জরুরি অবস্থা বাতিল করতে পারে।

ট্রাম্প যখন কানাডার পণ্যের ওপর হঠাৎ শুল্ক ঘোষণা করেন, তার কয়েক ঘণ্টা পরই মার্কিন সিনেটে এ ইস্যুতে ভোট হয়। মেইনের সুসান কলিন্স, আলাস্কার লিসা মারকাওস্কি আর কেন্টাকির দুই সিনেটর মিচ ম্যাককনেল ও র্যান্ড পল—এ চারজন রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে এক হয়ে ভোট দেন ট্রাম্পের ‘ফেন্টানিল জাতীয় জরুরি অবস্থা’ বাতিলের পক্ষে। এ জরুরি অবস্থাটিই ছিল কানাডার ওপর ব্লাংকেট-শুল্ক আরোপের ভিত্তি। ভোট হয় এবং প্রস্তাবটি পাসও হয়। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে শুধু কানাডা-সম্পর্কিত শুল্কই বাতিল হয়েছে। মেক্সিকো বা অন্যান্য দেশের ওপর ট্রাম্প যে শুল্ক দিয়েছেন, তার পেছনে রয়েছে ভিন্ন ধরনের ‘জরুরি অবস্থা’, যেটা দেখানো হয়েছে বাণিজ্য ঘাটতির সঙ্গে যুক্ত হিসেবে। ফলে ট্রাম্পের নতুন, আরও বড় ও ব্যয়বহুল শুল্ক নীতিগুলো ফিরিয়ে নেওয়ার রাজনৈতিক সম্ভাবনা যে কতটা অন্ধকার, সেটাই এ পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়।

ট্রাম্প যে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে শুল্ক বসিয়েছেন, সেটাকে বাতিল করতে হলে কংগ্রেসে শুধু ভোট হলেই হবে না—তার ভেটো ঠেকাতে হলে চাই উভয়কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি, হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে রিপাবলিকান নেতারা এমনকি সিনেটে পাস হওয়া কানাডাবিষয়ক প্রস্তাবটাও ভোটে তুলতে দেবেন না, নতুন কোনো প্রস্তাব তো অনেক দূরের কথা। আর এই মুহূর্তে কংগ্রেস সেই অবস্থায় নেই যে, তারা ট্রাম্পের এ ক্ষতিকর পরিকল্পনা ঠেকাতে পারে।

বাইডেন প্রশাসনের সময় কিছু ডেমোক্র্যাট অবশ্য একটু করে মুক্তবাণিজ্য থেকে সরে আসার কথা ভাবতে শুরু করেন। তারা বুঝেছেন, এটা শুধু উপকারই আনে না, এর কিছু খরচও আছে এবং এখন সময় এসেছে কিছুটা ভারসাম্য আনার। কিন্তু রিপাবলিকান পার্টির তো তেমন কোনো ধাপে ধাপে পরিবর্তন হয়নি। ট্রাম্প গত আট বছরে দলটাকে পুরোই নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছেন। এখন দলের ভেতর থেকে ভিন্নমত বলা প্রায় অসম্ভব। এমন অবস্থায় ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। তবু চেষ্টা থামানো যাবে না। কংগ্রেসের যারা ভেতরে আছেন, তাদের চোখ খুলে দেওয়া, বোঝানো—ঠিক কাজটা কী এখন এটুকুই সবচেয়ে জরুরি।

লেখক: গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কাজ করেন। তিনি লন্ডনভিত্তিক একজন রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত। আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে বাংলা করেছেন তারেক খান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নাতনিকে ইভটিজিং, প্রতিবাদ করায় নানাকে কুপিয়ে হত্যা

বাড়িতে ঢুকে মা-বাবাকে মারধর করে মেয়েকে অপহরণ, গ্রেপ্তার ১

গাজায় আরও অর্ধশতাধিক নিহত, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা অনেকে

কেমন থাকবে আজ ঢাকার আবহাওয়া

তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির ঘটনায় আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই : ফারুকী

শেষ হয়েছে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা, ইলিশ ধরতে প্রস্তুত ভোলার জেলেরা

পাট শ্রমিক দলের সভাপতি হলেন সাঈদ আল নোমান

সাতক্ষীরায় বিএনপির সার্চ কমিটিতে আ.লীগ

৩০ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১০

৩০ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

১১

বিজেপি নেতার তোপে মোদি ও অমিত শাহ

১২

ইট মারলে আমরা পাথর ছুড়ব, ভারতকে ইসহাক দার

১৩

পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী / ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানে হামলা চালাতে পারে ভারত

১৪

নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা দূর করতে হবে

১৫

সাড়ে সাত হাজার চিকিৎসকের পদোন্নতি আটকে

১৬

বগা সেতু বাস্তবায়নে উপদেষ্টার সঙ্গে ড. মাসুদের বৈঠক

১৭

মানবিক সহায়তা করিডোর বিষয়ে গণসংহতি আন্দোলনের বিবৃতি

১৮

আর্সেনালকে হারিয়ে ফাইনালে এক পা পিএসজির

১৯

স্বাস্থ্য পরামর্শ / ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে জীবনযাপনে পরিবর্তন প্রয়োজন

২০
X