

‘বড় স্বপ্ন নিয়ে ধার-কর্জ কইরা ছেলেকে বিদেশ পাঠালাম। ৪৮ দিন হয়ে গেছে ছেলে বিদেশে গেছে। কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই বলতে পারি না। আমার ছেলেকে ছাড়া কীভাবে থাকমু। আমার ছেলের মুখের কথা একটু শুনতে চাই। ছেলের কথা শুনতে পারলে কলিজাটায় শান্তি লাগতো।’ কাঁদতে কাঁদতে এমনি আকুতি জানাচ্ছিলেন ভুক্তভোগী নাজমুল শিপুর মা নাছিমা বেগম।
ভুক্তভোগী নাজমুল শিপু (২৫) চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার মতলব পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের দূরগাঁও গ্রামের মো. জাফর মোল্লার ছেলে। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর জীবিকার সন্ধানে তিনি সাউথ আফ্রিকা পাড়ি জমান। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পায়নি পরিবার।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, মো. জাফর মোল্লা ও নাছিমা বেগম দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে নাজমুল শিপু (২৫) বড় ছেলে। ছোট ছেলে সিহাব স্থানীয় দূরগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। জীবিকার সন্ধানে ঢাকার এক দালালের মাধ্যমে নাজমুল শিপুর পরিবার চুক্তি করে সাউথ আফ্রিকায় পাঠানোর জন্য। নাজমুল শিপুকে ঢাকার একটি ট্রাভেলসে নিয়ে যায়। ট্রাভেলস কর্তৃপক্ষ শিপুর আত্মীয়দের নিশ্চয়তা দেয় সরাসরি ভিসা করে সাউথ আফ্রিকা পাঠাবে কিন্তু হঠাৎ কথা পাল্টিয়ে ইথিওপিয়া পর্যন্ত টিকিট কেটে ফেলে। তখন নাজমুল শিপুর পরিবার অনীহা প্রকাশ করে। কিন্তু ট্রাভেলস মালিক আশ্বস্ত করে কোনো সমস্যা হবে না। এই নিশ্চয়তার বিশ্বাসে দালালদের মাধ্যমে তাকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর আফ্রিকা পাঠায়। কিন্তু ৪৮ দিন পার হলেও শিপুর কোনো খোঁজ নেই। এ নিয়ে কষ্টে হতাশায় ভুগছে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জান গেছে, মো. নাজমুল শিপু উপজেলার আদর্শ স্কুল থেকে ২০২২ সালে এসএসসি পাস করে। জীবিকার সন্ধানে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর সাউথ আফ্রিকা যান। শিপুর আত্মীয়স্বজন সাউথ আফ্রিকা থাকে। কিন্তু এখনো সাউথ আফ্রিকা গিয়ে পৌঁছায়নি। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে কেউ বলতে পারে না। বাবা-মা আত্মীয়স্বজন আছে হতাশা ও কষ্টে।
নাজমুল শিপুর বাবা জাফর মোল্লা বলেন, ‘আমার দুইটা ছেলে। বড়ো সন্তান নাজমুল শিপু। বয়স মাত্র ২৫ বছর। ছোট ছেলেটা দূরগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আমি বাড়ির পাশে গ্রামে একটা ছোট্ট মুদি দোকানি। এই দোকানদারি করে কোনো রকম সংসার চালায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে কর্জ নিয়া বড় আশা করে ছেলেকে আফ্রিকা পাঠিয়েছি। আজকে একমাস হয়ে গেছে। এখনো ছেলের কোনো খোঁজ খবর পাই নাই। কর্জের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবো তা ভেবে পাচ্ছি না। তার ওপর ছেলেটা কই আছে, বেঁচে আছে নাকি মেরে ফেলছে কিছুই জানি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘জীবিকার জন্য ছেলেকে বিদেশ পাঠাইলাম। অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলেকে নিয়ে। কষ্ট ও শোকের কথা কাকে বুঝাবো। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই। আমার ছেলেটা যেন সুস্থ ফিরে পাই। আমার ছেলেকে পেতে সরকারের কাছে জোরাল দাবি জানাচ্ছি।’
ভুক্তভোগীর মা নাছিমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে কালবেলাকে বলেন, ‘যাদের মাধ্যমে আফ্রিকা পাঠাইছি তারা এখন একেক সময় এক এক কথা বলছে। আমার বুকের ধন ছেলেটা বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। এক মাস হইয়া গেছে কোনো খোঁজ পাই না। আমার ছেলেকে ছাড়া কীভাবে থাকমু। আমার ছেলের মুখের কথা একটু শুনতে চাই। ছেলের কথা শুনতে পারলে কলিজাটা শান্তি লাগতো। আল্লাহ আমারে নিয়ে যাক আমার ছেলেটাকে বাঁচাইয়া রাখুক। আমার সন্তানটা খোঁজে ফিরিয়ে দিতে প্রশাসনের কাছে বিনীত আবেদন করছি।’
নাজমুল শিপুর চাচা ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমার ভাইয়ের দুই সন্তানের মধ্যে নাজমুল শিপু বড়। কর্জ করে ভাতিজাকে সাউথ আফ্রিকা পাঠাইছি। কিন্তু আজকে ৪৮ দিন হলো কোনো খোঁজ খবর নাই। ঢাকার লোকের মাধ্যমে ভাতিজাকে পাঠাইছি। এখন কই আছে না আছে কিছুই জানি না। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তাও জানি না।’
স্থানীয়রা জানান, মিথ্যা আশ্বাস ও দালালদের খপ্পরে পরে একটা পরিবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার বাবা-মা এখন সন্তান হারিয়ে পাগল প্রায়। সন্তানকে ফিরে পেতে চায় তার পরিবার।
এ বিষয়ে মতলব দক্ষিণ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালেহ আহম্মেদ কালবেলাকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মন্তব্য করুন