শিক্ষক হলেন বটবৃক্ষ। একটি বটবৃক্ষের গোড়ায় থাকেন শিক্ষক। এ শিক্ষককে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে অনেক পদ-পদবি। শিক্ষককে বাদ দিয়ে কোনো উচ্চ পদ-পদবি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তবে শিক্ষক হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। এ মেরুদণ্ড শক্ত না করতে পারলে জাতির মেরুদণ্ড শক্ত হবে না। ভিত যদি যথাযথ না হয় তবে কিছুই টেকসই করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। অধ্যাপক মোসলেম আলী স্যারকে স্মরণ করলে এই শক্ত ভিতের কথাই সর্বপ্রথম মনে হয়। তার স্মৃতিকথা আলোচনায় আনতে হলে সেই গোড়ায় ফিরে যেতে হবে। তিনি ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। সমাজের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। একজন ক্ষণজন্মা মানুষ। তার কর্মময় জীবনই কথা বলবে তার স্মৃতি রক্ষার জন্য।
একজন শিক্ষকের সর্বোচ্চ পদ হলো অধ্যাপক। কিন্তু অধ্যাপক মোসলেম আলী সেই সর্বোচ্চ পদ ছাড়িয়ে মহান উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন তার নিরহংকার কর্মময় জীবনের মাধ্যমে। মানুষকে আলোকিত করাই ছিল তার জীবনের ব্রত। কর্মময় জীবনে তিনি অনেক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করে গৌরব অর্জন করেছেন। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টি দরকার, এর ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছেন। যেমন—মানবিক গুণসম্পন্ন, দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন সারাটা জীবন। তার শিক্ষাদানের লক্ষ্য ছিল যুগপৎভাবে পরীক্ষার ফল ভালো করা এবং মানবিক চেতনা ও মূল্যবোধসম্পন্ন, দায়িত্ব সচেতন, সংবেদনশীল, শিক্ষিত দায়িত্বশীল নাগরিক সৃষ্টির দিকেই ছিল দৃষ্টি।
শিক্ষাকে কেবল গ্রন্থনির্ভর বা প্রশ্নের মুখস্থ উত্তর নির্ভর না করে কীভাবে প্রাণবন্ত ও আনন্দময় করা যায়, সেটা ছিল তার শিক্ষা দর্শন। তিনি প্রত্যাশা করেছেন প্রাণচাঞ্চল্য আর মনের সজীবতা ছাড়া শিক্ষা সার্থক হতে পারে না। এরকম একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন অধ্যাপক মোসলেম আলী। তাই মানুষ এবং একজন সফল শিক্ষক হিসেবে অমর হয়ে আছেন।
তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তি শিক্ষক ও শিক্ষা ক্যাডারের অহংকার। অধ্যাপক মোসলেম আলী নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার জোড়ামল্লিক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সার্ভিস কমিশন কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে রাজশাহী কলেজে রসায়ন বিষয়ে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৯২ সালে প্রথম দিকেই বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এই পদে কর্মকালে তার ইতিবাচক ভাবমূর্তি ও খ্যাতি আরও বিস্তৃত হয়। এরপর জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এভাবেই তিনি নিজ সফলতায় ভরপুর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে অসামান্য প্রতিভা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে সক্ষম হন।
অবসর গ্রহণের পরও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক, উন্নয়ন ও পরিকল্পনা পদে যোগদান করেন এই মহান শিক্ষাবিদ। সে সময় তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কালচারাল একাডেমি’ নামক প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে কাজ করেন এবং সুনাম ও মর্যাদার সঙ্গে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। সারা জীবনের কর্মময় জীবনই তার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। জীবনব্যাপী কর্মকালে তিনি সরকারিভাবে ইরান, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ভ্রমণ করেন। তার দীর্ঘ জীবনের কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনমানুষের উন্নয়নে এবং মানুষের আত্মিক বিকাশের জন্য নিবেদন করেছিলেন। সে কারণেই তার সাহচর্যে যারা এসেছেন, তাদের অন্তরে স্থান করে নিয়েছিলেন এবং শ্রদ্ধার ও সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এখনো সকল শ্রেণির মানুষের কাছে মোসলেম স্যারের শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে রয়েছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত কৃষিভিত্তিক শিল্পের সংগঠন বাপার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শেষ জীবনেও স্বীয় মেধা ও প্রজ্ঞার শিখা প্রজ্বলিত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি সাফল্যের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন। মূলত বাংলাদেশের অগ্রসর শিক্ষাবিদদের অন্যতম অগ্রজ ছিলেন অধ্যাপক মোসলেম আলী। তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরকাল তার অগণিত কর্মের মাধ্যমে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ
নওগাঁ সরকারি কলেজ
মন্তব্য করুন