প্রতি বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম নগরে নালায় পড়ে শিশুসহ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা যেন নিয়মে পরিণত হয়ছে। গত পাঁচ বছরে নগরের নালায় পড়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত নয়জনের। শুক্রবার সর্বশেষ এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে ছয় মাসের ছোট্ট নিষ্পাপ শিশু সেহরিশের নাম। আগের সব মৃত্যুর মতোই এটিও অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা। ধারাবাহিক এসব ঘটনা নিশ্চিতভাবেই নগরটির জননিরাপত্তার বিষয়টি যে উপেক্ষিত, তারই সাক্ষ্য বহন করে।
গত শুক্রবার রাতে শিশু সেহরিশকে নিয়ে তার মা ও দাদি অটোরিকশায় বাসায় ফিরছিলেন। পথে নগরীর চকবাজার থানার কাপাসগোলা এলাকায় রাত ৮টায় তাদের বহনকারী অটোরিকশাটি উল্টে হিজরা খালের নালায় পড়ে যায়। তাৎক্ষণিক মা ও দাদিকে উদ্ধার করা গেলেও তলিয়ে যায় সেহরিশ। এর পরপরই শিশুটিকে উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়। সিটি করপোরেশনের সদস্য, ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী রাতভর অভিযান চালিয়েও উদ্ধার করতে পারেনি তাকে। পরে নিখোঁজের ১৪ ঘণ্টা পর চাক্তাই খাল এলাকায় শিশুটির লাশ ভেসে ওঠে।
রোববার কালবেলায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দাবি করছে, নগরটির বাঁকে বাঁকে রয়েছে এরকম অনেক মৃত্যুফাঁদ। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয় নগরবাসীর। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে নালা-নর্দমায় রয়েছে কয়েক হাজার মরণফাঁদ। এর মধ্যে বেশিরভাগ নালা-নর্দমাই উন্মুক্ত। এসব নালার ওপর কোথাও স্লাব আছে। কোথাও নেই। আবার কোথাও স্লাব যাও আছে, তা ভাঙা ও অকার্যকর। খালে নেই নিরাপত্তাবেষ্টনী। নালায় পড়ে মৃত্যুর পর খাল-নালায় প্রয়োজন অনুযায়ী নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়ার দাবি জানানো হয় প্রতিবারই; কিন্তু বছর ঘুরে আবার দুর্ঘটনা হলেও ঝুঁকিমুক্ত করা হয় না। ঝুঁকি নিয়েই পথ চলতে হয় নগরবাসীকে। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশার। এর আগে গত পাঁচ বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে অন্তত আরও আটটি। ২০২৪ সালের জুনে গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় সাত বছরের শিশু সাইদুল ইসলাম নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন নাছির খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়া এলাকায় দেড় বছর বয়সী শিশু ইয়াছিন আরাফাত নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। ১৬ ঘণ্টা পর তার মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। একই মাসের ৭ আগস্ট নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রী নিপা পালিতের। এর আগে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর, একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর, ২৫ আগস্ট ও ৩০ জুন একই ধরনের ঘটনা ঘটে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এ মৃত্যুর মিছিল বন্ধে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি করে উন্মুক্ত নালার দুই পাশে কার্যকরী নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় এ মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না।
আমরা মনে করি, প্রতি বছর নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় নগরের সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই তাদের দায় এড়াতে পারে না। নগরের জননিরাপত্তায় সংশ্লিষ্টদের যে দীর্ঘ অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। কেননা বছরের পর বছর অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনায়ও তাদের টনক নড়েনি। নেওয়া হয়নি কার্যকর পদক্ষেপ। তার প্রমাণ শুধু এসব দুর্ঘটনাই নয়; বরং নগরজুড়ে নালা-খালগুলোর বর্তমান শোচনীয় দশা। এসব নালায় অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুই যেন স্বাভাবিক!
আমাদের প্রত্যাশা, এবারের ঘটনায় সংশ্লিষ্টরা সত্যিকারই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে। প্রতিবারের মতো দুর্ঘটনার পর কয়েক দিন আলোচনা এবং এরপর তা চাপা পড়ে যাবে না। পুনরাবৃত্তি হবে না এমন মর্মান্তিক ঘটনার। পাশাপাশি নিরাপদ নগরী গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হবে।
মন্তব্য করুন