মে দিবস। একেক দেশে একেকভাবে তার প্রতিপালন। আমাদের দেশে এখন মে দিবস হচ্ছে ছুটির দিন। আমরা দেখেছি সরকারি উদ্যোগে শ্রমিকদের বিনোদনের জন্য গান-বাজনার আয়োজন করা হয়ে থাকে। সেইসঙ্গে শ্রমিকদের উদ্দেশে উপদেশ দেওয়ার ব্যাপারে কোনো গাফিলতি হয় না। এসব উপদেশও পুরোনো বটে। বলা হয় খুব কষে উৎপাদন করুন। কঠিন পরিশ্রমে দেশকে গড়ে তুলুন। এসব মহৎ বাণীর মধ্যে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা থাকে। কাকে বলছি আরও বেশি পরিশ্রম করতে? ভাঙা হাড়গুলো আরও বেশি ভাঙতে? সেই শ্রমজীবীকে যে শ্রম না করলে খেতে পারে না। যে কাজ পায় না, বেকার থাকে। অভুক্ত থাকে প্রায়ই। কার দেশ কে গড়ে? ভূমিহীনের দেশ কোথায়? কোথায় বাস করে সর্বহারা? আরও একটি নিষ্ঠুর ব্যঙ্গোক্তি চালু আছে আমাদের দেশে। ‘শ্রমের মর্যাদা’।
শ্রমের মর্যাদার কথা তারাই বলতে পারেন নির্ভয়ে, পরিশ্রম করার প্রয়োজনীয়তা থেকে যারা বহু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন, নইলে শ্রমের মর্যাদা যে কতটুকু প্রতিটি শ্রমিক তা প্রতিদিন বোঝে—মর্মে মর্মে। বিশেষভাবে বোঝে যখন বাজারে যায়, শ্রম বিক্রি করতে। শ্রমিকদের মে দিবস মালিকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। একশ বছর আগে ১৮৮৬ সালে মে মাসের ১ তারিখে শ্রমিকরা সমবেত হয়েছিল আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে। দাবি ছিল আট ঘণ্টা কাজের দিনের। সেটা সূত্রপাত মাত্র। আট ঘণ্টা একটা বিশেষ অবস্থার দাবি। মূল ব্যাপারটা শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের। মর্যাদার নয়, অধিকারের। অধিকার থাকলেই মর্যাদা আসে, নইলে নয়। সেই দাবি ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে। এরও ৩৮ বছর আগে মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ লিখেছিলেন, যাতে ইতিহাসের বিকাশে শ্রেণিসংগ্রামের ভূমিকার কথা বলা হয়েছিল, বলা হয়েছিল বিকাশের সেই ধারা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা। সমাজতন্ত্র অন্য কেউ প্রতিষ্ঠা করবে না, শ্রমিকরাই করবে, তাদের নিজেদের প্রয়োজনে। প্রায় দেড়শ বছর ধরে দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলন ওই লক্ষ্যের অভিমুখেই এগিয়ে গেছে। বহু দেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ধ্বংস করে সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর উন্নততর একটি ব্যবস্থা অর্থাৎ ওই সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা হয়েছে এবং কথাটা এখানেই বলে নেওয়া দরকার যে, কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সাম্য ও স্বাধীনতার ভেতরকার তথাকথিত বিরোধটা দূর হয়, অন্যত্র নয়। বস্তুত যেখানে প্রকৃত সাম্য আছে সেখানেই যথার্থ স্বাধীনতা রয়েছে। কেননা স্বাধীনতার ব্যাখ্যা তারা যে যাই বলুন, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো যেখানে মিটে না, সেখানে স্বাধনীতা কে কাকে দেয়। একমাত্র সাম্যবাদী ব্যবস্থাই পারে সবাইকে স্বাধীনতা দিয়ে প্রত্যেককে স্বাধীন করতে। পুঁজিবাদে একজন স্বাধীন হয় দশজনকে নিচে ফেলে দিয়ে। শ্রমিকশ্রেণি তাই গান-বাজনা কিংবা উপদেশ শুনতে চায় না, রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব চায়। তার জন্যই আন্দোলন। চূড়ান্ত লক্ষ্য বুর্জোয়াদের একনায়কত্বকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত করবে। শোষণের যন্ত্রটি উৎপাটিত করে ফেলবে। এ শোষণই হচ্ছে স্বাধীনতার এক নম্বরের শত্রু। সে-ই অসাম্যের সৃষ্টি করে, যে অসাম্য মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। শোষণ কতটা আছে জানতে পারলেই বোঝা যাবে স্বাধীনতা কতটা আছে, কিংবা নেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওই বিশেষজ্ঞ অবশ্য একটু মূল্যবান সত্য উদঘাটিত করেছেন। সেটি এই যে, আজকের দিনে ডানপন্থিরা স্বাধীনতার কথা বলেন, বামপন্থিরা বলেন, সাম্যের কথা। এ বিশ্লেষণ যথার্থ বটে। ডানপন্থিদের স্বাধীনতার উচ্চ নিনাদের মধ্যে সাম্যের কোনোই প্রতিশ্রুতি নেই, বরং সাম্য যাতে কিছুতেই না আসতে পারে সেই পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার আছে। তাদের পরিকল্পিত স্বাধীনতা জঙ্গলের, যেখানে শক্তিমানরা টিকবে, দুর্বলদের ধ্বংস করে। ওদিকে বামপন্থিদের যে সাম্যের জন্য লড়াই সেখানে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি, কেননা সাম্যই পারে জঙ্গলের অধীনতা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ফরাসি বিপ্লব পতাকা তুলে ধরেছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার। যে বিপ্লব রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তবু সব মানুষের জন্য সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা আনতে পারেনি বুর্জোয়াদের সে ক্ষমতা নেই, অভিপ্রায়ও নেই। তবে সাম্যের প্রয়োজন বারবার স্বীকার করতে হয়েছে। ধর্মপ্রচারকরা বলেছেন, শিল্পী-সাহিত্যিকরাও বলেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী বাণী হচ্ছে ওইটি—ওই যে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। শ্রমিকরাই বিপ্লবী, প্রকৃত অর্থে তাদেরই হারানোর কিছু নেই, জয় করার রয়েছে সমগ্র বিশ্ব। যথার্থ সাম্য বিত্তবানরা আনতে পারে না, সর্বহারারাই পারে। বুর্জোয়ারা অনেক সময়ই বলেন যে, তারা সাম্য চান। বলেন যে, তাদের গণতন্ত্রে সাম্য আছে। প্রমাণ কী? প্রমাণ অকাট্য। ওই যে ভোটে। কোটিপতির এক কোটি ভোট নেই, ভোট তার একটাই, দরিদ্রতম ভোটারটির সমান তিনি এ ক্ষেত্রে। কিন্তু কোটিপতি যে গরিব মানুষের ভোটটি ছিনতাই করে নিয়ে যায় তার কী হবে? অনেক সময় ছিনতাইয়ের দরকার পড়ে না, বিভ্রান্ত করেই কাজ সারা যায়। ভোটের শেষে প্রার্থী ফিরে যান তার বড় দালানে, ভোটার চলে যায় তার ভাঙা ঘরে (যদি থাকে)। আমাদের স্কুলগুলোতে এক সময়ে টিফিনের সাম্য কায়েম করা হয়েছিল। টেকেনি। ইউনিফর্মের সাম্যটা এখনো আছে। কিন্তু সে তো ছয় ঘণ্টার ব্যাপার, বাকি আঠারো ঘণ্টার সাম্য কোথায়? তা ছাড়া তাদের সঙ্গে সাম্য প্রতিষ্ঠা করবেন কী করে যারা স্কুলে আসে না, অথবা আসে চাকর হয়ে? পারবেন না। পারা যায় না। অসাম্যই স্বাধীনতা পেয়েছে বৃদ্ধির। বুর্জোয়া শাসনের একটি চরম রূপ হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। এ রূপটি চিনতে আমাদের কষ্ট হয় না। স্বৈরাচারের চেহারা খুবই উৎকট। কিন্তু উদারনীতিকে কি বলা যাবে? সেও তো বুর্জোয়া শাসনের রকমফেরই বটে। যতই অপ্রীতিকর মনে হোক ভাবনাটা, আসলেই তো উদারনীতি ও ফ্যাসিবাদের মধ্যকার ব্যবধানটা চরিত্রগত নয়, পরিমাণগত মাত্র। উভয়ই চাইছে বুর্জোয়াদের একনায়কত্ব অটুট রাখবে। ফ্যাসিবাদ কাজটা করে অভদ্রভাবে, উদারনীতি করতে চায় নম্র উপায়ে। ভদ্রতা রক্ষা করে কাজটি সম্পাদন করা যদি অসম্ভব হয় তখন ধরা পড়ে আসল চেহারা, ভদ্রলোক তখন নিজেই গুণ্ডা হয়ে যাবেন, নয়তো বাড়ি থেকে সেই ভাইটিকে ডেকে আনবেন নিত্য যে মস্তানি করে। উদারনীতিকে বিশ্বাস নেই। বিশ্বাসঘাতক সে আরেক দিক দিয়েও। আপসের কথা বলে। বলে শ্রমিকশ্রেণিকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মসমর্পণে। বুর্জোয়াদের আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণিকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মসমর্পণে বুর্জোয়াদের আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিকদের আন্দোলনের একটি বড় তফাত এখানে যে, বুর্জোয়ারা আপস করে, শ্রমিকরা করে না, অন্তত করার কথা নয়। বুর্জোয়াদের লড়াই গদি দখলের, শ্রমিকদের লড়াই বাঁচার অর্থাৎ সমাজ বিপ্লবের। শ্রমিকের মাথা ঠেকে যায়, শোষণমূলক সমাজ-ব্যবস্থায় এক শ্রমিকের কোনো স্বাধীনতাই থাকে না। সাম্যের রাজনীতি তাই ভিন্ন রাজনীতি। সেখানে নেতারা রাতারাতি প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেবেন না, যেমনটা আমরা হামেশাই দেখে থাকি, সংগঠনই নেতৃত্ব সৃষ্টি করবে, বল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। শ্রমিকশ্রেণির যে লড়াই সব শ্রেণিকে মুক্ত করার সে- ই লড়াই আমাদের দেশেও চলছে, কিন্তু এখনো তা বেশিদূর এগোতে পারেনি। এই হয়ে সংগ্রামের নানা পর্যায়ে বহু মধ্যবিত্ত তরুণ যোগ দিয়েছে, প্রাণও দিয়েছে অকাতরে। তবু আন্দোলন যে ততটা এগোয়নি তার একটি কারণ বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনীতি শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। প্রভাবিত কেন বলছি, বুর্জোয়ারা তাদের গোষ্ঠীগত লড়াইকে শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিতে নিয়ে গেছে। যার ফলে প্রায়ই দেখা যায় ঐক্যবদ্ধভাবে মে দিবস উদযাপন করা গেল না। শ্রমিকশ্রেণির প্রধান শক্তি ঐক্য, সেই ঐক্য এখনো গড়ে ওঠেনি, কেননা তাদের শ্রেণিগত মুক্তি আনবে যে রাজনীতি; তা এখনো পুরোপুরি স্বাধীন হয়নি। তাই তো সাম্যের পথে এগোতে পারছি না আমরা। আর তাইতো স্বাধীনতা অর্থবহ হতে পারছে না, যে সত্য কারও পক্ষেই লুকিয়ে রাখা সম্ভবপর নয়। এর মধ্যেই শোষণহীন সমাজ তথা সাম্যের কথা বলা হয়, উদ্দেশ্য অন্য কিছু নয়, অসাম্য ও শোষণ টিকিয়ে রাখা ছাড়া। ‘আমরাও সাম্য চাই’ শাসকশ্রেণির কাছ থেকে এ বক্তব্য পাওয়া গেলে সাম্যের আন্দোলন দুর্বল হয় বৈকি, যেমন রাষ্ট্রভাষা বাংলা সবাই ‘চান’ বলেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠা এখন কষ্টকর হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে যে, ভিক্ষুকের হাত চাই না, কর্মীর হাত চাই। অবশ্যই। কিন্তু হাত যে বাঁধা পড়ে আছে শোষণের জিঞ্জিরে তার কী হবে? গণতন্ত্র আসেনি দেশে, কেননা বুর্জোয়ারা গণতন্ত্র চায় না, ক্ষমতার ভাগাভাগি চায় এবং ভাগাভাগির সুবিধার জন্য শ্রমজীবীকে বিভ্রান্ত করে। শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন চলবে, যেমন চলছে তা দেশে দেশে। তার বিজয়ও অবশ্যম্ভাবী, প্রলোভন ও নির্যাতন সত্ত্বেও। প্রশ্ন কেবল, কখন। নেতৃত্ব শ্রমিকশ্রেণিকেই দিতে হবে এবং আমাদের দেশে শ্রমিকের সহোদর ভাই বলতে কৃষককেও বোঝাবে, ভূমিহীন ক্ষেতমজুর তো বটেই। মে দিবস চিরদিন এভাবে পালিত হবে না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন