আবু তাহের খান
প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৫ মে ২০২৫, ০৭:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শুল্কহার পুনর্বিন্যাসে কী চুক্তি করবেন ট্রাম্প

শুল্কহার পুনর্বিন্যাসে কী চুক্তি করবেন ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চহারে বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তা নিয়ে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। আর এ তোলপাড় যত বাড়তে থাকে, নিজের স্বভাবসিদ্ধ রীতি অনুযায়ী তার কণ্ঠও তত উচ্চমার্গে পৌঁছতে শুরু করে। এর মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি চড়াও হন চীনের ওপর। চীনের ওপর প্রথমে ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলেও পরে তা দফায় দফায় বাড়াতে বাড়াতে ১৪৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়।

গত ৩ এপ্রিল বাড়তি শুল্কহার ঘোষণার পর থেকে এ বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথার উত্তাপ ও পদক্ষেপের রূঢ়তা দুই-ই প্রতিদিন একটু করে বাড়ছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু ৯ এপ্রিল, যেদিন বর্ধিত শুল্কহারের প্রয়োগ সবার ক্ষেত্রেই ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয় এবং এটিও ছিল বস্তুত একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। এর বাইরে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে তার চড়াওমুখিনতা কোথাও একমুহূর্তের জন্যও থামেনি। তবে শেষ পর্যন্ত মৃদুলয়ে হলেও আশার কথা যে, গত ১৯ এপ্রিল তিনি একযোগে অনেক নমনীয়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এক. চীনের ওপর আরোপিত শুল্কহার হ্রাস করে তাদের সঙ্গে বাণিজ্য-সংঘাত কমিয়ে আনা; দুই. ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড়করণ ও নতুন চুক্তি সম্পাদন; এবং তিন. শুল্কহার পুনর্বিন্যাস করতে এ বিষয়ে আগামী তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সব দেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা। বস্তুত শেষোক্ত এ চুক্তির বিষয়টিই এখন এ ক্ষেত্রে ক্ষতির মুখে পড়া দেশগুলোর আগ্রহের মূল ক্ষেত্র। অর্থাৎ সবাই এখন বুঝতে চাচ্ছে, আলোচ্য শুল্কহার নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এখন কী ধরনের চুক্তিতে পৌঁছতে চাচ্ছে।

ট্রাম্প যেরূপ এলোমেলো স্বভাবের মানুষ, তাতে শুল্কহারের বিষয়ে ১৯ এপ্রিল তিনি যে নমনীয়তার ইঙ্গিত দিলেন, শেষ পর্যন্ত সে দৃষ্টিভঙ্গি বহাল থাকবে কি না, তা কারও পক্ষেই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে, কয়েক দিন পরই তিনি আবার তার মতামত থেকে সরে গিয়ে উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করবেন। এরপরও তার ১৯ এপ্রিলের বক্তব্যকেই আপাতত চূড়ান্ত অভিমত হিসেবে ধরে নিয়ে এ বিষয়ে কিছু প্রক্ষেপণ দাঁড় করার চেষ্টা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে একেবারে প্রথম অনুমান হচ্ছে, গত ২ এপ্রিলের ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের যে সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র এখন হয়তো আবার সেখানেই ফিরে যাবে। এটি অনেকটা পণ্য বিক্রেতাদের সেই পুরোনো কৌশলের মতো, যেখানে অনেক বেশি দাম হাঁকিয়ে ক্রেতাকে বিভ্রান্তির ফাঁদে ফেলে তাদের কাছ থেকে চড়া মূল্য আদায় করা। চীনের ওপর ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের হুমকি যেন অনেকটা সেরকম, যাতে শেষ পর্যন্ত এ হার অন্তত ৩৪ শতাংশে এসে টিকে যায়। এখানে প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি শেষ পর্যন্ত চীনের ওপর সাধারণভাবে ৩৪ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপে সম্মতও হয়, তাহলেও এ হিসাবের বাইরে গিয়ে তারা চীন ও অন্যান্য দেশের ওপর পরোক্ষভাবে আরও কিছু ফি আরোপ করবে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে জাহাজের ওপর প্রযোজ্য নোঙর ফি। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানে অতি নাজুক অবস্থার মধ্যে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণশিল্পকে টিকিয়ে রাখা তথা এর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে নোঙর করার ক্ষেত্রে চীনসহ যে কোনো বিদেশি জাহাজের ওপর বর্ধিত হারের এ নোঙর ফি তারা আরোপ করবেই। আর স্পষ্টীকরণের জন্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এটি ঘটলে তা শুধু চীনের ক্ষেত্রে নয়—অন্যদের ক্ষেত্রেও সমহারে প্রযুক্ত হবে; তদুপরি এটি হবে সাধারণ আমদানি শুল্ক হারের অতিরিক্ত। বস্তুত চীন বা এরূপ কারও কারও ওপর আরোপিতব্য বড় মাত্রার শুল্কহারকে তুলনামূলকভাবে কম দেখানোর জন্যই জাহাজের ওপর এ বাড়তি নোঙর ফি আরোপ করা হচ্ছে। একই ধারায় ভবিষ্যতে হয়তো উড়োজাহাজের ওপরও টার্মিনাল ফি এবং এ জাতীয় অন্যান্য আরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরূপ বাড়তি ফি আরোপ করা হতে পারে, যেটি শুধু চীন নয়; সব দেশের জন্যই সমান উদ্বেগের।

তৃতীয় অনুমান হচ্ছে, আন্তর্জাতিক কূটনীতির নানা সমীকরণ, বিশ্ববাণিজ্যে কৌশলগত মিত্রত্ব রক্ষা এবং বহুবিধ দ্বিপক্ষীয় সামরিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো শেষ পর্যন্ত তার দীর্ঘকালীন মিত্র ইইউর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে চাইবে না। আর সে কারণে ২ এপ্রিলের ঘোষণায় ইইউর ওপর বাড়তি ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা হয়তো কমিয়ে যুক্তরাজ্যের পর্যায়ে অর্থাৎ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে (২ এপ্রিলের ঘোষণায় যুক্তরাজ্যের ওপর মাত্র ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা যে কোনো দেশের জন্য প্রস্তাবিত হারসমূহের মধ্যে সর্বনিম্ন)।

সে যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের পুনর্বিন্যাসকৃত শুল্কহারের যে প্রক্ষেপণটির জন্য বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষ এখন সবচেয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তা হলো—চীন ও ইইউ-বহির্ভূত অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এ শুল্কহার কেমন হবে? ধারণা করা যায়, মার্কিন বাজারে প্রবেশকারী পণ্য, তা সেটি যে দেশেরই হোক না কেন, সেটি যদি কোনো স্থানীয় মার্কিন পণ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়, উৎস বা দেশ নির্বিশেষে যুক্তরাষ্ট্র সেসব পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করবেই। সে ক্ষেত্রে কোন দেশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কী পরিমাণ পণ্য আমদানি করছে, তার ওপর ভিত্তি করে বর্ধিত শুল্কহার প্রস্তাব করা হয়েছে মর্মে যে কথা বলা হচ্ছে, সেটি আসলে একটি দৃশ্যমান অঙ্ক মাত্র। এর অন্তর্নিহিত মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশে মার্কিন শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করা। ফলে যারাই বাড়তি মার্কিন পণ্য কিনবে, তা সেটি উড়োজাহাজ কিংবা অস্ত্রসামগ্রী, মোটরযান কিংবা সাবমেরিন, রোবট কিংবা এআই পণ্য—সেই সুবাদে সংশ্লিষ্ট দেশ অবশ্যই কিছু না বাড়তি শুল্ক সুবিধা পাবে বলে আশা করা যায়। অবশ্য এরপরও মানতেই হবে যে, কূটনৈতিক দূতিয়ালিও এ ক্ষেত্রে কমবেশি কাজে আসবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি কুশলী কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সাধারণ হিসাব-নিকাশের বাইরে গিয়ে বাড়তি শুল্ক সুবিধা আদায় করতে পারে, তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় কাজ বলে বিবেচিত হবে।

ট্রাম্প যত এলোমেলো স্বভাবের মানুষই হোন না কেন, এটা নিশ্চয়ই তিনি বোঝেন যে, মার্কিনি এবং একই সঙ্গে তার নিজের স্বার্থে হলেও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পণ্যবাজার ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বিদেশি পণ্যের ওপর মাত্রাতিরিক্ত হারে শুল্ক বসাতে গেলে তা যে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি তথা উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করবে এবং কর্মসংস্থান পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবে, তা তো কোনোই সন্দেহ নেই। এমতাবস্থায় উচ্চহারের মার্কিনি শুল্কচাপ থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশের উচিত হবে অনতিবিলম্বে নৈপুণ্যপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যৌক্তিক সহানুভূতি আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। সে ক্ষেত্রে ট্রাম্প কর্তৃক ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্কহারের সবটুকু মওকুফ না হোক, অন্তত তা ১০ শতাংশের মধ্যে পুনর্নির্ধারণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে, দেশে একটি নির্বাচিত সরকার না থাকা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যত উচ্চতর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতাই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অবস্থানে তিনি পুরোপুরিই অনির্বাচিত। ফলে শুল্কহ্রাসের দেনদরবারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এটাও বোঝাতে হবে যে, অন্তর্বর্তী সরকার বস্তুত একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্যই কাজ করছে। অন্যদিকে শুধু প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত চেষ্টা ও ভাবমূর্তির দিকে তাকিয়ে না থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে অবিলম্বে এ বিষয়ে এমন একটি পেশাদারিত্বপূর্ণ ধারণাপত্র তৈরি করা, যেটি নিজেই শুল্ক হ্রাসের পক্ষের যুক্তিসমূহকে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হবে। ২ এপ্রিলের পর এরই মধ্যে এক মাস পেরিয়ে গেছে। ফলে কাজটি আগামী সপ্তাহখানেকের মধ্যে করে ফেলতে পারাটাই হবে উত্তম। কিন্তু তা হবে তো?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ঘোষণা অনুযায়ী এখন শুল্ক আরোপ নিয়ে ক্ষতির মুখে পড়া দেশগুলোর সঙ্গে কী ধরনের চুক্তিতে বা সমঝোতায় পৌঁছতে পারেন, সে বিষয়ের ওপর অতিসংক্ষেপে একটি প্রাথমিক ধারণা প্রদান করা হলো। অনুমান করা যায়, আসন্ন সপ্তাহগুলোতে এ ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে থাকবে। আর সেসব পরিবর্তনের সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উত্থাপিত শুল্ক সমস্যার একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সমাধান যদি সহসা পাওয়া যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কের সেটি একটি অনেক বড় অগ্রগতি হিসেবে গণ্য হবে বলেই আশা করা যায়।

লেখক: অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি; সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ দিনের সফরে ঢাকায় পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বাড়ল বাস ভাড়া

পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা হবে ক্লিন সিটি : চসিক মেয়র

জুলাই সনদে মিত্রদের ‘কাছাকাছি মতামত’ দেওয়ার পরামর্শ বিএনপির

সন্তানকে বাঁচিয়ে প্রাণ দিলেন বাবা

সৈকতে ফের ভেসে এলো মৃত ইরাবতী ডলফিন

ইঞ্জিন সংকটে ‘নাজুক’ রেল অপারেশন

স্পেনে রিয়ালের আর্জেন্টাইন তারকাকে নিয়ে অদ্ভুত বিতর্ক

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হলেন আবু তাহের

মানবিক ড্রাইভার গড়তে নারায়ণগঞ্জে ডিসির যুগান্তকারী উদ্যোগ

১০

গৃহকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় জাতীয় পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত

১১

পিএসসি সদস্য হলেন অধ্যাপক শাহীন চৌধুরী

১২

রিয়ালের হয়ে ইতিহাস গড়লেন আর্জেন্টিনার ‘মাস্তান’

১৩

দাম্পত্য কলহ এড়ানোর সহজ ৫ উপায়

১৪

‘গণতন্ত্রের জন্য আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হতে পারে’

১৫

আর্থিক খাত নিয়ে খারাপ খবর দিলেন গভর্নর

১৬

পৌরসভার ফাইল নিয়ে দুই কর্মকর্তার হাতাহাতি

১৭

কর্মস্থলে ‘অনুপস্থিত’, এবার পুলিশের ২ এসপি বরখাস্ত

১৮

এশিয়া কাপ দল নিয়ে তোপের মুখে বিসিসিআই

১৯

নারী-শিশুসহ ছয় ভারতীয় নাগরিক আটক

২০
X