আমাদের পৃথিবীতে এখন জলবায়ু দ্রুত বদলে যাচ্ছে আর একই সঙ্গে মানুষে মানুষে পার্থক্যও (বৈষম্য) বাড়ছে। এ সময়ে শুধু সুন্দর বিল্ডিং বানালেই চলবে না। স্থাপত্যের আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা, যা সবাইকে—বিশেষ করে গরিব ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের সুবিধা দেয়। তাই স্থাপত্য শিক্ষা এখন বদলাতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের স্থপতিরা পরিবেশবান্ধব ও সমাজের দিকে খেয়াল রাখে; এমন মানুষ হতে পারে।
এ পরিবর্তনের জন্য প্রথমেই দরকার আমাদের পড়াশোনার পদ্ধতি ও বিষয়গুলো বদলে ফেলা। জলবায়ু ও বৈষম্যের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো উচিত। যেন এগুলো শুধু আলাদা বিষয় না হয়, বরং শিক্ষার মূল অংশ হয়। প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীদের জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে চলা, পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরি, কম খরচে বাসস্থান, দুর্যোগ সহ্য করার ক্ষমতা আর মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির মতো বিষয় শেখানো দরকার। ডিজাইন ক্লাসেও নতুনভাবে ভাবা দরকার। যেমন শুধু জাদুঘর বা বড় বিল্ডিং নয়, বরং এমন ঘরের ডিজাইন করতে বলা যেতে পারে যেটা নদীভাঙা বা উপকূলের গরিব মানুষদের জন্য বানানো যাবে। শিক্ষার্থীরা স্থানীয় উপকরণ, প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের উপায় এবং সহজে তৈরি করা যায় এমন ডিজাইন নিয়ে কাজ করলে তাদের সৃজনশীলতাও বাড়বে। যদি শিক্ষার্থীরা মাঠে গিয়ে জলবায়ু-প্রভাবিত মানুষের সঙ্গে সরাসরি কাজ করতে পারে, বাস্তব সমস্যা বোঝে এবং সমাধান বের করতে পারে, তাহলে সেটা সত্যিই কাজে লাগে। এতে শিক্ষার্থীরা শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতি শিখতে পারে।
পরিবেশ রক্ষা ও টেকসই নির্মাণ নিয়ে বাস্তবভিত্তিক কাজ শিক্ষার্থীদের শেখানো উচিত। যেমন ভবনের কার্বন নির্গমন কেমন বা পুরোনো বাড়িগুলোকে কীভাবে কম খরচে ঠিক করা যায়—এমন কাজ তারা করতে পারে। এতে তাদের টেকনিক্যাল দক্ষতা আর সামাজিক দায়িত্ব একসঙ্গে বাড়ে। যদি স্থপতিরা পরিবেশ বিজ্ঞান, সমাজকর্ম, নগর পরিকল্পনা বা স্বাস্থ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে তারা বড় সমস্যাগুলো বুঝে কাজ করতে পারবে। একসঙ্গে ওয়ার্কশপ, সেমিনার বা প্রজেক্ট করলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও বড় হয়।
প্রতি বছর ডিজাইন প্রতিযোগিতা আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে বাস্তব সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা থাকবে—যেমন শহরের তাপ কমানো, বস্তি উন্নয়ন বা জলবায়ু-আক্রান্ত এলাকায় স্কুল বানানো। যদি এ প্রজেক্টগুলো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে মিলে বাস্তবে করা যায়, তাহলে এর প্রভাব সমাজেও পড়বে। শিক্ষকরা ক্লাসে বা প্রজেক্টে বারবার বুঝিয়ে দিতে পারেন স্থাপত্য মানে শুধু বিল্ডিং না, এটি সমাজ ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্বও। সফল সামাজিক প্রকল্পের উদাহরণ—যেমন শহরের সবুজ উন্নয়ন শিক্ষার্থীদের শেখানো যেতে পারে, যাতে তারা বুঝতে পারে স্থপতিরাই অনেক পরিবর্তন আনতে পারে। আগে শুধু বড়, ঝলমলে ডিজাইনকে সফল বলা হতো। এখন দরকার ছোট কিন্তু কাজে লাগে এমন ডিজাইনকে গুরুত্ব দেওয়া। শিক্ষার্থীদের কাজ বিচার করার সময় শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং পরিবেশ, সমাজের উপকার আর ব্যবহারকারীর অংশগ্রহণ—এ জিনিসগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। তবে আমাদের দেশের গ্রামীণ এলাকার অবস্থা এখনো অনেক জায়গায় পিছিয়ে রয়েছে—বাসস্থান দুর্বল, স্বাস্থ্যসেবা সীমিত, শিক্ষার সুযোগ কম আর পরিবেশগত সমস্যা বাড়ছে। এ অবস্থায় শুধু শহরেই উন্নয়ন ঘটালে চলবে না। স্থাপত্য শিক্ষার্থীদের উচিত গ্রামকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখা। গ্রামীণ এলাকার মানুষদের চাহিদা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা শহরের থেকে আলাদা। তাই তাদের জন্য পরিকল্পনা করতে হলে আগে তাদের জীবন, সমস্যা ও প্রয়োজন বোঝা জরুরি। স্থাপত্য শিক্ষার্থীরা যদি মাঠে গিয়ে গ্রামের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে তারা দেখতে পাবে কীভাবে অল্প খরচে, স্থানীয় উপকরণ দিয়ে, জলবায়ু উপযোগী ঘর তৈরি করা যায়।
একজন স্থপতি হিসেবে ভবিষ্যতে যারা কাজ করবে, তাদের এখন থেকেই জানতে হবে কীভাবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন বা খরাপ্রবণ এলাকায় টেকসই ঘর ও স্থাপনা বানানো যায়। তাদের উচিত এমন ডিজাইন শেখা ও করা, যেগুলো সহজে বানানো যায়, মেরামত করা যায় এবং যেগুলো পরিবেশের ক্ষতি না করে বরং রক্ষা করে। যেমন গ্রামে যদি স্কুল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানাতে হয়, তাহলে সেটা যেন প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস চলাচল সুবিধাজনক হয়; যেন বিদ্যুৎ ছাড়া দিনেও কাজ চালানো যায়।
গ্রামে কাজ করতে গেলে শুধু স্থাপত্য জ্ঞান থাকলেই হবে না, দরকার সহানুভূতি আর শ্রদ্ধা। গ্রামের মানুষদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যদি তাদের সঙ্গে মিলে বসে কথা বলে, তাহলে তারা বুঝতে পারবে কীভাবে স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ডিজাইনে ব্যবহার করা যায়। এতে স্থাপত্য শুধু একজন পেশাদারের চিন্তা হবে না, বরং জনগণের প্রয়োজন ও ভাবনার মিলনস্থল হয়ে উঠবে। স্থাপত্য শিক্ষার্থীদের জন্য এখন সময় এসেছে নতুনভাবে চিন্তা করার। শহরের আধুনিকতা নয়, গ্রামের বাস্তবতা তাদের ভাবনায় আসা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ই তারা নানা প্রকল্পে গ্রামের সমস্যা নিয়ে কাজ করতে পারে। যেমন নদীভাঙা এলাকায় কেমন ঘর টিকবে, খালপাড়ে স্কুল কীভাবে বানানো যায় বা কৃষকের জন্য সস্তা ও কার্যকর বাজার বানানো যায় কি না, এসব নিয়ে ছোট ছোট প্রজেক্ট করা যেতে পারে।
দেশের উন্নয়ন মানেই শুধু শহরের উঁচু দালান নয়, বরং গ্রামের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। সেই কাজে স্থাপত্য শিক্ষার্থীরা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তারা যদি এখন থেকেই গ্রামীণ বাস্তবতা বোঝে এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা গড়ে তোলে, তাহলে ভবিষ্যতের স্থপতিরা সত্যিকারের সমাজের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবে। দেশ তখনই এগোবে, যখন শহর-গ্রাম মিলিয়ে সবাই ভালো থাকবে। আর এ স্বপ্নপূরণে আজকের শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বড় ভরসা। শিক্ষার্থীদের শুরু থেকেই প্রযুক্তি শেখানো উচিত—যেমন এনার্জি মডেলিং, জিআইএস ম্যাপিং বা জনগণের মতামত নেওয়ার ডিজাইন পদ্ধতি। এতে তারা জলবায়ু ঝুঁকি বুঝতে ও পরিকল্পনা করতে পারবে। প্রতিটি ব্যাচ যদি কোনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত কাজ করে, তাহলে শিক্ষার্থীরা শিখবে ধৈর্য, প্রতিশ্রুতি আর ধারাবাহিক চেষ্টাই সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারে। স্থাপত্যের ক্লাসরুম এখন এমন জায়গা হওয়া উচিত যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু ডিজাইন শেখে না, বরং পরিবেশ ও সমাজের জন্য কিছু করার মানসিকতাও তৈরি করে। আমরা চাই এমন স্থপতি যারা শুধু ধনী ক্লায়েন্টের জন্য কাজ করবে না, বরং সমাজ ও পৃথিবীর জন্যও চিন্তা করবে। এ দায়িত্ব এখন আমাদের শিক্ষকদের, যারা ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করবেন।
লেখক: স্থপতি, শিক্ষাবিদ এবং চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান
মন্তব্য করুন