মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন কারণে মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতার বিষয়টি যেন এখন নিয়মিত দৃশ্য। এটি যে কোনো সমাজের জন্যই একটি নেতিবাচক দিক তো বটেই, বরং সার্বিকভাবে একটি অশনিসংকেত।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চুরির অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আবদুল হান্নান নামে এক যুবককে দড়ি দিয়ে গাছের ডালে উল্টো করে ঝুলিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়। অবশ্য গণমাধ্যমের খবরের আগেই নির্যাতনের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সমালোচনার ঝড় ওঠে সর্বত্র। শনিবার ঘটনাটি ঘটে কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ভাউকসার ইউনিয়নের চৌত্তাপুকুরিয়া গ্রামে। ভিডিওতে দেখা যায়, জনসমক্ষে আবদুল হান্নানের দুই পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে রেখে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দড়ি দিয়ে দুই পা বাঁধা ঝুলন্ত ওই যুবকের মাথার অংশ দোকানের সামনের একটি ড্রেনের ওপর মাটির কাছাকাছি রয়েছে। তাকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছেন ইউপি সদস্য জহিরুল। এ সময় ওই যুবক কাকুতি-মিনতি করে বলছেন, ‘আমাকে বাঁচান, আমি চুরি করিনি।’ এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং সমাজে এ মানবিক অবক্ষয় নিঃসন্দেহে উদ্বেগের।
এ বর্বর ঘটনা নতুন নয়। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে চুরির অপবাদে নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় রাতভর নির্যাতন করা হয় এক কিশোরকে। কিশোরটির মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে তার পরিবারকে জরিমানা করে দুই মাতব্বর স্থানীয় ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া ও আবু তাহের। এ ঘটনায়ও দেখা যায়, স্থানীয় লোকজনের সাথে ওই ওয়ার্ডের সবুজ মেম্বার, হাদিস মেম্বার, আবু তাহেরসহ আরও বেশ কয়েকজন রাতভর মারধর করে কিশোরটিকে। এ বছরের এপ্রিলে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে সোহান (১৫) নামে এক কিশোর অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। একটি টিউবওয়েল সকেট চুরির অভিযোগে বেদম মারধর করা হয়। পরে তাকে একটি মাছ ধরার প্রকল্পে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটি প্লাস দিয়ে শরীরের চামড়া টেনে টেনে নির্যাতন করা হয়। অমানবিক নির্যাতন সইতে না পেরে ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে কিশোর। চলতি বছর জানুয়ারিতে মাগুরার শালিখা উপজেলায় চোর সন্দেহে ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর (১২) পায়ে পেরেক ঢুকিয়ে ও হাতুড়িপেটা করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় চোর সন্দেহে শহিদুল (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে চোখে কাপড় বেঁধে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে তার গোপনাঙ্গে আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়া হয়। কিন্তু এসব ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নজির আমরা দেখি না।
বিভিন্ন সময়ে ঘটা এমন অসংখ্য অমানবিক ঘটনা রয়েছে। শিশুর পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে নির্যাতনে নিহতের ঘটনাসহ এমন উদাহরণও কম নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে? মানুষের মানবিক অনুভূতির এ দৈন্যদশার প্রকৃত কারণ কী?
আমরা মনে করি, বিচারহীনতা, বিচার-প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার সংস্কৃতি এসব বীভৎস ঘটনা বারবার ঘটার অন্যতম কারণ। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার সুরক্ষার প্রতি আরও সংবেদনশীল হতে পারলে সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সমাজে কোনো অন্যায়-অপরাধ হতে দেখলে দলগতভাবে তাকে প্রতিরোধ করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক অপরাধপ্রবণতা প্রতিরোধে গণসচেতনতা জরুরি। এর জন্য দরকার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
কুমিল্লার ঘটনায় স্থানীয় ইউপি সদস্যকে আটক করায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ। এখন এ ঘটনায় জড়িতদের তদন্তসাপেক্ষে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন