ঢাকা শহরটা যেন এক বিশাল হেড অফিস! এখানে অফিসের সংখ্যা এত বেশি যে, মনে হয় অফিসেই মানুষ থাকে, বাসায় শুধু রাত কাটায়। ঢাকার যে কোনো মোড়ে দাঁড়ান, সামনে অফিস, পেছনে অফিস, ডানে অফিস, বাঁয়ে অফিস—এমনকি চায়ের দোকানেও ‘অফিস টাইম’ লেখা থাকে।
এখানে শুধু যে কোম্পানির হেড অফিস তাই না, স্যুট-কোট পরে রিমোট জব করা ফ্রিল্যান্সারও ভাবে, ‘না ভাই, ঢাকায় একটা অফিস নিয়ে বসি!’ ফলে অফিস বাড়ছে আর মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা কমছে।
সরকার মাঝেমধ্যে বলে, ‘বিভাগীয় শহরগুলোতে অফিস সরিয়ে নেওয়া হবে!’ শুনে ঢাকাবাসী আশায় বুক বাঁধে, আবার পরের সপ্তাহেই নতুন এক হেড অফিস উদ্বোধনের খবর আসে। যেন ঢাকার ওপর কেউ হেড অফিস ঢেলে দিয়েছে!
এই শহর কি কখনো বদলাবে? নাকি একদিন এত অফিস হবে যে, ঢাকার নামই পাল্টে রাখা হবে ‘হেড অফিস সিটি?’ উত্তর জানা নেই।
এতসব হেড অফিসের ফল—অলটাইম ঢাকায় যানজট। ঢাকার যানজটকে যদি ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, একটুও অবাক হওয়া যাবে না। এ মহানগরের যানজট শুধু একটা সমস্যা নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর খানিকটা কপালও বটে।
ঢাকার রাস্তায় যানজট এমন এক মহৎ দৃশ্য, যেন প্রকৃতি নিজেই বলছে—‘চলো, একটু থামি, জীবনের গভীর তাৎপর্য খুঁজি।’ সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হওয়া মানে একটা অ্যাডভেঞ্চার গেমে প্রবেশ করা। প্রথম লেভেল: বাসের জন্য অপেক্ষা। দ্বিতীয় লেভেল: বাসে উঠতে গিয়ে পা মচকানো। তৃতীয় লেভেল: এক ঘণ্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা, যেন তুমি কোনো জেন মাস্টার ধ্যানে বসেছ।
ঢাকার যানজটে একটা গাড়ি থেকে আরেক গাড়ির ফাঁক এতটাই কম যে, মনে হয় ড্রাইভাররা সবাই ‘টেট্রিস’ খেলছে। আর হর্ন? ওটা তো ঢাকার জাতীয় সংগীত! প্রতিটি হর্নের আওয়াজে একেকটা গল্প—কেউ বাজাচ্ছে বিরক্তিতে, কেউ আনন্দে আর কেউ শুধু প্রমাণ করতে যে তার হর্ন এখনো কাজ করে। আর ট্রাফিক পুলিশ? তারা যেন মহাকাব্যের সেই নিরপেক্ষ দেবতা, যারা সব দেখেন কিন্তু হাত নাড়া ছাড়া আর কিছু করেন না। তাদের হাতের ইশারা এত রহস্যময় যে, ড্রাইভাররা ভাবে, ‘এটা কি এগোতে বলছে, না নাচতে বলছে?’
অনেকে বলে, জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। কিন্তু এই শহরে লেন মেনে চলার চেয়ে ‘চাঁদের মাটিতে হাঁটা সহজ’। কেউ কেউ আবার মনে করেন, বাইসাইকেল চালালে যানজট কমবে। তাদের বলি— ভাই, ঢাকায় বাইসাইকেল চালানো মানে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে বাসের এক্সস্ট পাইপের সুবাস গ্রহণ করা।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ঢাকার মানুষ এতটাই যানজটে অভ্যস্ত যে, তারা এটা ছাড়া বাঁচতেই পারে না। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম না থাকলে মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে—‘কোথাও কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।’ যানজট ঢাকার মানুষের কাছে এখন আর সমস্যা না, এটা তাদের ‘লাইফস্টাইল’।
একটা যুগান্তকারী সমাধান হতে পারে—যানজটকে ঢাকার ‘পর্যটন আকর্ষণ’ বানিয়ে দেওয়া যায় কি না। বিদেশিদের বলা হবে, ‘আসুন, যানজট দেখুন, জ্যামে বসে চা খান, পরিচিত হোন আমাদের ট্রাফিক সিস্টেমের জাদুর সঙ্গে!’
ঢাকার যানজটে গাড়ির হর্ন একটা সিম্ফনি। সামনের গাড়ি এক ইঞ্চি নড়লেই পেছন থেকে হর্ন বাজে, যেন বলছে, ‘ভাই, তুমি নড়লে আমার জীবনের সব সমস্যা মিটে যাবে।’ আর রিকশাওয়ালারা? তারা তো যানজটের নিনজা। একটা ফুটপাত, একটা গলি, এমনকি দুই গাড়ির মাঝের অদৃশ্য ফাঁক দিয়েও তারা হাওয়ার মতো বেরিয়ে যায়। আমরা বাকিরা শুধু বসে বসে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, ‘এই শহরে বোধহয় রিকশাই ভবিষ্যৎ।’
বাসের কন্ডাক্টরদের কথা না বললেই নয়। তারা যানজটে আটকে থাকা বাসের দরজায় ঝুলে চিৎকার করে, ‘ধানমন্ডি-মিরপুর-উত্তরা, আসেন আসেন’—শুনে মনে হয়, এ বাসটা যানজট পেরিয়ে সোজা মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছে।
যানজটে সময় কাটানোর জন্য ঢাকাবাসীরা অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছে। কেউ ফোনে সিরিজ দেখে, কেউ সামনের গাড়ির নাম্বার প্লেট থেকে কবিতা বানায় আর কেউ কেউ ঝিমিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে—এমন গভীর ঘুম যে, গাড়ি নড়লে বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আরেকটু থাম না, ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে।’
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সরকারি ফ্লাইওভার আর মেট্রোরেলের কথা। ফ্লাইওভার বানানো হয়েছে যানজট কমাতে, কিন্তু ফ্লাইওভারের নিচে আরেকটা যানজট জন্ম নিয়েছে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পরও রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমেনি, কারণ ঢাকার মানুষের ধারণা, ‘গাড়ি না থাকলে লোকে কী ভাববে?’ তাই গাড়ি থাকবে, যানজট থাকবে আর আমরা থাকব—এই অমর প্রেমকাহিনির নায়ক-নায়িকা হয়ে।
লেখক: সাংবাদিক, দৈনিক কালবেলা
[প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্য ও দায়িত্ব লেখকদের নিজস্ব]
মন্তব্য করুন