জাদুঘর সমাজের দর্পণ। জাদুঘর জাতির শিকড় সন্ধান করে। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যত ঐতিহাসিক নিদর্শন জমা হচ্ছে, তারই প্রতিচ্ছবি হলো জাদুঘর। জাদুঘর মানেই হারিয়ে যাওয়া ব্যতিক্রমী অদ্ভুত জিনিসের সংগ্রহশালা। জাদুঘর জাতির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিশাল সংগ্রহভান্ডার। এ সমৃদ্ধ সংগ্রহের মাধ্যমে জাদুঘর জনগণের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করে।
জাদুঘর বলতে বোঝায় এমন একটি ভবন বা প্রতিষ্ঠান যেখানে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের সংগ্রহ সংরক্ষিত থাকে। জাদুঘরে বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বস্তুসমূহ সংগ্রহ করে সংরক্ষিত করা হয় এবং সেগুলো আঁধারের মধ্যে রেখে স্থায়ী অথবা অস্থায়ীভাবে জনসাধারণের সমক্ষে প্রদর্শন করা হয়। ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি বহন করে জাদুঘর। এখানে অদ্ভুত ও উদ্ভট সবকিছুর সংগ্রহ দেখা ও জানার কৌতূহল নিয়ে দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে।
মাউসিয়ন থেকে জাদুঘর। জাদুঘর শব্দটির উৎপত্তি ধ্রুপদি বা আভিজাত্যপূর্ণ। গ্রিক ভাষায়, মাউসিয়নের অর্থ মিউজদের আসন এবং এটি দার্শনিক প্রতিষ্ঠান বা চিন্তাভাবনার স্থানকে নির্দেশ করে। জাদুঘরে ইংরেজি মিউজিয়াম শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ থেকে। ২৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর এই প্রথম জাদুঘরে ছিল নিদর্শন-সংগ্রহশালা ও লাইব্রেরি, ছিল উদ্ভিদউদ্যান ও উন্মুক্ত চিড়িয়াখানা। তবে এটা ছিল মূলত দর্শন চর্চাকেন্দ্র।
পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যত ইতিহাস জমা হচ্ছে, তারই প্রতিচ্ছবি হলো জাদুঘর। জাদুঘরের ইংরেজি মিউজিয়াম শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ মিউজয়ন থেকে, যার অর্থ কাব্যাদির অধিষ্ঠাত্রী দেবীর মন্দির। বাংলায় জাদুঘর কথার অর্থ হলো, যে গৃহে অদ্ভুত অদ্ভুত পদার্থসমূহের সংগ্রহ আছে এবং যা দেখে মন্ত্রমুগ্ধ বা বশীভূত হতে হয়। তবে জাদুঘরে যে এক ধরনের মায়া আছে, তা অনস্বীকার্য। জাদুঘরের এ সত্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মায়া; রয়েছে বিস্ময়, যা দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হতে হয়।
উপমহাদেশে জাদুঘরের ধারণাটি এসেছে ব্রিটিশদের মাধ্যমে। এ অঞ্চলের জাতিতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ভূতাত্ত্বিক এবং প্রাণীবিষয়ক নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যাপারে উদ্যোগী হন ভারতীয় এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যরা। ১৮০৮ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির পৃষ্ঠপোষক লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে জমি দিয়ে জাদুঘরের জন্য ভবন নির্মাণ করেন। ১৮১৪ সালে উপমহাদেশের প্রথম জাদুঘর এশিয়াটিক সোসাইটি মিউজিয়ামের জন্ম ও প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মোট ১৮০টি দেশের ২৮ হাজার জাদুঘর যুক্ত রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিশাল সংগ্রহভান্ডার। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি হাজার হাজার দর্শক জাদুঘর পরিদর্শন করে দেশের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জানতে পারছে। বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর হচ্ছে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। ১৯১০ সাল দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় শরৎকুমার রায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯১৩ সালে। বাংলাদেশে শতাধিক জাদুঘর আছে। তবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরই দেশের প্রধান জাদুঘর হিসেবে বিবেচিত। জাতীয় জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, বরেন্দ্র জাদুঘরসহ পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে এসব জাদুঘর; যা ইতিহাস সংরক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষা, গবেষণা এবং বিনোদনের খোরাক মেটাচ্ছে বাঙালির।
পৃথিবীর বিখ্যাত জাদুঘরগুলোর মধ্যে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম, প্যারিসে গিমে জাদুঘর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে মাদাম তুসোর মোমের জাদুঘর, ব্রিটিশ মিউজিয়াম, রোমান ক্যাথলিক চার্চের ভ্যাটিকান জাদুঘর, যুক্তরাষ্ট্রের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, মিশরীয় ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম, স্পেনের মাদ্রিদে প্রাদো মিউজিয়াম, ইতালির উজিফি গ্যালারি ইত্যাদি। আর বিশ্বের সব থেকে ছোট জাদুঘরগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ওয়ারলে মিউজিয়াম। এটি দেখতে একটি পুরোনো টেলিফোন বক্সের মতো। বিশ্বের বৃহত্তম জাদুঘর হলো প্যারিসের ল্যুভর জাদুঘর, যেখানে ৩৫ হাজারের বেশি শিল্পকর্ম রয়েছে। আমস্টারডামে যে জাদুঘাটি রয়েছে, সেটি দেখতে অনেকটা একজন মানুষের মতো।
জাদুঘরগুলো আমাদের অতীতের জীবন্ত স্মৃতি এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০৩টি জাদুঘর রয়েছে। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু জাদুঘর—ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘর, আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, সোনারগাঁয়ে চারু ও কারুশিল্প জাদুঘর, বুড়িগঙ্গার তীরে আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, ঢাকার পলাশীতে আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর, ঢাকার নিমতলা এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর, ঢাকার বিজয় সরণিতে বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর, ঢাকার রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী জাদুঘর, ঢাকা মিরপুরে বাংলাদেশ মুদ্রা জাদুঘর, ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বিজয় কেতন জাদুঘর, ঢাকার সোনারগাঁও শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, রংপুর জাদুঘর, রংপুরের তাজহাট প্যালেস রংপুর জাদুঘর, লোকায়ন জীবন বৈচিত্র্য জাদুঘর, খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর, ময়মনসিংহ জাদুঘর, জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা, রাঙ্গামাটিতে উপজাতীয় সাংস্কৃতিক জাদুঘর, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, সিলেটে ওসমানী জাদুঘর। তা ছাড়া বর্তমানে জেলা ও উপজেলা শহরে জাদুঘর গড়ে উঠেছে।
জাদুঘরের নিদর্শনগুলো ইতিহাসের সাক্ষী। তবে সব জাদুঘরই পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংগ্রহশালা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা এমন ভিন্ন রকমের জাদুঘর রয়েছে। মেক্সিকোর ক্যারিবীয় সাগর উপকূলে জলতলের কানকুন জাদুঘর, রাশিয়ায় ভাঙা সম্পর্কের নিদর্শন জাদুঘর, ভারতের নয়াদিল্লিতে টয়লেট জাদুঘর, নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে বিড়ালদের জাদুঘর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গণিতের জাদুঘর। এমন অদ্ভুত ও উদ্ভট দারুণ মজার জাদুঘরের কিছু নিদর্শন দেখার সুযোগ পান দর্শনার্থীরা।
প্রকাশ ঘোষ বিধান
পাইকগাছা, খুলনা
মন্তব্য করুন