নিজের চামড়া ফেলা দাও, বিদেশেরটা গায়ে চড়াও—এ বাক্যটি এখন আর শুধু একটি ব্যঙ্গ নয়, বরং চামড়া খাত নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার নগ্ন প্রতিফলন। একদিকে ঈদুল আজহার মতো উৎসবে লাখ লাখ পশু কোরবানির মাধ্যমে দেশে বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংগৃহীত হয়, অন্যদিকে প্রতি বছর আমদানির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার প্রক্রিয়াজাত চামড়া বিদেশ থেকে আনতে হয়। এ চিত্র শুধু বাণিজ্য ঘাটতির নয়, এটি রাজনৈতিক ও নীতিগত ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশ প্রতি বছর ঈদের সময় কমবেশি এক কোটি কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ (বিশেষত ছাগলের চামড়া) সংরক্ষণের অভাবে পচে যায়। এ চামড়া ফেলে দেওয়া বা মাটিচাপা দেওয়ার কারণে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। মূলত চামড়া সংরক্ষণে ত্রুটি, হিমায়িত পরিবহনের অভাব, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা ও অগ্রিম অর্থায়ন না থাকায় এমন অপচয় হয়। ফলে একদিকে কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়, অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে অস্থিরতা ও অনাস্থা জন্ম নেয়।
অপচয়ের এ বাস্তবতার মধ্যেই ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ১১ হাজার ৭১৮ টন চামড়া আমদানি করেছে। এজন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। এ আমদানিকৃত চামড়া দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন রপ্তানিযোগ্য পণ্য—জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ইত্যাদি। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ পরিমাণ চামড়া যদি দেশেই উৎপন্ন হতো, তাহলে এত বিপুল অর্থ বিদেশে চলে যেত না।
বাংলাদেশে উৎপাদিত চামড়ার একটি বড় অংশই আন্তর্জাতিক বাজারের মানদণ্ড পূরণ করতে পারে না। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো যেমন নাইকি, অ্যাডিডাস তাদের চামড়া সংগ্রহ করে শুধু এলডব্লিউজি (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ) সার্টিফায়েড ট্যানারি থেকে। অথচ বিশ্বের প্রায় ১ হাজার ২৮৫টি ট্যানারি এ সার্টিফিকেশন অর্জন করলেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাত্র সাতটি ট্যানারি এ মান অর্জন করতে পেরেছে। এ ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হচ্ছে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থাপিত সিইটিপি (সেন্ট্রাল এফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) সম্পূর্ণরূপে কার্যকর নয়। নির্ধারিত পরিশোধন ক্ষমতা থাকলেও কোরবানির মৌসুমে চাহিদা ছাড়িয়ে যাওয়ায় বর্জ্য যথাযথভাবে শোধন করা সম্ভব হয় না। ফলে পরিবেশ দূষণের কারণে এলডব্লিউজি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের ট্যানারি পরিদর্শনই বন্ধ করে দিয়েছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশি ট্যানারিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে সরাসরি প্রবেশ করতে পারে না। তারা বাধ্য হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে কমমূল্যে চামড়া বিক্রি করতে। অন্যদিকে বিদেশি ফিনিশড চামড়া আমদানি করে নিজেদের রপ্তানির চেইন বজায় রাখে।
২০০৩ সালে পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গঠনের ঘোষণা দিয়ে হেমায়েতপুরে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল পুরোনো ট্যানারিগুলোকে ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসম্পন্ন শিল্প এলাকা গড়ে তোলা। কিন্তু দুই দশক পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটি আজও অসম্পূর্ণ। ১৫৪টি ট্যানারির মধ্যে ১৪২টি চালু থাকলেও সিইটিপি এখনো আংশিক কাজ করে, ফলে নির্গত বর্জ্য ঠিকমতো পরিশোধিত হয় না। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ডাম্পিং ইয়ার্ডের দুর্বলতার কারণে ধলেশ্বরী নদী ভয়াবহ দূষণের শিকার, যা দেশের চামড়াশিল্পকে পরিবেশগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে পরিণত করেছে।
ঈদুল আজহার সময় উৎপাদিত চামড়ার প্রায় ৯০ শতাংশ স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়। কিন্তু এ বাজারে নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী, নেই মূল্য নির্ধারণের স্বচ্ছতা, নেই অগ্রিম অর্থায়নের নিশ্চয়তা। ৮৫ শতাংশ বিক্রেতা অপ্রশিক্ষিত এবং প্রান্তিক পর্যায়ে চাঁদাবাজি, পরিবহন দুর্নীতি ও হাটব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা চামড়ার দামে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যবসায়ীদের ৬৫ শতাংশের বেশি মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চামড়া কিনে থাকে, যেটি মূলত অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির অংশ। ফলে সরকার নির্ধারিত দাম বাস্তবায়ন হয় না, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চামড়াশিল্পে যুক্ত রয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়, বিসিক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতো একাধিক সংস্থা, কিন্তু তাদের মধ্যে নেই কার্যকর সমন্বয়। ২০১৭ সালে সিইটিপি অপূর্ণ থাকা অবস্থায় ট্যানারি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত এক বড় ধরনের অব্যবস্থাপনার জন্ম দেয়। আমদানি ও রপ্তানি নীতিতে ঘন ঘন পরিবর্তন, শুল্ক সুবিধা নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং আমলাতান্ত্রিক হয়রানি উদ্যোক্তাদের জন্য আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা। ফলে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
চামড়ার মৌসুমে লবণের সংকট, বাড়তি দাম ও হিমায়িত পরিবহনের অভাবে অনেক সময় কাঁচা চামড়া দ্রুত পচে যায়। দেশে এখনো কেন্দ্রীয় কোনো লবণ ডিপো গড়ে ওঠেনি, যা মৌসুমি চাহিদা মেটাতে পারত। ট্যানারিদের ৭৮ শতাংশই মনে করেন, কেন্দ্রীয় লবণ ডিপো স্থাপন এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প রাজনৈতিকভাবে একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত, যা সরকারের নির্বিচার সহায়তা, অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও বৈদেশিক নীতির সুবিধা ভোগ করে আজ বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিপরীতে চামড়াশিল্প রাজনৈতিক সদিচ্ছা থেকে বঞ্চিত। এটি একটি ভোট-অপ্রাসঙ্গিক খাত হওয়ায় এর উন্নয়ন পরিকল্পনা থাকে মুখবন্ধে, বাস্তবায়নে নয়। ফলে কর্মসংস্থানের দিক থেকেও পিছিয়ে। পোশাকশিল্প যেখানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষকে কাজ দিয়েছে, সেখানে চামড়াশিল্প এখনো আড়াই লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
চামড়াশিল্পকে দাঁড় করাতে হলে প্রয়োজন নির্দিষ্ট ও কার্যকর উদ্যোগ। সিইটিপি সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করে পরিবেশদূষণ বন্ধ করতে হবে। অন্তত ২০টি ট্যানারিকে এলডব্লিউজি সার্টিফায়েড করতে প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক সহায়তা দিতে হবে। কাঁচা চামড়ার সুষ্ঠু সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় লবণ ডিপো স্থাপন এবং পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। পাশাপাশি মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা আনা, অগ্রিম অর্থায়নের সুযোগ বৃদ্ধি এবং ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাজার ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনতে হবে। সর্বোপরি, ২০১৯ সালে গৃহীত ‘চামড়া শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা’ বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহি প্রয়োজন।
বাংলাদেশের চামড়াশিল্প সম্ভাবনাময় এক খাত, যা নিজস্ব কাঁচামাল, দক্ষ জনবল এবং ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে শুধু ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের কারণে। এ খাতের সংকট কোনো প্রযুক্তিগত সমস্যার নয়, এটি মূলত নৈতিক, নীতিগত এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। যেদিন এ শিল্পকে শুধু একটি খাত নয়, বরং একটি দায়িত্ব ও সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হবে, সেদিন চামড়াশিল্পও পোশাকশিল্পের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠবে।
l আগামীকাল পড়ুন: চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ গন্তব্য
লেখক: সাংবাদিক
মন্তব্য করুন