সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৯ মে ২০২৫, ০৭:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সমাজবিপ্লবীদের যুক্তফ্রন্ট জরুরি

সমাজবিপ্লবীদের যুক্তফ্রন্ট জরুরি

বাংলাদেশের পুঁজিবাদী উন্নয়ন ধারার অভ্যন্তরে গ্রামাঞ্চলে নীরবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেছে; সেটি হলো, ঘরের তো অবশ্যই, ঘরের বাইরেও মেয়েদের ক্ষমতাবৃদ্ধি। ধর্ষণ যেমন সত্য, এই ক্ষমতায়নও তেমনি সত্য। মাগুরার ধর্ষিতা মেয়েটির মা যেভাবে সংসারের হাল ধরেছেন, সেভাবে বিপুল, কোথাও কোথাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েরাই সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যে পুরুষ আয়-রোজগার করেন, তিনি ঘরের বাইরে থাকেন; শহরে যান, চলে যান বিদেশে; কর্তৃত্ব তাদেরই, ব্যবস্থাটা নির্ভুলভাবেই পিতৃতান্ত্রিক। কিন্তু সংসার চালাতে হয় মেয়েদেরই। সন্তান পালন, পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা, বিবাহ, খাওয়াদাওয়া, অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা, খরচপাতি সবকিছু মেয়েদের ব্যবস্থাপনাতেই চলে। শহরেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংসারের দায়িত্বগুলো মায়েরাই পালন করেন।

মেয়েরা বেরিয়ে এসেছেন। তারা শহরের কারখানায় কাজ করেন, কাজের খোঁজে মধ্যপ্রাচ্যে পর্যন্ত চলে যান এবং নিগৃহীত হন; দেশে ও বিদেশে। তবে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে যেটা দেখা গেল তা হলো মেয়েদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ। আমাদের সব আন্দোলনেই মেয়েরা থেকেছেন, কিন্তু এবার যে সংখ্যায় ও দৃঢ়তার সঙ্গে অংশ নিয়েছেন, তেমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি। অনেক জায়গায় মেয়েরাই ছিলেন সামনের কাতারে এবং তাদের সামনে থাকাটা ছেলেদের সাহস, এমনকি আপেক্ষিক নিরাপত্তাও বৃদ্ধি করেছে। মাগুরার মেয়েটির ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ দেখা গেছে, তাতে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের চেয়েও শক্তিশালী। তারা বিক্ষোভ করেছেন এবং ঢাকায় সাদা পুলিশ সদস্যদের দ্বারা প্রহৃত পর্যন্ত হয়েছেন। মেয়েদের এই জাগরণ আশা জাগায়।

তবে তাদেরকে, যেমন ছেলেদেরও আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। সংস্কারে কুলাবে না। প্রয়োজন হবে সামাজিক বিপ্লবের। সংস্কার আগেও হয়েছে, আগামীতে আরও হবে, কিন্তু তাতে মূল যে সমস্যা, পুঁজিবাদী উন্নয়ন—সে সমস্যার সমাধান হবে না। পুঁজিবাদী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা বদলাবে না। সংস্কার বরং তাকে রক্ষা করতেই চাইবে।

সম্প্রতি কলকাতায় মেয়েরা একটি অসাধারণ আন্দোলন করেছেন। ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন ভারতে এবং কলকাতাতেও, আগেও হয়েছে; কিন্তু এবারেরটি ছিল কিছুটা ভিন্ন রকমের—যেমন তীব্রতায় তেমনি আওয়াজে। কলকাতার একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন শিক্ষার্থী নারী চিকিৎসক ধর্ষিত ও নিহত হয়েছেন। মেয়েটির রাতে ডিউটি ছিল, ডিউটি শেষে হাসপাতালের ভেতরেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি ধর্ষিত ও নিহত হন। ধামাচাপানোর চেষ্টা যথারীতিই করা হয়েছিল। কিন্তু সম্ভব হয়নি। বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিশেষভাবে বের হয়ে এসেছেন মেয়েরা। চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত মেয়েরা এসেছেন, এসেছেন অন্য মেয়েরাও, যোগ দিয়েছেন পাবলিকও। আওয়াজটা ছিল নতুন, ‘রাত্রি দখল করো’ (অক্কাই দ্য নাইট)। মেয়েদের জন্য রাত্রিকে নিরাপদ করা চাই। নারী-নির্যাতন দিনের বেলাতেও ঘটে, তবে রাতের অন্ধকারেই জন্তুগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। সেজন্য রাত্রিকে অধিকার করার ওই আওয়াজ। তবে রাতে মেয়েদের নিরাপত্তা বাড়লেই কি মেয়েরা নিরাপদ হয়ে যাবেন? না, হবেন না। কারণ পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা রয়ে যাবে, পুঁজিবাদ তাকে রক্ষা করবে এবং মাগুরার রাজমিস্ত্রি হিটু শেখ যেমন, কলকাতার হাসপাতালের ধর্ষক ব্যক্তিটিও তেমনি মেয়েদের মনে করতে থাকবে ব্যক্তিগত ভোগের সামগ্রী, সুযোগ পেলেই ব্যবহার করা যায়। শুধু রাত্রিবেলা নয়, আসলে দখল করা চাই গোটা ব্যবস্থাটাকে; তবে দখলে রাখার জন্য নয়; খোলনলচে বদলে দেওয়ার জন্য। বদলের মূল লক্ষ্য হবে ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থার জায়গায় সামাজিক মালিকানা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।

আইনের শাসনের কথাও শোনা যায়। বলা হয় আইন যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায় তাহলে নাকি অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু আইনের শাসন যে কতটা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে, ভুক্তভোগী মাত্রেই তা জানেন। একেবারে প্রাথমিক প্রশ্ন, আইন তৈরি করেন কারা? করেন সমাজের সুবিধাভোগী অংশের লোকেরাই এবং করেন নিজেদের স্বার্থরক্ষার দিকে চোখ রেখেই। সুবিধাবঞ্চিতদের বঞ্চনা লাঘব অন্য অনেক ক্ষেত্রে যেমন আইনের শাসনের ক্ষেত্রেও তেমনি, অলীক কল্পনামাত্র। দরিদ্র মানুষ আদালতে প্রবেশ করবে এমন সাহস রাখেন না, দুঃসাহসে ভর করে যারা ঢুকে পড়েন, তারা দেখেন বের হওয়ার রাস্তা নেই।

আইনের শাসনের কী অবস্থা সে তো দেখাই যাচ্ছে, গণতন্ত্রের তীর্থস্থান খোদ আমেরিকাতে। সেখানে আইনের দ্বারা দণ্ডিত এক অপরাধী রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হয়ে বসে আছেন এবং আইনপ্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে ইচ্ছামতো কাজকর্ম করে যাচ্ছেন।

প্রত্যেকটি সমাজেই মানুষ এখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ। মানুষ শুধু শাসকদের পরিবর্তন নয়, পরিবর্তন চায় বিদ্যমান গোটা ব্যবস্থারই। শাসকশ্রেণির ওপর মানুষের আস্থা থাকার কোনো কারণই আর অবশিষ্ট নেই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকেও মানুষের মোটামুটি চেনা হয়ে যাচ্ছে, যদিও সেটা তারা স্পষ্ট করে বলতে পারেন না, কারণ প্রকাশের সব মাধ্যমই পুঁজিবাদীদের দখলে, এবং নানান ধরনের মোহ উৎপন্ন করে পুঁজিবাদীরা এমন অবস্থা করে রেখেছে যে, বঞ্চিতদের বোধশক্তি পর্যন্ত বিপদগ্রস্ত।

বিশ্বব্যাপী আজ তাই এই উপলব্ধি সৃষ্টি হয়েছে যে, পুঁজিবাদ বিদায় করা চাই। কিন্তু বিদায় প্রদান তো শাসকের বদল দিয়ে সম্ভব নয়, সংস্কার দিয়েও নয়। পুঁজিবাদকে হটানোর জন্য চাই সামাজিক বিপ্লব। চাই ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সে আন্দোলন এগোলে সংস্কার পথিমধ্যেই আসতে থাকবে; কিন্তু গন্তব্য হবে সামাজিক মালিকানার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। প্রশ্ন উঠবে পরিবর্তনের এই ক্ষেত্রটিতে কাণ্ডারি কে হবে? জবাবটা সহজ ও স্পষ্ট, কাণ্ডারি অন্য কেউ হবেন না, হবেন সমাজবিপ্লবীরা। কিন্তু বড় একটা সমস্যা এই যে, সমাজবিপ্লবীরা ঐক্যবদ্ধ নন। সব দেশেই তারা বিভক্ত, পরস্পরবিচ্ছিন্ন, এমনকি বিভ্রান্তও। বাংলাদেশের কথাই ধরি না কেন। এখানে সামাজিক বিপ্লবীদের কাজ শুরু হয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই। তারপর দুইশ বছর কেটে গেছে; বিপ্লবের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ, সুসংগঠিত কোনো পার্টি গড়ে ওঠেনি। অবস্থাটা তো আমরা দেখতেই পাই। সেটা বেশ করুণ। এখানে রুশপন্থি, চীনপন্থি বিভাজন ঘটেছে; চীনপন্থিরা বিভিন্ন দল ও উপদল গঠন করেছেন; রুশপন্থির মধ্যেও বিলোপবাদী ও বিলোপবিরোধী দুই শিবিরে বিভাজন ঘটেছিল। বিলোপবাদীরা তো সম্মান বাঁচিয়ে বিদায় নিয়েছেনই; বিলোপবিরোধীরাও শুনেছি এক থাকতে পারবেন বলে ভরসা করতে পারছেন না। অথচ এই মুহূর্তে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটা হলো বুর্জোয়ারা দুঃশাসন, লুণ্ঠন, প্রতারণা ও সম্পদ পাচারের মধ্য দিয়ে গোটা দেশকে যেভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে; তার বিরুদ্ধে বিকল্প রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। বুর্জোয়াদের দুই পক্ষ, সেক্যুলার ও নন-সেক্যুলার, বলা হয় প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল। একপক্ষ সংসদীয় গণতন্ত্র চায়, অন্যপক্ষের কাজ ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আরোহণ। উভয়পক্ষেরই বিরুদ্ধে, তৃতীয়পক্ষ নয়, বিকল্পপক্ষ প্রয়োজন। ওই বিকল্পের লক্ষ্য হবে সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করা, যাতে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সুযোগের সাম্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে সব মানুষের জন্য মুক্তি অর্জন সম্ভব হয়ে ওঠে।

এ কাজের জন্য বাংলাদেশে এখন কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নেই। যারা আছেন তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি দল গঠনের কথা বললে কোনো কাজ হবে না; অন্যের সঙ্গে তাদের ঐক্যের প্রচেষ্টা নিজ নিজ দলের ভেতরই ভাঙন ডেকে আনবে এমনই শঙ্কা। ডাকটা তাই হওয়া চাই সমাজবিপ্লবীদের যুক্তফ্রন্ট গঠনের। এ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেবে, তবে সেটা হবে রণকৌশল হিসেবে। সমাজবিপ্লবীদের যুক্তফ্রন্টের অবশ্যই জানা থাকবে যে, নির্বাচনে সরকার বদলাতে পারে কিন্তু ব্যবস্থা বদলাবে না; ব্যবস্থা বদলের জন্য নানা পদক্ষেপ ও বিভিন্ন কৌশলের প্রয়োজন হবে এবং চূড়ান্ত পদক্ষেপটি হবে সমাজবিপ্লব। যুক্তফ্রন্ট যদি গঠিত হয় এবং আন্দোলন গড়ে তোলে, তাহলে দেশের সর্বত্র দেখা যাবে নতুন এক জাগরণ ঘটেছে। কেননা মানুষ অপেক্ষা করছে সমাজবিপ্লবীদের ঐক্যের জন্যই, এর বাইরে যেসব রাজনৈতিক তৎপরতা তাতে মানুষ যোগ দেয়, যোগ দেবেও; কিন্তু তাদের জানা থাকবে যে, তাতে আর যাই ঘটুক মানুষের অবস্থার মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জামালপুরে মিলেছে গ্যাসের সন্ধান

ব্যাঙ ধরতে গিয়ে অপহরণ ৫ তরুণ, ২৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার

লক্ষ্মীপুরে মাদ্রাসাছাত্র হত্যায় অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তারের দাবি

বিচ্ছেদের কথা উঠলেই পরকীয়া জুড়ে দেওয়া হয়: সারিকা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৫ অভিযোগ আমলে নিল ট্রাইব্যুনাল

২০১৮-২৪ নির্বাচনে অনিয়ম দেখেছি, অংশও ছিলাম: আজমেরী হক বাঁধন

নিবন্ধন ফিরে পেলেও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক কীভাবে পেতে পারে জামায়াত

মেঘনায় ভেসে এলো রোহিঙ্গা নারীর মরদেহ

বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব বানাতে চীনা বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান

১০

রিমান্ড শেষে কারাগারে মমতাজ

১১

কুমিল্লায় ঘূর্ণিঝড়ে ৬২ ট্রান্সফর্মার বিকল, ভেঙেছে ৮৪ খুঁটি

১২

চ্যাম্পিয়ন্স লিগে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর অনিশ্চয়তায় ইনজাগির ভবিষ্যৎ

১৩

বিএনপি নেতা মজনুকে দেখতে হাসপাতালে আমিনুল হক 

১৪

আবারও নগরভবনের সামনে ইশরাক সমর্থকদের অবস্থান

১৫

ঝিনাইদহে দুপক্ষের সংঘর্ষে নিহত ১

১৬

কুয়েতে পরিবারসহ থাকতে নতুন শর্তারোপ

১৭

২০ বছর আগের স্বাক্ষর জাল করে নিয়োগের অভিযোগ

১৮

ইরানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রস্তাব, কী আছে এতে?

১৯

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর কত টাকা পাবে পিএসজি?

২০
X