একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে কেউ যদি জীবনের মায়া ত্যাগ করে হলেও প্রিয় স্বদেশ ভূমির স্বাধীনতা লাভের জন্য অস্ত্র তুলে নেন হাতে, বিপন্ন জীবন জেনেও যদি তিনি নিজ অফিসারের আদেশ অমান্য করেন নির্দ্বিধায় তবে নিশ্চিতভাবে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একজন মানব। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এমন একজন মানুষ হলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। গণহত্যার সরাসরি প্রতিরোধে শুরুতেই উচ্চারণ করেছিলেন ‘উই রিভোল্ট’! তারপর নিজের দায়িত্ব মনে করে নিজেই দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা! একজন বীরযোদ্ধার কথা বলছি। বলছি, একজন দূরদর্শী নেতার গল্প। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক শহীদ জিয়ার কথাই বলছি।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি এনেছেন দেশের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে, প্রিয়জনের জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন শেষ অবধি। অবশেষে দেশকে মুক্ত করেছেন হানাদার বাহিনীর হাত থেকে। অথচ স্বাধীনতার পরপরই জাতির পতাকা খামচে ধরে বাকশালী শকুনের দল। একজন প্রেসিডেন্ট কিসিঞ্জার তখন বিরক্ত হয়ে এ দেশকে তুলনা করেছিলেন একটা নষ্ট ঝুড়ির সঙ্গে, যার তলাটাই নেই। অর্থাৎ যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশের সীমাহীন ক্ষতি করেছে তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী-বাকশালী শাসকরা।
জেলায় জেলায় বিদ্রোহ, বিক্ষোভ আর জন-অসন্তোষ। নানা স্থানে ভুখা নাংগা মানুষের হাহাকার। আইন আদালতের ধার না ধরে ক্ষমতাসীনদের কথা মানতে বাধ্য তখন পুলিশও। আর তার থেকেও ভয়ানক আর হিংস্র রক্ষী বাহিনীর উগ্র তাণ্ডব। সরকারের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ সিকদারকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোনো বিচার ছাড়াই গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। এরপর তখনকার রাষ্ট্রপ্রধান সেটা নিয়ে অনৈতিক হুংকারও ছাড়লেন। সবমিলিয়ে স্বাধীন একটা দেশে সাধারণ মানুষের জন্য বেঁচে থাকা হয়ে উঠেছিল তখন অভিশাপের মতো। আফসোস।
সেনাবাহিনীতে একের পর এক বিদ্রোহ আর বিপ্লবে দেশ যখন অস্থির, ছন্নছাড়া সেই বাংলাদেশ নামক জনপদের নেতৃত্বভার তখন এসে পড়েছিল তার ওপর। সবাই যেখানে বাংলাদেশের শেষের শুরু দেখছিলেন, ঠিক তখনই তিনি ‘দেশ, মাটি ও মানুষের’ প্রকৃত মুক্তি সংগ্রাম শুরু করে দেন।
মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা থেকে শুরু করে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর হাহাকার থেকে জনগণের মুক্তি—প্রতিটি ক্ষেত্রে সবার সামনে আসে তখন একটি নাম। তিনি হলেন জনমানুষের প্রিয় গণনায়ক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
দেশ পরিচালনা করে গণমানুষকে শান্তি, সমৃদ্ধি আর উন্নতির দিশা নিয়ে আসার কাজটা কঠিন বৈকি। এ সত্যটা শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন শহীদ জিয়া। তাই তিনি তার ১৯ দফার তৃতীয় দফায় সর্ব উপায়ে নিজেদের একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। আর এ কাজের ক্ষেত্রে তিনি চিন্তার কেন্দ্রে রেখেছিলেন শিশু-কিশোর ও তরুণদের।
দেশের উন্নয়নে নতুন প্রজন্মকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার কথা যুক্ত করেন তার দেওয়া ১৯ দফার নবম দফায়। তিনি চেয়েছিলেন একটি শিক্ষিত, কর্মক্ষম ও আত্মনির্ভরশীল জাতি গড়ে তুলতে। আর সেজন্য সবার আগে শিশু, কিশোর ও তরুণ প্রজন্মকে বাধ্যতামূলক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। তার গৃহীত সেই উদ্যোগের সুফল পেয়েছে এ দেশ। সুফল ভোগ করবে জাতি, যতদিন থাকবে এই বাংলাদেশ নামক দেশটি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে!
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল অবধি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগেও তিনি কাজ করে গিয়েছেন—দেশ মাটি ও মানুষের প্রয়োজনে। তার এ সংক্ষিপ্ত মেয়াদের রাষ্ট্রপরিচালনার সময়েও শিশুদের কল্যাণে যেসব অবদান তিনি রেখে গিয়েছেন, তার তুলনা তিনি নিজেই। আগে কিংবা পরে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপতি শিশুদের নিয়ে এমন ধরনের সৃজনশীল, অভিনব এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তা করতে পারেননি।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কল্যাণকামী সরকার বাংলাদেশের শিশু শিক্ষা, শিশু স্বাস্থ্য এবং সামাজিক কল্যাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, তা পুরো জনগোষ্ঠীর ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শিশুদের জন্য তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহ আজ সবারই জানা।
শহীদ জিয়া শিশুদের বাংলাদেশের সক্রিয় নাগরিক হিসেবেই মনে করেছেন। তিনি যুবক ও মধ্যবয়সীদের সরাসরি দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে যেমন উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তেমনি শিশুদেরও অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছেন ভবিষ্যতের ভাবনা মাথায় রেখে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছেন এ শিশুরাই ভবিষ্যতে তরুণদের জায়গা নেবে। শুরু থেকে তাদের হৃদয়ে বাংলাদেশ নামক দেশটিকে ধারণ করাতে পারলে একদিন এরাই হবে উন্নতি আর সমৃদ্ধির কর্ণধার।
বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের শুরুতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দেখা গেছে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’ গানটি শিশুদের নিয়ে একসঙ্গে গাইতে ও উপভোগ করতে। তিনি জানতেন শিশুরা যদি এভাবে সবার আগে বাংলাদেশ নামটিকে হৃদয়ে ধারণ করে, তাহলে আর যাই হোক দেশবিরোধী এবং হঠকারী কোনো কাজ করা তাদের জন্য কঠিন হবে। যারা দেশের শত্রু তাদের সব থেকে বড় শত্রু হবে এ দেশপ্রেমিক শিশুরাই।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষার প্রচার করতে গিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান শিক্ষার ওপর জোর দেন। তিনি বাংলাদেশের শিশুদের মঙ্গল ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে এমন অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তার সরকার সম্প্রসারিত প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে দেশের সিংহভাগ শিশুকে শিক্ষার আলোয় আনতে চেষ্টা করেন।
শহীদ জিয়ার সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশাধিকার সম্প্রসারিত করেছে। এতে করে গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি দুর্গম এলাকার শিশুরাও বিভিন্ন স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়। পরবর্তীকালে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের আমলে যেভাবে সবার জন্য শিক্ষা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল, তার ভিত্তি রচিত হয় মূলত শহীদ জিয়ার গৃহীত উদ্যোগের মাধ্যমেই।
স্কুল তালিকাভুক্তি বৃদ্ধিসহ তার নেতৃত্বে স্কুলের অবকাঠামোর উন্নতি এবং বিশেষ করে মেয়েদের জন্য ভর্তির হার বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো হয়। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় তালিকাভুক্তি এবং সাক্ষরতার হার উভয়ই ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তখন। কভিড মহামারির সময়ে স্কুল তালাবদ্ধ থাকাকালে শিশুদের নিয়ে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন (জেডআরএফ) এক ভার্চুয়াল বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করেছিল। শিশু-কিশোরদের মধ্যে অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টিকারী এ উদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান তারেক রহমান হয়তো অনুপ্রেরণা খুঁজেছিলেন শহীদ জিয়ার গৃহীত কোনো উদ্যোগ থেকেই।
শিক্ষা সংস্কার করে জীবনমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার প্রশাসন শিক্ষা খাতে সংস্কার প্রবর্তন করেছিল, যা গুণগত মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তার সময়ে শিক্ষাকে সর্বজনীন করে তোলার যে প্রচেষ্টা তার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগে বাংলাদেশে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। মূলত সব ধরনের শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এর ফলে।
জিয়াউর রহমানের সরকার শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও মনোনিবেশ করেছিল। টিকাদান কর্মসূচির সম্প্রসারণ তার মধ্যে অন্যতম। তার প্রশাসন জনস্বাস্থ্য কর্মসূচিকে শক্তিশালী করেছে, বিশেষ করে টিকাদান। টিকা এবং স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে শিশুমৃত্যুর হার কমানোর প্রচেষ্টাও করা হয়েছিল তখন।
১৯৭৬ সালের ৫ অক্টোবর ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত বিজয়ীদের মধ্যে নিজ হাতে ট্রফি তুলে দেন শহীদ জিয়া। জনপ্রিয় এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এমন অনেক প্রতিভা বেরিয়ে এসেছেন যারা আজ বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এ প্রতিযোগিতা থেকেই আমরা পেয়েছিলাম দেশবরেণ্য সব কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের। বাংলাদেশের সাংস্কৃতির বিকাশে তাদের অনেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন।
চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সরাসরি রণাঙ্গনের যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন জিয়া। তিনি শিশু-কিশোরদের সততা আর দেশের প্রতি ভালোবাসাকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন বলেই তার গৃহীত শিশুবান্ধব উদ্যোগগুলো এখনো অমলিন।
শহীদ হওয়ার আগে তিনি যে বাংলাদেশ রেখে গিয়েছিলেন তার স্বাধীনতা ধীরে ধীরে বিপন্ন হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভোটডাকাতি, দুর্নীতি ও নজিরবিহীন অনিয়ম যখন পুরো দেশের মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছিল, তখন পথ দেখায় বাংলাদেশের সাহসী শিশু-কিশোররা। তারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মাতৃভূমিকে উদ্ধার করেছে ভিনদেশি আগ্রাসন এবং অনৈতিক ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে। তাদের এ দুঃসাহসী গণআন্দোলনের ক্ষেত্রেও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিলেন একজন দুরন্ত সাহসী মেজর জিয়া। দেশের চরম দুর্দিনে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শোনা গিয়েছিল তার বজ্রকণ্ঠ—‘I, Major Ziaur Rahman, do hereby declare independence of Bangladesh.’
লেখক: অধ্যাপক, গবেষক ও ট্রেজারার, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিরেক্টর (ফিন্যান্স), জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন
মন্তব্য করুন