ব্যক্তির চেয়ে দল বড় সত্য। এর বিপরীতে কখনো কখনো দলের চেয়ে ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব বড় হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ইতিহাসে রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে উতরাতে হয় দলীয় সীমানা। পৌঁছতে হয় দলমতের ঊর্ধ্বে। সেই আইকনিক হওয়ার সুযোগ সবার ভাগ্যে হয় না। আবার ভাগ্যে থাকলেও সুযোগটি নেওয়ার ধী-বুদ্ধি সবাই কাজে লাগাতে পারেন না। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নব্বইতে একবার তা পেরেছেন। পঁচিশে আবার পারলেন, দেখালেন।
বিশ্বসভ্যতা ও গণতন্ত্র চর্চার তীর্থভূমি ব্রিটেনে ড. ইউনূস-তারেক রহমান বৈঠক, ইউনূস সরকারের বিষয়ে দলীয় নেতাদের নমনীয় করে আনা, বিরোধে লাগাম টানাসহ কয়েকটি পদক্ষেপে চলমান তপ্ত রাজনীতির মাঠকে একটি স্বস্তির জায়গায় নিয়ে আসার ম্যাজিকের কৃতিত্ব খালেদা জিয়ারই। গণতন্ত্রকামী জনতাসহ সমাজের-রাষ্ট্রের নানা শক্তি সে অপেক্ষাই করছিল গেল কয়েকটা দিন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও তার অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দিনকয়েক ধরে ক্রমে কঠোর হয়ে উঠছিল বিএনপিসহ কয়েকটি দল। তিক্ত কথার বজ্রবর্ষণ চলতে থাকে সমানে।
সেখানে একদিকে ছেদ ফেললেন খালেদা জিয়া। বলে দিলেন মুখ সামলে চলতে। হুমকি-ধমকি ক্ষ্যান্ত দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলতে। আলোচনায় বসতে। আরেকদিকে বেজে ওঠে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকের ঘণ্টা। নির্বাচন, সংস্কার, গণহত্যার বিচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক উত্তেজনার একটা চরম মুহূর্তে লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকটি ম্যাজিকের মতো রাজনীতির দৃশ্যপটই বদলে দিল। অরাজনৈতিক মহল ও সাধারণ জনগণের দৃষ্টিও পল্টন-গুলশান মাড়িয়ে চলে যায় লন্ডনের দিকে। সেখান থেকে দেশে চলমান সংকটের একটা দিশা আশা করতে থাকেন তারা। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ ও সম্ভাব্য রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান আলোচনা ও বিরাজমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে কোরামিনের মতো কাজে দিয়েছে বৈঠকটি। ঘটনার ডায়াগনসিস দৃষ্টে এ দাওয়াইতে কেবল রোগই সারছে না, আরেকবার বোধ-বুদ্ধি-সুচিন্তার সুবাদে কিংবদন্তির মুকুট উঠল খালেদা জিয়ার মস্তকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিএনপি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। খালেদা জিয়া শুধুই এই দলের প্রধানের অ্যাক্ট করলেন না। দলের ঊর্ধ্বে সবার হয়ে ভিন্ন উচ্চাসনে তিনি। আবার ড. ইউনূসও বাংলাদেশে একজনের বেশি দুজন নেই। তার দল নেই। দলের চেয়ে ব্যক্তি শক্তিমান হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে তারও। আর তারেক রহমানও শুধু দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলের কান্ডারি নন, দেশের তরুণ-যুবা প্রজন্মের কাছে হার্টথ্রবের মতো। চব্বিশের ছাত্র-গণআন্দোলনের ফ্রন্টলাইনারদের নেপথ্য অভিভাবকের মতো। সেইসঙ্গে ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে দানবীয় রাজশক্তির সঙ্গে টিকে থাকার দৃষ্টান্ত। রাজনীতির উত্তেজনা, টানাপোড়েন ও হাপিত্যেশের মধ্যে ড. ইউনূসের সঙ্গে তার বৈঠকটি প্রকারান্তরে ঐতিহাসিক মানে উত্তীর্ণ। গত বছর ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাক্ষাৎ হলেও বাকি ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি দেশান্তরে। সুদূর লন্ডনে। প্রয়োজনে যে সেখানে গিয়েও তার সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেখা-সাক্ষাৎ হতে পারে, সেই ইতিহাস রচনা হয়ে গেল। আর এ ইতিহাসের ভিত্তি রচয়িতা খালেদা জিয়া।
নেপথ্য তালাশে জানা গেছে, নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে এ বৈঠকে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে প্রথমে কিছুটা অনীহা ছিল। তবে সরকারের কয়েকজন সিনিয়র ও প্রভাবশালী উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠকটি আয়োজনের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এ নিয়ে ঢাকা ও লন্ডনে কূটনৈতিক তৎপরতাও চলতে থাকে। একপর্যায়ে খালেদা জিয়ার পরামর্শে দ্রুত ফয়সালা আসে। অবশেষে তা কার্যকর হয় জুমাবারের প্রথমার্ধে। এরপর থেকেই রাজনীতির দৃশ্যপটে দৃশ্যমান তফাত। রাজনীতির শুরু থেকেই পরিস্থিতি খালেদা জিয়াকে ‘নির্ভুল পথের দিশারি’ করে তুলেছে। তার রাজনীতিতে আগমন ছিল দলের ঐক্য রক্ষায়। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে নিতে হয় গোটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐক্য রক্ষার দায়িত্ব। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাকে ছেড়ে এরশাদের মন্ত্রিত্ব নিয়ে চলে যান নিজ দলের বাঘা বাঘা নেতা। একপর্যায়ে রাস্তায় তাকে একা ফেলে এরশাদের সঙ্গে বোঝাপড়ার নির্বাচনে চলে যায় আওয়ামী লীগ-জামায়াতও। ওই কঠিন সময়েও হাল ছাড়েননি তিনি। একাই টেনে নিয়ে যান স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। আপসহীন নেত্রী, দেশনেত্রীর এ রাজসম্মানগুলো তার তখনকার অর্জন। একানব্বইর নির্বাচনে সেই ফল জনগণ তাকে দিয়েছে অঞ্জলি ভরে। রাজনীতির মাঠে বয়ে যাওয়া সিডরে আরেক পরীক্ষায় পড়েন তিনি। ভাঙেননি, মচকানওনি। আপসও করেননি। তাকে দেশান্তরী করার চেষ্টা চলেছে। কারাগারে পচিয়ে-গলিয়ে নিঃশেষ করার সব আয়োজনও চলেছে। দলকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার মেগাপ্রজেক্ট তো ছিলই। সবই ভণ্ডুল হয়ে গেছে তার সাহস ও সময়ের সিদ্ধান্ত সময়ে নেওয়ার গুণে। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর আরেক কঠিন পরীক্ষায় পড়েন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ কারাবাসের যন্ত্রণার মধ্যেও দমেননি, টলেননি। তিনি কবে নাগাদ রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারবেন—এ প্রশ্নের সঙ্গে যোগ হয়, কবে ফিরবেন তারেক রহমান? ওয়ান-ইলেভেনে নির্মম নির্যাতিত তিনি। ২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তারপর থেকেই তিনি সেখানে রয়েছেন। মাঝে কেটে গেছে ১৭টি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে দেশের বাইরে থেকে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাফল্যের সঙ্গে। শত ধকলের মধ্যেও দলকে ইউনাইটেড রাখার ইতিহাস গড়েছেন। হেডম দেখানো শাহজাহান ওমর, তৈমূর আলম খন্দকার, উকিল আবদুস সাত্তার ধরনের কয়েকজন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কেউ দল ছেড়ে যাননি। গত ১৭ বছরে বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে তারেক রহমানের ছিল দক্ষ নেতৃত্ব। চার মাস লন্ডনে তার কাছে থেকে সুচিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছেন খালেদা জিয়া। আগেও চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরার সঙ্গে তার এবারের ফেরার মধ্যে বিস্তর ভিন্নতা রয়েছে। দেশের রাজনীতি এবং জনগণের কাছে এর বিবেচনা অন্যরকমের। শুধু রাজনৈতিক কারণেই টানা ছয়-সাতটি বছর খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়েও চলেছে ভোগান্তি। সঙ্গে অপমানসহ অপরাজনীতিও। বিএনপির অবিরাম আন্দোলনেও নিশ্চিত করা যায়নি তার বিদেশে চিকিৎসা। সরকারের তরফে হাই-প্রোপাগান্ডা ছিল তার অসুস্থতা গুরুতর নয়। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আবার জেলে পাঠানোর হুমকিও দেওয়া হয়। ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পলায়নের পর খালেদা জিয়ার বন্দিজীবনের অবসান হয়। চিকিৎসায় শারীরিকভাবে আগের চেয়ে অনেকটা ভালো বোধ করায় দেশে ফেরেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বাস্তবতা তাকে টেনে আনে দলের রাজনীতিতে। নেতাকর্মীদের আহ্বানে ধরতে হয় দলের হাল। ক্রমেই তিনি দল মাড়িয়ে দেশের রাজনৈতিক প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ান। ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয় তখন খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন। ইচ্ছা ছিল স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত ওই বাড়িতেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থাকার। শেখ হাসিনা জেদ পূরণ করেছেন খালেদা জিয়াকে ওই বাড়িছাড়া করে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি গ্রেপ্তার হন। সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর তিনি আইনি লড়াই করে সবকটি মামলায় জামিন নিয়ে মুক্তি পান। ওয়ান ইলেভেন সরকারের করা বিতর্কিত এক মামলায় ২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয় খালেদা জিয়াকে। প্রথমে রাখা হয় পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সেখান থেকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। সেদিনই সর্বশেষ গাড়ি থেকে হেঁটে নামতে দেখা যায় তাকে। এরপর থেকে শুধুই হুইলচেয়ার। দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে সাম্প্রতিককালে তিনি কথাবার্তা বলছেন। দিচ্ছেন দিকনির্দেশনা। অপেক্ষা এখন তারেক রহমানের দেশে ফেরার। সেইসঙ্গে নির্বাচন, সংস্কারসহ আরও নানা প্রাসঙ্গিকতা। আবেগে নয়, নিশ্চয়ই অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার আলোকে পথ-মত, শত্রু-মিত্র চিনেই করণীয় ঠিক করবেন তিনি। নির্বাচনের পথরেখায়ও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিএনপির চাওয়ামতো ডিসেম্বর বা প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাবিত এপ্রিল নিয়েও সমস্যা হবে না। ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূস। সেটা চৈত্র মাসের দ্বিতীয়ার্ধ। ঈদুল ফিতর হবে ১৯ বা ২০ মার্চ। এইচএসসি পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখ মে মাসে। কাজেই খুব সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তারিখের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটা সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং দেশ ও বিদেশে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারা। ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকে সেই আশাবাদের কিছু বার্তা মিলেছে। আর প্রজ্ঞার ভ্যানগার্ডের মতো খালেদা জিয়া তো আছেনই।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন