বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটময় সময় পার করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অপ্রতুল জ্বালানি সরবরাহ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নির্মিত পরিবেশের (Built Environment) প্রতি অবহেলা—এ চারটি বড় চ্যালেঞ্জ এখন আমাদের টেকসই ভবিষ্যতের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যখন উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছি, তখনই এক ভয়াবহ বাস্তবতা আমাদের প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে। অথচ এ সংকট মোকাবিলায় গবেষণাভিত্তিক, নীতিনির্ধারণমূলক এবং প্রেক্ষিতনির্ভর কোনো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান আজও আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। এ প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশে একটি বিল্ট এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (Built Environmental Research Institute) প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে সাড়ে তিন শতাংশ হারে নগরায়ণ ঘটছে। এটি বৈশ্বিক পরিসরে অন্যতম দ্রুতগতির নগরায়ণ। রাজধানী ঢাকা এরই মধ্যে জ্যাম, দূষণ, জলাবদ্ধতা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো সংকটে পর্যবসিত হয়েছে। এসব সমস্যার শিকড়ে রয়েছে অপরিকল্পিত নির্মাণ ও অপ্রতুল পরিবেশবিষয়ক পরিকল্পনা। আমাদের ভবন, রাস্তাঘাট, খোলা জায়গা বা পাবলিক স্পেসগুলো অনেক সময়ই মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও মানসিক স্বাস্থ্যকে বিবেচনায় না রেখেই গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশের মোট জ্বালানি ব্যবহারকারীদের মধ্যে নির্মাণ খাত প্রায় ৪০ শতাংশের জন্য দায়ী। ঘরবাড়ি, অফিস, হাসপাতাল কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবখানেই বিদ্যুৎ ব্যবহারে অদক্ষতা লক্ষ করা যায়। যথাযথ বায়ু চলাচল, প্রাকৃতিক আলো কিংবা তাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকায় একদিকে যেমন বিদ্যুতের অপচয় হয়, অন্যদিকে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক এবং কর্মরত জনগণের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে ভয়াবহ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন বন্যা, দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড় এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের পরিবর্তন—এসবই আমাদের আবাসন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার মানুষ, যাদের ঘরবাড়ি জলবায়ু-সহনশীল নয়, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে নির্মিত পরিবেশ, জ্বালানি এবং নগর পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। জাপানের Building Research Institute, যুক্তরাজ্যের BRE, অস্ট্রেলিয়ার CRC for Low Carbon Living, কানাডার National Research Council-Construction—এ প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার, গবেষক এবং শিল্প খাত যুক্ত করে নির্মাণ খাতকে আধুনিক ও টেকসই করার উদ্যোগ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যের BRE ‘BREEAM’ নামে একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তৈরি করেছে, যা টেকসই ভবন নির্মাণে একটি গ্লোবাল রেফারেন্স পয়েন্ট। বাংলাদেশে যদিও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রে কিছু কার্যক্রম চলমান রয়েছে, সেগুলো অধিকাংশই বিচ্ছিন্ন, খণ্ডিত ও প্রয়োগকেন্দ্রিক নয়। কোনো একক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে স্থপতি, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারেন।
বাংলাদেশের বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর ভিত্তিতে সরকার, বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বয়ে একটি বিল্ট এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা যেতে পারে। এ প্রতিষ্ঠানে নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে গবেষণা ও উদ্ভাবন চালানো যেতে পারে—পরিবেশবান্ধব ও আবহাওয়া উপযোগী নকশা, শিশু ও নারীবান্ধব অবকাঠামো, গ্রামীণ ও উপকূলীয় এলাকায় অভিযোজনযোগ্য গৃহনির্মাণ, শিল্পাঞ্চলে কর্মবান্ধব ভবন নকশা, তাপ, আলো ও শব্দ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর সমাধান, অভ্যন্তরীণ বায়ুগুণ, তাপ-স্বস্তি ও মানসিক সুস্থতা বিষয়ে গবেষণা, জন-অংশগ্রহণমূলক নকশা প্রক্রিয়া, নির্মাণসামগ্রীর স্থানীয়করণ ও মূল্যায়ন। এ গবেষণা প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, পাইলট প্রকল্পের বাস্তবায়ন, কম্পিউটার সিমুলেশন, তাপ-স্বস্তি পরীক্ষণ, মানব অভিজ্ঞতা ম্যাপিং এবং স্থানিক বিশ্লেষণ। একই সঙ্গে এটি নির্মিত পরিবেশবিষয়ক নীতিমালা, গাইডলাইন, প্রশিক্ষণ সামগ্রী এবং বিল্ডিং কোড উন্নয়নে সরকারের সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারে। এ ইনস্টিটিউট আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পারে। এতে বিশ্বমানের গবেষণা, প্রযুক্তি ও জ্ঞান বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।
‘বিল্ট এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ একটি আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে, যার প্রধান লক্ষ্য হবে বাংলাদেশের নির্মিত পরিবেশকে টেকসই, অভিযোজনযোগ্য ও ব্যবহারকারীকেন্দ্রিক করে গড়ে তোলা। এ ইনস্টিটিউটে স্থাপত্য, প্রকৌশল, নগর পরিকল্পনা, পরিবেশবিজ্ঞান, জনস্বাস্থ্য, সমাজবিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা একত্রে কাজ করবেন। প্রতিষ্ঠানটি দেশের আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে উপযোগী নির্মাণকৌশল, স্থায়ী বসবাসযোগ্য ভবন ডিজাইন, শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলের অভিযোজনক্ষম আবাসন মডেল এবং জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিবিষয়ক গবেষণা করবে। এখানে গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে থাকবে বাস্তব পরিস্থিতির তথ্য সংগ্রহ, তাপ-আর্দ্রতা ও বাতাস চলাচল-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ, কম্পিউটারভিত্তিক সিমুলেশন মডেল তৈরি এবং ব্যবহারকারীদের জীবনযাত্রা ও অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ। দেশের নানা প্রান্তে প্রোটোটাইপ বা পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইনস্টিটিউট তার গবেষণার ফল বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করবে এবং সেগুলো পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করবে।
এ গবেষণা প্রক্রিয়া শুধু একাডেমিক নয়; বরং এটি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, পৌরসভা, বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে সক্রিয় অংশীদারত্বে পরিচালিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যমান স্কুল, হাসপাতাল, গার্মেন্টস কারখানা বা আবাসিক ভবনগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিবেশ কীভাবে উন্নত করা যায়; তা নিয়ে গবেষণা হবে এবং প্রস্তাবিত নকশা ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হবে। ইনস্টিটিউটটি নিয়মিতভাবে নির্মিত পরিবেশবিষয়ক নীতিমালা, প্রশিক্ষণ মডিউল, ডিজাইন গাইডলাইন এবং বিল্ডিং কোড প্রণয়ন ও হালনাগাদের জন্য সুপারিশ করবে। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফল শুধু গবেষণার কক্ষে আটকে না থেকে বাস্তব উন্নয়ন প্রকল্পে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার সঙ্গে যৌথ গবেষণা ও তথ্যবিনিময়, বিশেষজ্ঞ বিনিময় ও সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে এ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের নির্মাণ ও পরিবেশসংক্রান্ত গবেষণাকে একটি বৈশ্বিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
আজ যখন আমরা তাপপ্রবাহে হাঁপিয়ে উঠি, ঘন ঘন বন্যায় তলিয়ে যাই, হাসপাতাল-স্কুলের পরিবেশে অসুস্থতা বাড়তে দেখি, তখন একটি সমন্বিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা শুধু সময়োপযোগী নয়, বরং এটি জাতির ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখার নৈতিক দায়িত্বও। এই ইনস্টিটিউট আমাদের শিশুদের জন্য একটি বাসযোগ্য, আরামদায়ক ও টেকসই বাংলাদেশ নির্মাণের ভিত্তি হতে পারে। নির্মিত পরিবেশ কেবল ইট, সিমেন্ট ও রডের সমষ্টি নয়; এটি মানুষের আবেগ, অভিজ্ঞতা, স্বাস্থ্য এবং প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়ার জটিল সমন্বয়। এ জটিলতা অনুধাবন করে যদি এখনই আমরা একটি বিল্ট এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে না যাই, তাহলে আগামী দিনে নির্মাণ খাত আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ নয়, দুর্যোগ হয়ে দাঁড়াবে। এখনই সময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, নির্মাণ খাত ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করতে একটি সময়োপযোগী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও আন্তঃবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার।
আজ যখন আমরা তাপপ্রবাহে হাঁপিয়ে উঠি, ঘন ঘন বন্যায় তলিয়ে যাই, হাসপাতাল-স্কুলের পরিবেশে অসুস্থতা বাড়তে দেখি, তখন একটি সমন্বিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা শুধু সময়োপযোগী নয়, বরং এটি জাতির ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখার নৈতিক দায়িত্বও। এই ইনস্টিটিউট আমাদের শিশুদের জন্য একটি বাসযোগ্য, আরামদায়ক ও টেকসই বাংলাদেশ নির্মাণের ভিত্তি হতে পারে
লেখক: স্থপতি, শিক্ষাবিদ এবং চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান
মন্তব্য করুন