নাঈমা সামাদ স্বাতী
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৫ জুন ২০২৫, ০৪:৩৫ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আব্বার ছায়ায়

আব্বার ছায়ায়

ঢাকা শহরে মানুষের ভিড় আর যানজটের হট্টগোল পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। নিয়ম না মানার অদ্ভুত নিয়মে ঢাকা তরতর করে এগিয়ে চলেছে স্রোতঃস্বিনী নদীর মতো। এর মাঝেই আমাদের হেসে, খেলে, কেঁদে বড় হওয়া, এর মাঝেই রয়েছে আমার স্বজন, নানাজন আর আমার দায়িত্বও। তবু দুরন্ত এ শহরকে এখন আমার বড় ফাঁকা লাগে, কারণ আমার মা-বাবা, তাদের সুন্দর সাজানো নীড় আজ কিছুই নেই ঢাকায় । হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল জীবনের এ অধ্যায়ের শেষ পাতাগুলো। যে অধ্যায় দিয়ে জীবনের শুরু, তার ভিত্তি, শিকড়, শক্তি, সেই অধ্যায় এরই উপসংহার পড়া হলো না। ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার আব্বা চলে গেলেন। যখন স্ট্রেচারে করে বাড়ি থেকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল তখন নাকি আম্মাকে তিনি বলেছিলেন, ‘রেনু, সংসারটা ধরে রেখো।’ আম্মা একরকম কথা রাখতে পেরেছিলেন বইকি! ওই বছরের (২০১২ সাল) ১৭ ডিসেম্বর তিনি পাড়ি দেন আব্বাকে সঙ্গ দিতে, তাদের ওপারের সংসারে। সর্বস্রষ্টা তো অবগত আছেনই যে, আব্বাকে ছাড়া তার এপারের সংসার অর্থহীন। শৈশব থেকেই পারিবারিক সূত্রে আমার আব্বা-আম্মার পরিচয়। ছোট্ট বেলার স্নেহ বড় হয়ে কোনো এক সুন্দর মুহূর্তে রূপ নেয় ভালোবাসায়। এরপর বিয়ের বন্ধন, সংসার, সন্তান, পরিবার, সবাইকে নিয়ে গড়া ভালোবাসার নীড়, যা আজ শুধুই নিথর আসবাবপত্র, বাক্সে ভরা জিনিস, ধুলোর চাদরে মোড়া! আমার আব্বা চলে যাওয়ার পর, বিশেষ করে, তার কর্মজীবনের মূল্যবান সব স্মৃতিচারণ করেছেন তার বন্ধুবর, মান্যবর, গুণিজনরা। তাদের প্রতি আজীবন আমাদের পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধা। আমার আব্বাকে সসম্মানে স্মরণ করার জন্য, তার কাজের নিষ্ঠা, সততা, বিচক্ষণতার সঙ্গে আমাদের আবারও পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। দূরদর্শী মানুষ ছিলেন আমার আব্বা। রাজনীতি, অর্থনীতি, দেশ, সমাজ সব বিষয়ে তার বিচক্ষণ ও বিশ্লেষণমূলক লেখায় সেটা স্পষ্ট। আর নিজ জীবনের ক্ষেত্রে সরলতা ছিল তার ভূষণ। আশ্চর্য হইনি তাই যখন শুনেছি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার আগে তিনি তার ভাগনে, আমার ফুপাতো ভাই শামীম ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মামা সফরে যাওয়ার সময় দোয়াটা যেন কী?’ শামীম ভাইয়া মনে করিয়ে দিতেই আব্বা পড়ে বলেছিলেন, ‘লম্বা সফরে যাচ্ছি তো!’ বুঝতে পেরেছিলেন কি যে, এ যাত্রায় আর ফেরা হবে না? Aortic Aneurysm সময়মতো ধরতে পারেননি ডাক্তাররা। যখন পারলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। রোগ নির্ণয় থেকে অপারেশন চার-পাঁচ দিনও না। অপারেশনের পর আর জ্ঞান ফেরেনি। অসুস্থতার খবর পেয়ে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে আব্বুকে আর সজ্ঞানে পাইনি। আমি পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যাত্রা করেন তিনি। আমার আর উপসংহার টানা হয় না। আমার স্বামী তখন দেশে উপস্থিত। ও যখন আব্বাকে বলে, ‘ওরা রওনা হয়ে গেছে।’ আব্বা স্মিত হেসে বলেছিলেন, ‘শুধু শুধু আমার নাতনির লেখাপড়ার ক্ষতি হবে।’ তারপর একটু থেমে বলেছিলেন, ‘তোমার বাবা-মাকে বলো, I had a wonderful time with them!’ গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ভরা সুন্দর বিদায় বাণী রেখে গেলেন ওনাদের জন্য। আমার ভাইবোন তখন ঢাকায়, আব্বার পাশে ছিল তারা। শুধু আমি আর আমার মেয়ের শেষ দেখা, শেষ কোনো কথা হলো না তার সঙ্গে। মাস কয়েক আগে, গরমের ছুটি কাটিয়ে গেছি ঢাকায়, ঘুণাক্ষরেও তখন মাথায় আসেনি সামনে ২৬ সেপ্টেম্বর কী হতে যাচ্ছে! কখনো মনে হয় আমার ওপর কি কিছুটা অভিমান নিয়ে চলে গেলেন আমার আব্বা? তার প্রথম নাতনি, তার বন্ধু, তার হৃদয়ের আরামকে তার কাছ থেকে দূরে নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার জন্য? যদিও কোনোদিন আমার আব্বা আমার সাংসারিক জীবনের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেননি। উপদেশ চেলে দিয়েছেন, তবে আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা সম্মান করেছেন। আমাদের মঙ্গল কামনা করেছেন। তাই আব্বার কাছ থেকে শিখেছি ব্যক্তি স্বাধীনতা, জীবনের সব ক্ষেত্রে। তবে এ আব্বাই ছোটবেলায় আমাদের ব্যাপারে ছিলেন বেশ রক্ষণশীল। নিয়মের মধ্যে বড় হয়েছি আমরা। কখন কোথায় যাব, সব জানা চাই। গাড়ি থাকলে পৌঁছে দিয়েছেন, না হয় আমাদের বাধা রিকশাচালক ভাই (বন্ধুরা যার নাম দিয়েছিল আমার লিমোজিন), আর না হলে রিকশার পেছনে সাইকেল চালিয়ে বড় ভাই সুলভ অফিস সহকারী শওকত ভাই পৌঁছে দিতেন। যার নাম দেওয়া হয়েছিল বডিগার্ড। বিকেলে খেলার কারফিউ আর সবার মতোই মাগরিবের আজান। বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের ছেলে বন্ধুদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসার বারণ ছিল না। তবে এ ক্ষেত্রেও মাগরিব কারফিউ প্রযোজ্য ছিল। তখন আড়ালে বিরক্তি প্রকাশ বা হাসলেও এখন বুঝি জীবনযাত্রায় ভারসাম্য রাখতে এগুলো কাজে দেয়। বাঙালি মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারের মূল্যবোধ আর পশ্চিমা সমাজের মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্য রেখে মেয়েকে মানুষ করার ক্ষেত্রে সেটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। এতে কতটা সফল হয়েছি, তা আমার মেয়ের জীবনাচরণ বলে দেবে, তার যতটুকুই সফলতা, তার কৃতিত্ব অনেকটাই আমার আব্বা-আম্মার প্রাপ্য, যারা আমাদের শিখিয়েছেন পৃথিবীর সব সংস্কৃতিতেই ভালো আছে। নিজের আদি পরিচয় বজিয়ে রেখে সেটাকে আলিঙ্গন করলে জীবনের পরিধি বাড়ে, বাড়ে অভিজ্ঞতা। আব্বাকে আর কটা দিন কাছে পেলে তার সঙ্গে আমার জীবনের রুজি রোজগার, মেয়েকে মানুষ করা, একটু নির্মল আর মুক্ত বাতাসের সন্ধানে ভবঘুরে আমাদের, পৃথিবীর নানা দেশে সাময়িক ঘর বাঁধার অভিজ্ঞতাগুলো মনভরে আলাপ করতাম, যা তেমনভাবে পেরে উঠলাম কই জীবন যুদ্ধের ব্যস্ততায়! আমি জানি আব্বা অনেক মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, হয়তো লিখে ফেলতেন জীবনের অভিজ্ঞতার একটা চিত্র সেই দেশের পরিস্থিতির আঙ্গিকে। এটা ছিল তার দারুণ পারদর্শিতা। মানুষের জীবনের গল্প বলা। কত কিছুই যে শেখার বাকি ছিল আমার আব্বুর কাছ থেকে! এখন শুধুই স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই, মনে করি অনেক কিছু যা বলেছিল আব্বা! কখনো গল্পে, কখন উপদেশে, কখনোবা রেগেও! লেখালেখি শেষ করে খাবার টেবিলে, একসঙ্গে গাড়িতে আর ভবঘুরে আমাকে মাঝেমধ্যে ফোন, চিঠি বা ইমেইলে। এখন সব ছেঁড়া মেঘের মতো আমার হৃদয় ভাসে আর আমি তাই আঁকড়ে ধরে রই আর নিভৃতে সেসব মেঘের মালা বুনি। আব্বাকে হারিয়েছি তেরো বছর হতে চলেছে, আমার এখন পঞ্চাশের কোঠায় জীবনযাপন, অথচ আব্বার স্মৃতিচারণে আমি কিশোরী চিরন্তন! এক উষ্ম নিরাপদ বলয় আমার বিবর্তন। অপরিসীম কৌতূহলী মন, অথচ ভয়ডরহীন আমি, আমার আব্বার ছায়ায়। সাংবাদিক আতাউস সামাদের কর্মজীবন সম্পর্কে লেখার আছে অনেক কিছু। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ সৃষ্টি আর ভাঙাগড়ার বহু ইতিহাস। ১৯৭১-এর পূর্ব থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক আশা-হতাশা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষ, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের উত্থানপতন, একেক সময়ের সামরিক, বেসামরিক নেতৃত্বে দেশের অবস্থা, সবই পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও নথিগত করে গেছেন আমার আব্বা। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে কীভাবে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ, তা আমার আব্বা প্রত্যক্ষ দর্শনে ভুক্তভোগী ও সংগ্রামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লিপিবদ্ধ করে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন। আব্বার এসব কাজ ও লেখা সংকলন করা রীতিমতো গবেষণার ব্যাপার। এ দেশের সত্যি ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য সেটা করা খুবই প্রয়োজন। আমি আজ আমার আব্বা, মানুষ আতাউস সামাদের কথা লিখছি, যার থেকে পৃথক করা যায় না সাংবাদিক আতাউস সামাদকে। তবে যোগ করা যায় অনেক কিছুই। যদি এতে রাজনীতি বা জাতীয় ইতিহাসের গন্ধ কম থাকে বা না থাকে, তার কারণ আমি আমার আব্বার একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি গড়ার চেষ্টা করছি হয়তো এ কথামালায়। যে আব্বা ছুটির দিনে সকালে আদর করে আমাদের ঘুম থেকে ওঠাতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। এ আমার বড় আরামের খুবই প্রিয় মুহূর্ত। বড় হয়েও মাঝেমধ্যে এ আরাম আর আদর নিতে দ্বিধা করিনি আর নিরাশও হইনি কখনো, শতব্যস্ততার মধ্যেও না। অবশ্য আমাদের ছোটবেলায় আব্বা ব্যস্ততার মধ্যে অনেক সময় ভুলে যেতেন আমরা ভাইবোনরা কে কোন ক্লাসে পড়ি। আবার আমরা কী শিখছি, কী বলছি সেটা ঠিকই খবর রাখতেন। স্কুলে অঙ্কে ডাব্বা মারছি বা ইংরেজি রচনা খুব সুন্দর লিখেছি, সেই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সময় ঠিক বের করে নিতেন আব্বা। ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক আর বার্ষিক পরীক্ষার ঠিক আগ দিয়ে ধরতেন, এটা ছিল তার ধরন! উচ্চারণ শুধরে দিতেন, বাংলা, ইংরেজি দুটোই! খেয়াল রেখেছেন তার বাবা-মার শেখানো মূল্যবোধ, আদব লেহাজ আমাদেরও যেন আত্মভূত হয়। লেখক নই আমি। স্মৃতির পাতা থেকে আব্বাকে শব্দে রূপ দেওয়া তাই সহজ নয় আমার জন্য, তার ওপর ভাবাবেগ। তবুও দেশপ্রেমিক এই মানুষ, যাকে দেশও দিয়েছে অনেক অনেক ভালোবাসা, তার কথা দেরিতে হলেও দশের কাছে কিছুটা পৌঁছানোর স্পৃহা আমার। এক প্রচারবিমুখ মানুষের কথা যার কাজ ছিল সম্প্রচার! জানাতে চাই কেমন মানুষ ছিলেন ব্যক্তিজীবনে দেশপাগল এ সাংবাদিক! এতে যদি কেউ অনুপ্রেরণা পায়, তাতে যে দেশ পাবে আরও কিছু ভালো মানুষ, দেশপ্রেমিক! আমার আব্বা, এ মানুষটার জীবন জুড়ে ছিলেন আমার আম্মা। ভালোবাসা, স্নেহ, সহনশীলতার এক সুন্দর সমন্বয় তাদের সম্পর্ক। ছোট ছোট সাদামাটা আচরণ যার পেছনে ছিল অনেক অনেক স্নেহ। খেতেন না একজনকে ছাড়া অন্যজন। আম্মার ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ায় একসময় অপেক্ষা করতে পারতেন না, অথচ আব্বার লেখা শেষ হয়নি তখনো, আব্বা লেখা রেখে কিছুক্ষণের জন্য হলেও খাবার টেবিলে আম্মার সঙ্গে বসে যেতেন। আর আব্বার প্রায়ই অবেলায় খাবার সময় আম্মা থাকতেন পাশে। আলাপ চলত সেদিনের কোনো বিশেষ বা চাঞ্চল্যকর বিষয় নিয়ে কী লিখলেন এবং কেন লিখলেন আব্বা। আম্মার অখণ্ড মনোযোগ না পেলেই অখুশি হয়ে বলতেন, ‘আমার কথাটা মন দিয়ে শুনলেই না!’ আব্বার লেখার পাঠক কতশত, কিন্তু তার মনে ধরা এক নম্বর শ্রোতা/পাঠক আমার আম্মা। আব্বা বাইরে থেকে ফিরলে প্রায়ই হাতে থাকত বাদামের ঠোঙা বা ইউসুফ বেকারির নাশতা। মাগরিব পড়ে একসঙ্গে চা খাওয়ার আয়োজন। আম্মা লাইব্রেরিয়ান, বাড়িতে আব্বার লেখার আর নানানরকম পত্রিকা ও বই সব আম্মা সেই ধারায় গুছিয়ে রাখতেন। এ ব্যাপারে আব্বা একটু দুর্বলই। তারা একজন আরেকজনের সম্পূরক। একটা মজার ব্যাপার আমাকে হাসাত আব্বা-আম্মাকে নিয়ে। বাড়িতে যখন প্রথম এয়ারকন্ডিশনার এলো, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি বোধহয়, তখন দেখা দিল এক সমস্যা। আম্মা শীতকাতুরে আর আব্বা গরম। তাই প্রচণ্ড গরমে যখন ওই একখানা এসি ছাড়া হতো আম্মা তো কাঁথা-কম্বলের নিচে। তাই কিছুক্ষণ এসি চলে আবার কিছুক্ষণ বন্ধ। তবু একজন অন্য ঘরে গিয়ে থাকবে সেটা কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধানই নয়। আব্বার চঞ্চলতায় আম্মা ছিলেন প্রশান্তি। বিধাতার তৈরি জোড়া। ছোটখাটো মান-অভিমানেও ছিল ভালোবাসার প্রতিফলন। আব্বা সবসময়ই আম্মাকে পাশে চেয়েছেন। তাই যুক্তি দেখাতেন, আম্মা চাকরি ছেড়ে দিলে আব্বার সঙ্গে থেকে তার বই লেখা, বাড়িতে বিশাল বইয়ের সম্ভারকে একটা সুষ্ঠু লাইব্রেরিতে পরিণত করা, আমার ছোট বোনকে তার ছবি আঁকায় অনুপ্রাণিত করায় অনেক সাহায্য হবে। আম্মা একপর্যায়ে মেনে নেন। প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের লাইব্রেরির বিস্তার ও আধুনিকায়ন শেষে আম্মা চাকরি ছেড়ে দেন। আব্বার পাশেই থাকেন আর যতই বয়স হচ্ছিল আম্মা চাইতেন বৈষয়িকভাবে একটু গুছিয়ে উঠতে। এ ব্যাপারে আব্বার উদাসীনতা আম্মাকে ভাবাত। খোদার ওপর ‘তওয়াক্কুল’ এর অন্তর্নিহিত অর্থই যার জীবনের মূলমন্ত্র, সেই আম্মা এ ক্ষেত্রেও তার ওপর ভরসা করেই ছিলেন আজীবন। চিন্তা থাকলেও তাই আফসোস ছিল না। বছরখানেক আগে আম্মার আলমারিতে পুরোনো কাগজের মাঝে খুঁজে পাই তাকে লেখা ইংরেজি নববর্ষে আব্বার চিঠি। সালটা ১৯৬৫। আম্মাকে নিয়ে আব্বা কোনো কবিতা লিখেছেন বলে জানি না। রচনা করেননি কোনো প্রেমের গল্পও। তবে এ চিঠিতে যে আবেগঘন নিঃশর্ত ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন, তা অতুলনীয় সুন্দর অর্ঘ্য বৈ কিছু নয়। আমার আব্বা-আম্মা বিধাতার অসীম দয়ায় তাদের মাঝে, যারা দুজনে দুজনার হয়ে এ পৃথিবীতে আসেন। তাই আমার স্মৃতিতে দেখতে পাই নানান সংকট-শঙ্কায় আনন্দ-বেদনায় একে অন্যকে আগলে রাখতে, ভালোবাসায়, বন্ধুত্বে, সম্মানে। এক ভাই, চার বোনের পর আমার আব্বার জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৬ নভেম্বর ময়মনসিংহে। আদরের ডাক নাম খোকন। আব্বার ১০ বছরের ছোট তার সর্বকনিষ্ঠ ভাই। তাই বহুদিন কনিষ্ঠ এর মুকুট পরে, বোনদের অনেক আদরে বড় হয়েছে আব্বা। শুনেছি আব্বাকে তারা সাজিয়ে গুছিয়ে আদরে আহ্লাদে দিন কাটিয়েছেন খেলার পুতুলের মতো। লায়লা ফুপ্পি আব্বার সবচেয়ে বড় বোন। তিনি স্বামী-সন্তান রেখে টাইফয়েডে মারা যান যখন আব্বা খুবই ছোট। তারপরের বোন শিরীন ফুপ্পিকেই বড় ফুপ্পি বলে ডাকি। আমার বড় ফুপ্পি খুবই সৌখিন মানুষ ছিলেন বরাবর। আব্বাকে সুন্দর কাপড় পরিয়ে রাখা, আদর-যত্ন করা ছিল তার শখ। আনুমানিক ৫-৬ বছর বয়সে আব্বার জন্মদিনের যে ছবিটা আমাদের কাছে আছে, ওটা তারই সাজিয়ে দেওয়া। বড় ফুপির স্নেহের ছোঁয়া আমার আব্বার প্রতি বর্ষিত হয়েছে আজীবন। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে দেশের প্রকৃত অবস্থা, এরশাদের দমননীতি ও দুর্নীতির খবর বিবিসিতে রিপোর্ট করে যাওয়ার জন্য স্বৈরাচারী শাসকের দৃষ্টিতে পড়েন আব্বা। বড় ফুপ্পি ওই সময় আব্বাকে আগলে রেখেছিলেন ভাইকে আশ্রয় দিয়ে, লুকিয়ে রেখে। অনেক সময় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে আব্বাকে, অবৈধ গ্রেপ্তার এড়াতে, অবশেষে যা এড়ানো যাইনি। মেজো আর ছোট ফুপ্পির সঙ্গে আব্বার সম্পর্কটা ছিল পিঠাপিঠি ভাইবোনদের মতোই। মেজো ফুপ্পির দারুণ দক্ষতা ও শখ দেশি-বিদেশি রান্নায়। পোলাও-কোরমা থেকে কেক-পেস্ট্রি এবং এর ভেতর আর যতরকম হতে পারে। উনি প্রায়ই চলে আসতেন আমাদের কাছে মজাদার খাবারের আয়োজন নিয়ে। দাদি বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমরা নয়াপল্টনে দাদির বাড়িতেই থাকতাম। মেজো ফুপ্পি এসে থাকতেন আমাদের সঙ্গে, দাদি মারা যাওয়ার পরও। মনের আরাম পেতেন ভাইয়ের কাছে এসে, আমাদের কাছে এসে। আব্বাকে কাজের ফাঁকে খাবার টেবিলে পেয়ে আলাপ হতো বর্তমানের। সেটা চলে যেত অতীতে আর শেষ হতো ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে। ছোট ফুপ্পির সঙ্গে আব্বার আলাপসালাপ অনেক সময়ই আমাদের জন্য ছিল উত্তেজনামূলক পর্যবেক্ষণ। এ দুই ভাইবোন একেবারে পিঠাপিঠি। দুজনই মনের কথা ব্যক্ত করতে পটু। তাই দুজনের কোনো কথা মাটিতে পড়তে পারেনি, কখনো। তবে বাকবিতণ্ডা শেষে সবসময়ই ফুপির ঠোঁটের কোণে দেখেছি মুচকি হাসি। আজীবন এ দুই ভাইবোন একে অন্যের খেয়াল রেখেছেন। ছোট ফুপ্পি ছিলেন আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অভিভাবক। আব্বার ছোট ভাই আমাদের কাক্কু, সবার ছোট বলে যেমন আদরের তিনি, তেমনি ভাইবোনদের মধ্যে এত ছোট হওয়ায় বোধহয়, তাদের প্রতি তাকে দেখেছি অভিভাবকসুলভ সম্মান দিতে। বিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েও তা ছেড়ে দেন সততার ব্যাপারে একেবারেই আপসহীন এ মানুষটি। সাংবাদিকতায় ভর্তি হয়ে দারুণ রেজাল্ট করেন। বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে যান। যার শেষ করেন বিবিসি বাংলা বিভাগ থেকে অবসর নিয়ে। ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের মধ্যে পরিষ্কার ব্যবধান রেখে আব্বা আর কাক্কু কাজ করে গেছেন যখন দুজনই বিবিসিতে ছিলেন। কাক্কু লন্ডনে, আব্বু ঢাকায়। আর পাঁচটি পরিবারের মতো আমার আব্বার ভাইবোনদের মধ্যেও মতানৈক্য ছিল। তার গণ্ডি পারিবারিক থেকে রাজনৈতিক। তবে তাদের উষ্ণ, আড়ম্বরবিহীন, স্নেহ ভালোবাসা ছিল এসব কিছু ছাড়িয়ে। যার শুরু করে দিয়ে গেছেন আমার দাদা-দাদি এবং নিম্নগামী ভালোবাসার নিয়মে যার পরশে আমরাও আপ্লুত। ভাইবোনদের ছেলেমেয়েদের স্থান ছিল আব্বার হৃদয়ের খুব কাছে। তারাও নিঃশর্ত সম্মান আর ভালোবাসায় ঘিরে রেখেছেন আমার আব্বাকে। তাদের মধ্যে যারা অগ্রজ, তারা ছিলেন তার বন্ধুসুলভ। ব্যক্তি, পরিবার, দেশ সব বিষয়ে ছিল তাদের আলাপচারিতা, উপদেশ দেওয়া-নেওয়া। মাঝে মাঝে মনে হয় আব্বা আর কয়েকটা দিন বেঁচে থাকলে তাদের কারও কারও জীবন হয়তো ভিন্নধারায় বইত কিছুটা। জীবনে এরকম বন্ধুসুলভ অভিভাবক থাকাটা যে এক আশীর্বাদস্বরূপ। আমার বড় চাচাকে আব্বা ও অন্য ভাইবোনরা সবাই ‘ভাই’ বলেই ডাকত। তার চার ছেলেই মুক্তিযোদ্ধা। বড়জন শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশফাকুস সামাদ, বীরউত্তম। খুবই কষ্ট যে, উনার কোনো স্মৃতি নেই আমার। আম্মার কাছে শুনেছি, আব্বা ভীষণ ভালোবাসতেন উনাকে। প্রায়ই আব্বার গাড়ি নিতে আসলে আমাকে কোলে নিয়ে বলতেন কবে আমি বড় হব আর উনি আমাকে উনার সঙ্গে বেড়াতে নিয়ে যাবেন। দুষ্টুমি করে আমায় ডাকতেন ‘গার্বেজ ডিস্পোজার’ বলে। যাই খেতে দেওয়া হতো তাই খেয়ে নিতাম বলে! সব আম্মার কাছে শোনা। আমাদের পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আমার বড় চাচাকে তার ছেলেদের অবস্থান বার করার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন অমানবিক অত্যাচার করে। দাদিকেও চড় দিতে বাধেনি এদের, কারণ তিনি তার মুক্তিযোদ্ধা নাতিদের নাম বলছিলেন না। আব্বাকেও ধরে নিয়ে কী মনে করে বাড়ির দোরগোড়া থেকেই ছেড়ে দেয়। আব্বা তখন পাকিস্তানের ‘দ্য সান’ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি, সেজন্যই হয়তো। আব্বা এই সান পত্রিকার পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কারফিউ আর চেকপোস্ট পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলগত খবরাখবর আদান-প্রদানে সহযোগিতা করতেন তার জীবনবাজি রেখে। আমাদের পরিবারের আরও অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। যার মধ্যে আমার ছোট চাচা আর মামারাও ছিলেন। আমার ফুপ্পিরাও তাদের স্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। পরিবারের কাছ থেকেই সব শোনা। আর তাদের সবার চোখে দেখেছি যুদ্ধে ভালোবাসার মানুষদের হারানোর ব্যথা, একটা সুষ্ট সুন্দর দেশ ব্যবস্থার স্বপ্ন, যেখানে সবাই শান্তি আর স্বস্তিতে বসবাস করবে। এ স্বপ্ন ঘিরেই যেন আব্বার সাংবাদিকতা, তার লেখালেখি, তার পারিবারিক জীবন বহমান ছিল। দাদার বদলির চাকরির দরুন আব্বার বড় হওয়া নানান শহরে। ব্রিটিশ আমল থেকে দাদা শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান আমলে অবসর নেন। আব্বাদের শৈশবের গল্প তাই প্রায়ই শুরু হতো এভাবে, ‘জলপাইগুড়িতে আমাদের লাল গরুটা...’ বা ‘বাবা যখন চট্টগ্রামে...’ অথবা ‘যুদ্ধের সময় কলকাতায়...’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আব্বারা ছিলেন কলকাতায়। সেই সময়ের আব্বার স্মৃতিচারণ আমার মনের পর্দায় পুরোনো দিনের সাদাকালো ছবির মতো। শত্রুপক্ষের বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিষ্প্রদীপ রাতের অন্ধকারে ডুবে যাওয়া, রেশন করে খাওয়াদাওয়া এবং এর মধ্যেও বড়দের অগোচরে ছাদে চলে যাওয়ার গল্প। সিনেমার এক বালকের যুদ্ধের স্মৃতির মতো। সেই সাদাকালো ছবি রঙিন পর্দায় রূপ নেয় যেবার আব্বার সঙ্গে কলকাতা হয়ে দিল্লি যাই। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরপর দিল্লিতে বিবিসির একটি মিটিংয়ে আব্বা, আমাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন! আব্বা কীভাবে যে তাদের কলকাতার সেই বাড়ির ঠিকানা বার করেছিলেন, আজ আমার মনে নেই। তবে মনে আছে, দুজন সেই বাড়ির সামনে হাজির হই আমরা। তৎকালীন বাসিন্দা যিনি দরজা খুললেন তাকে হেসে নিজের পরিচয় দিয়ে আব্বা যখন বললেন তাদের এ বাড়িতে থাকার কথা, ভদ্রলোক আমাদের ভেতরে নিয়ে যান—উঠান, সিঁড়িঘর, ছাদ ঘুরে দেখান, যার জন্য উনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। ছাদে উঠে দিগন্তে চেয়ে আব্বার উদাস দৃষ্টি আর স্মিত হাসিতে ভাসানো মুখখানা আমার হৃদয়ে জলছবির মতো বসানো রবে চিরকাল। ক্ষণিকের তরে শৈশবের সঙ্গে আবার দেখা হওয়া এক প্রায় পৌঢ়ের প্রশান্ত মুখ। আব্বা আর আমার মেয়ের বড় হয়ে ওঠার মধ্যে মিলটা হলো তারা দুজনই বিভিন্ন জায়গায়, নানানরকম মানুষ ও সংস্কৃতির ছোঁয়ায় বড় হয়েছে, তাদের বাবার চাকরির সুবাদে। এদের স্বভাবে যে মিলগুলো আমি দেখেছি, তা আমার বিবেচনায় অনেকটাই এ সংস্পর্শের প্রভাব। বিশেষ করে অন্যকে চট করে কাঠগড়ায় না দাঁড় করিয়ে তার দৃষ্টিকোণ বোঝার চেষ্টা আর স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো স্পৃহা। আব্বা সাংবাদিক জীবনের পুরোটাই মানুষের সংগ্রাম, অধিকার আর মুক্তির কথা বলে গেছেন। তুলে ধরেছেন সমস্যা, দাবি করেছেন সমাধান। রাজনীতি, সরকার, প্রশাসনকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছেন। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে লক্ষ করেছি তার লেখায় তাদের সবসময় জবাবদিহির মধ্যে রাখার। তাই এমন প্রায়ই শুনেছি আমার আব্বাকে ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলের বলে আখ্যায়িত করতে। বিফল হয়েছে তারা। কারণ আমার আব্বা মানুষের কথা বলেছেন। কোনো দলের নয়। ২০০০ সাল থেকে প্রায় এক যুগ বেঁচেছিলেন আমার আব্বা। আর এ পুরো সময়টাই আমি পার করেছি বিদেশ-বিভুঁইয়ে, জীবন সংগ্রামে, জীবনের মানের খোঁজে। স্বভাবতই আব্বার আরও কাছে, তার পাশে সশরীরে না থাকার আক্ষেপ আমার বাকি জীবনের সহযাত্রী। এই সময় আব্বা মূলত কলামিস্ট হিসেবে আমার দেশ, যুগান্তর, প্রথম আলো, যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন বাংলা পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। এনটিভির ক্রান্তিকালে তার প্রধান হয়ে হাল ধরে পার করেছেন। আর তার আজীবনের শখ নিজে একটা সাপ্তাহিক বের করার, সেই শখ পূরণ করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, আমি এই সাপ্তাহিক বের করার পক্ষপাতী ছিলাম না। আমি তখন ক্যারিবিয়ানে মুক্তোর মতো এক দ্বীপ সেন্ট লুসিয়াতে থাকি। আব্বা আর আমার ছোট বোন বেড়াতে এসেছিল সেখানে। সেন্ট লুসিয়ার নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক স্যার ডেরিক ওয়ালকটের সঙ্গে দেখা করে তার ওপর লেখেন যায়যায়দিন-এ। স্নিগ্ধ সুন্দর সাগরসৈকতে বসে আব্বাকে একদিন বুঝিয়েছি, জীবনের শেষ সঞ্চয় দিয়ে পত্রিকা বার না করে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলো। যখন আর লেখালেখি করতে পারবে না ওটার ভাড়া দিয়ে চলবে। আর মনের কথা, দশের কথা তো লিখে যাচ্ছোই পত্রপত্রিকায়, বলে যাচ্ছো টিভিতে, টকশোতে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে আব্বা বললেন, ‘ভালো বুদ্ধি দিয়েছ, দেখি।’ ফিরে গিয়ে আব্বা তার সাপ্তাহিক ‘এখন’ প্রকাশ করল। আর আমি সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে বসে নিজেকে বোঝালাম—চেনোই তো আব্বাকে! মনে পড়ল আমার জীবনের প্রথম চাকরির প্রভিডেন্ট ফান্ডের থেকে পাওয়া টাকাটা আব্বার হাতে তুলে দিয়েছিলাম মহাসুখীতে। তার প্রয়োজন হোক বা না হোক, আব্বার পাশে দাঁড়িয়েছি ভেবে মন অপলুপ্ত, আব্বা সেটা আরও খুশি হয়ে গ্রহণ করেছিলেন। চেকটা হাতে নিয়ে বলেছিলেন, কোনো একটা পত্রিকা বেশ মুশকিলে আছে। সাংবাদিকরা বেতন পাচ্ছে না, এ টাকাটা ওখানে দিলে আমার কোনো আপত্তি আছে কি না? এই হলো আমার আব্বা! তার মেয়ে হয়ে আমার আপত্তির প্রশ্নই আসেনি সেদিন। জীবনসংগ্রামী খেটেখাওয়া আমার আব্বাকে ক্লান্তি ধরে ফেলেছিল শেষের দিকে, তখন ঠিক বুঝতে পারিনি। পরে ছোট ফুপ্পি একদিন বলেছিলেন, অসুস্থ হয়ে পড়ার কয়েক দিন আগে তার বাড়িতে এসে ঘরের কোণে চেয়ারটাতে বসতে বসতে বলেছিলেন আব্বা, ‘বুঝলে দিলু বোন, আর পারি না, কষ্ট হয়।’ আর সেই সময়ের কিছু লেখায়ও এ ক্লান্তির কথা উঁকিঝুঁকি দিয়েছে। তখন পড়ার সময় হয়নি। এখন চোখের পানি ভাসিয়ে পড়ি। প্রার্থনা করি তার বিশ্রাম যেন হয় চিরপ্রশান্তির। আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি স্রষ্টাকে এমন মানুষকে আমার আব্বা হিসেবে উপহার দেওয়ার জন্য। আব্বার কথা ভাবলেই আরেকটা প্রার্থনা মন থেকে এসে যায়। সেটা হলো আমরা যেন চেষ্টা করি সমষ্টির জন্য ভাবার, করার, আমাদের সাধ্যমতো। এটা বাস্তব যে, সবার অবদান এক হওয়ার নয়। যেমন আমি আতাউস সামাদ নই। তবে আমার দর্শন, দেশ বা দশের জন্য করার তাগিদ থাকলে প্রত্যেকেই নিজ অবস্থান থেকে কিছু না কিছু গঠনমূলক কাজ আমরা করতে পারি। তাতে আনন্দ আছে, আছে জীবনকে আরও সুন্দর করে বোধ করার। একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ-পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার যা দিয়ে তারা গড়তে পারবে তাদের সুন্দর বর্তমান। আর চাকাটা এভাবেই ঘুরতে থাকতে পারে উত্তরণের দিকে। আব্বার জীবনদর্শনে সে চেষ্টা ও আশা রবে চিরন্তন। ভালো থাকবেন।

লেখক: প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদের মেয়ে

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে মাস্ক ও স্যানিটাইজার বাধ্যতামূলক

বিএনপির এমপি মনোনয়ন পেতে লাগবে তিন যোগ্যতা

স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেই : অপু 

তেহরান ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ

কক্সবাজারে বাস-কাভার্ডভ্যানের সংঘর্ষে নিহত ৩

দুই যুবককে অমানুষিক নির্যাতন, ভিডিও ভাইরাল 

ইরানের হামলায় ইসরায়েলের বিদ্যুৎ গ্রিড ক্ষতিগ্রস্ত

দুশ্চিন্তা ও ঋণ থেকে মুক্তি লাভে যে দোয়া পড়বেন

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে বেড়ে গেল তেলের দাম

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে রাতভর যা হলো

১০

ইরানের সঙ্গে লেবাননও কি এই যুদ্ধে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়ছে?

১১

১৬ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১২

ঢাকায় বজ্রবৃষ্টির পূর্বাভাস

১৩

ইরান-ইয়েমেনের একযোগে হামলা ইসরায়েলে

১৪

চলন্ত বাসে গার্মেন্টস কর্মীকে পালাক্রমে ধর্ষণ, অতঃপর...

১৫

ইরানের নবম দফার হামলায় জ্বলছে ইসরায়েল

১৬

ইসরায়েলের হামলায় হতাহতের সংখ্যা জানাল ইরান

১৭

সোমবার ঢাকার যেসব এলাকায় মার্কেট বন্ধ

১৮

১৬ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৯

ইরানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য জরুরি হটলাইন চালু

২০
X