ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছেই। ধারাবাহিকভাবে অস্বাভাবিক রকমের এ ঋণ বৃদ্ধি শুধু ব্যাংক নয়, দেশের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান তো বটেই, সার্বিক অর্থনীতির জন্যই কল্যাণকর নয়।
সোমবার দৈনিক কালবেলায় এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের চিত্র হতাশার। প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছরের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এতে বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা ভয়াবহ।
২০২৫ সালের মার্চ শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। গত রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসায় মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে এ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাঘববোয়াল ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের লুটপাটের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে বলে এখন তা বাড়ছে। এরা আগেও ঋণখেলাপি ছিল। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় ব্যাংকগুলো তাদের ঋণখেলাপি দেখাতে পারত না। তারা বলছেন, এটাও প্রকৃত চিত্র নয়। প্রকৃত চিত্র আরও ভয়ানক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর নতুন গভর্নরের নেতৃত্বে জুন প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। তাড়াহুড়ো করে ওই সময় খেলাপির তথ্য প্রকাশ করায় প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যায়নি। এরপর নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার নির্দেশ দেন। এর পর থেকে বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণ।
দেশের ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বৃত্ত থেকে কেন বের হতে পারেনি—এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হয় বিগত আওয়ামী সরকারের পতনের পর। মূলত ব্যাংক দুর্নীতি, অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে শিথিলতাসহ বহুভাবে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণহীন জায়গায় পৌঁছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া।
বিগত সরকারের সময় দুর্নীতি, অনিয়ম, পাচারসহ নানামুখী অপকর্মের মাধ্যমে দেশের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান নাজুক অবস্থায় পৌঁছে। সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বেগ পেতে হচ্ছে সরকারকে। ব্যাংক খাত কিছুটা হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রচেষ্টায় কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বা ধীরে ধীরে দাঁড়াচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
আমরা মনে করি, কারণ যা-ই থাক, খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির এ চিত্র দেশের ব্যাংক খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। ঋণ যেন কুঋণে পরিণত না হয়, এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর যতটুকু সতর্ক ও সজাগ থাকার কথা, বিগত সময়ে তাতে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে কমতি ছিল না; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে ব্যাংকখেকোদের যে দৌরাত্ম্য নেই এবং ভবিষ্যতে থাকবে না—এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে—এটাই বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা মানুষের। আমরা প্রত্যাশা করি, ব্যাংকে সুশাসন, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার পরিবেশ গড়ে উঠবে যেন নতুন করে ঋণ খেলাপি না হয়। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টরা খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবেন।
মন্তব্য করুন