কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে নারীদের গোসলের আপত্তিকর কিছু ভিডিও ফেসবুক জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই ভিডিওগুলো যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে, তারা তা বুস্টও করে দিচ্ছে, যাতে মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছায়। এটা তাদের ফেসবুক পেজের ভিউ ব্যবসার একটি অপপলিসি। ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে, কেউ দূর থেকে গোপনে ভিডিও অন করে রেখেছে এবং সৈকতে যেসব নারী ও কাপল গোসল করছে, তাদের টার্গেট করে করে তারা ভিডিও ধারণ করছে। তাদের টার্গেট হচ্ছে, গোসলের সময়কার দৃশ্য ধারণ করে মানুষকে দেখিয়ে ফেসবুক ভিউ বাড়িয়ে অর্থ ইনকাম করা। অথচ যাদের ভিডিও করা হচ্ছে তারা জানতেই পারছে না, তাদের কেউ গোপনে ভিডিও করছে। তারা যখন জানতে পারছে তখন আর কিছু করার থাকছে না। ততক্ষণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওগুলো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের এমন নীচস্তরের চিন্তার ভাঁজে আটকে যাচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন, মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থায় প্রচণ্ড আঘাতে আছড়ে পড়ছে এর প্রভাব। মানুষ তার স্বাভাবিক চিন্তার প্রকোষ্ঠে আর দণ্ডায়মান নেই, মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে যে কোনো হীন কাজ করতে প্রস্তুত। অন্যের জীবনের সামাজিক সিকিউরিটির বিষয়ে মানুষ এখন আর চিন্তা করে না। মানুষ শুধু তাদের নিজেদের একরোখা ঐচ্ছিক নেতিবাচক চিন্তার প্রতিফলনেই পথ চলে। সে ক্ষেত্রে কার কী হলো, সেটা বিবেচনার একদমই সময় নেই কারোরই।
এ কাজ যারা করছে তারা একত্রে একটি অসাধু দুষ্টচক্র, যাদের বেশিরভাগই সমুদ্রসৈকতে ছবি তোলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সমুদ্রসৈকতে যে পর্যটকরা বেড়াতে যান, তাদের বেশিরভাগই এ চক্রের দুষ্টচক্রে বন্দি হয়ে পড়েন। তারা ছবি তোলার নাম করে হাতিয়ে নেয় বড় রকমের অর্থ এবং সেই সেইসঙ্গে অনেককে আবার হয়রানিও করে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গেলেই ক্যামেরা হাতে দেখা যায় এমন অজস্র ফটো কুচক্রী মহলকে এবং এসব ভিডিও ধারণের সঙ্গে এ চক্রটিই মূলত জড়িত বলে অনেকেই প্রমাণ পেয়েছে। সেদিন একজন বলল, এক নারী তার স্বামীর সঙ্গে গোসল করছে আর একজন দূর থেকে তাদের দিকে ক্যামেরা তাক করে ভিডিও করছে। কিন্তু তারা জানতেই পারছে না তাদের কেউ গোপনে ভিডিও করছে।
এ অঞ্চলে কোথাও মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের প্রাইভেসি নেই। সর্বত্র মানুষ তার হাতে থাকা ক্যামেরা নিয়ে অন্যের ব্যক্তিগত জীবন বিষিয়ে তুলছে। কেউ তার জীবনকে স্বাভাবিকভাবে যাপন করতে পারছে না। আমি এমন অনেক মানুষকে চিনি যাদের ক্যামেরা ফোবিয়া রয়েছে। সেই মানুষগুলোকে যখন জোরপূর্বক ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হয়, তখন তারা বিব্রত হয়; তারা সেটাকে পজিটিভভাবে গ্রহণ করে না।
সবাই যেখানে ছবি ভিডিও নিয়ে মাতামাতি করে সেখানে এমন দুই-চারজন থাকে যারা ছবি বা ভিডিওতে থাকতে চায় না। এটাকে অনেকে তার ইগো হিসেবে দেখে বা তাকে নেতিবাচক প্রভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু না, এটা তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া; কারণ ক্যামেরা ফোবিয়ায় আক্রান্ত এমন অনেক মানুষ আছে যারা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে বিব্রত হয় এবং অস্বাভাবিক বোধ অনুভব করে।
বাংলাদেশে খুব বেশি পর্যটন কেন্দ্র নেই। এর মধ্যে কক্সবাজার সবচেয়ে জনপ্রিয়। কিন্তু সেই কক্সবাজারে যদি মানুষ ব্যক্তিগত সিকিউরিটির সুবিধা না পায়, তাহলে তো তারা কক্সবাজারে যাবে না। বাংলাদেশের পর্যটন যে কেন্দ্রগুলো রয়েছে, সেগুলো এমনিতেই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ নয়। সেখানে যদি কেউ ভ্রমণ শেষ করে এসে দেখে যে তাদের ভিডিও ফেসবুক জুড়ে যৌন উসকানির খোরাক জোগাচ্ছে, সেখানে মানুষ আর পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যেতে চাইবে? অবশ্যই চাইবে না।
এক বাবা তার মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার দেখাতে নিয়ে গেছেন। গোসল করছেন। সেখানে কেউ গোপনে ভিডিও করে ক্যাপশন দিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধ তার বউকে নিয়ে সমুদ্রস্নান করছে। এমন ক্যাপশনের পর সেই বাবা ও মেয়ের মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, একবারের জন্য সেই ভিডিও কুচক্রী গোষ্ঠী ভেবে দেখেছে; দেখেনি। যারা এগুলো করছে তারা অর্থ ও ফেসবুক জনপ্রিয়তার জন্য যে কোনো কিছুই করতে পারে। তাদের কাছে এসব বিষয় খুব স্বাভাবিক, কারণ নৈতিকতা বোধ তাদের বিলুপ্ত হয়েছে।
পরিচিত এক নতুন বিবাহিত দম্পতি কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে এমন ভিডিও জটিলতার শিকার হয়েছে। বেড়ানো শেষ করে বাড়িতে ফিরে তারা নিজেদের আবিষ্কার করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের টাইমলাইনে। তাদের দেখা যাচ্ছে সমুদ্রসৈকতে গোসলরত অবস্থায়। ভিডিওর ভিউ দাঁড়িয়েছে ওয়ান মিলিয়নে। তারা তো রীতিমতো বিস্মিত। এটা কীভাবে সম্ভব! এমন পরিস্থিতি তাদের মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ভাবা যায়।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে মানুষ বেড়াতে গিয়ে যদি এমন অপ্রীতিকর ও শ্লীলতাহানির স্বীকার হয় তাহলে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ দিন শেষে একটু ভ্রমণে যায় তাদের ক্লান্তিকর সময় অতিক্রম করতে। একটু স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ অনুভব করতে। সেখানে যদি উল্টো তাদের সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে কেন তারা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে যাবে।
যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে যারা এই ভিডিও সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। তাহলে পরবর্তী সময়ে অন্যরা এই অপকর্ম করতে সাহস করবে না। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের প্রাইভেসি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর প্রতি মানুষ ক্রমাগত আগ্রহ হারাবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিককর্মী
মন্তব্য করুন