মদনমোহন তর্কালঙ্কার ছিলেন বাংলা ভাষার কালজয়ী পণ্ডিত। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাংলার (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ) নদীয়া জেলায় ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি এই প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মার্চ। তিনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহপাঠী। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হিন্দুদের মধ্যে বিধবা-বিবাহ প্রচলনের আন্দোলনে বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে পেয়েছিলেন অন্যতম প্রধান সহযোগী হিসেবে। শিক্ষাজীবন শেষে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। ভারতবর্ষে, বিশেষত বাংলায় নারী শিক্ষার প্রসারেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ১৮৪৯ সালে কলকাতায় বেথুন মহিলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার দুই কন্যাকে সেখানে ভর্তি করেন এবং কিছুদিন সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেন।
মদনমোহন তর্কালঙ্কার শিশুদের শিক্ষাবিষয়ক বেশ কয়েকটি বই রচনা করেছেন। তার প্রণীত ‘শিশুশিক্ষা’ পুস্তিকাটির প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে। এর দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় পরের বছর। শিশুশিক্ষার তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগ পরে প্রকাশিত হয় ‘বোধোদয়’ নামে। আমাদের পূর্বপুরুষগণ তার রচিত শিশুশিক্ষা পুস্তিকা দিয়েই শিক্ষাজীবন শুরু করতেন। আমাদের শিক্ষা শুরু হতো শ্রীবেণীমাধব দাস প্রণীত ‘বর্ণবোধ’ নামের ক্ষুদ্রাকৃতির পুস্তিকা দিয়ে। তারপর হাতে আসত সীতানাথ বসাক প্রণীত ‘আদর্শ লিপি ও বর্ণপরিচয়’ পুস্তিকাটি। এ পুস্তিকাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে। পরে অবশ্য বাংলাদেশ সংস্করণও বেরিয়েছে। পুস্তিকাগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তাতে বর্ণ পরিচয়ের পাশাপাশি চরিত্র গঠনমূলক কিছু বাণী উদ্ধৃত থাকত। এর মনস্তাত্ত্বিক কারণটি হলো, পুস্তিকাগুলোর প্রণেতারা শিশুদের মগজ-মননে নীতি-আদর্শকে প্রবেশ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। তাদের ভাবনা ছিল, যেহেতু শিশুদের মন নরম, তাই তাদের মনে যে ভাবনাটি বসিয়ে দেওয়া যাবে, পরবর্তী সময়ে তা স্থায়ী হয়ে একটি শিশুকে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক হবে। শিক্ষাজীবনের শুরুতে ওইসব পুস্তিকা পাঠে শিশুরা অক্ষরজ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আদর্শ এবং নীতিনৈতিকতা সম্বন্ধেও জ্ঞানলাভ করত। এখন আর তেমনটি দেখা যায় না। এখন শিশুদের পড়াশোনা শুরু হয় বাংলায় ‘হাট্টিমা টিম টিম/ তারা মাঠে পড়ে ডিম’ এবং ইংরেজিতে ‘বা বা ব্ল্যাক শিপ, হ্যাভ ইউ অ্যানি উল’ ধরনের উদ্ভট ও অর্থহীন ছড়া দিয়ে। নীতিনৈতিকতা কিংবা আদর্শের শিক্ষার বালাই নেই। লক্ষ্য যখন কোনোমতে সার্টিফিকেট অর্জন, তখন নৈতিক শিক্ষার ধার কে ধারে? সে কারণে বর্তমানে একটি আদর্শহীন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে আমাদের সমাজে।
পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের একটি বহুল পঠিত কবিতার নাম ‘আমার পণ’। কবিতাটি আমরা ক্লাস টুয়ে পড়েছি বোধহয়। একজন শিশুর পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য কবিতাটি যেন একটি বাতিঘর। কম্পাস কিংবা রাডার আবিষ্কারের আগে সমুদ্রপথে রাতের বেলায় সঠিক পথে জাহাজ চলাচলের সুবিধার্থে উপকূল ঘেঁষে বসানো থাকত উঁচু টাওয়ার। সেখানে রাতভর জ্বলত উজ্জ্বল আলোর বাতি। এ টাওয়ারকে বলা হতো বাতিঘর। তেমনি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের আমার পণ কবিতাটিও যেন একটি বাতিঘর। চতুর্দশপদী এ কবিতাটি শুরু হয়েছে ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,/ সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।/ আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,/ আমি যেন সেই কাজ করি করি ভালো মনে’ দিয়ে। এই চারটি লাইনে রয়েছে একটি শিশুকে তার জীবন-প্রাতে ভালো হওয়ার উপদেশ। সে তার জীবনের শুরুতেই পণ করবে একজন ভালো মানুষ হওয়ার এবং সারা জীবন সে পথেই চলবে। কবি এখানে ‘সারাদিন’ বলতে একজন মানুষের সারা জীবনকেই বুঝিয়েছেন। কবি শিশুদের বুঝিয়েছেন গুরুজন, মানে মুরব্বিদের আদেশ মেনে চলতে হবে। মুরব্বি সে পিতা-মাতা-শিক্ষক যিনিই হোন, তিনি কখনো তাদের সন্তান বা ছাত্রকে খারাপ কাজ করতে উৎসাহিত করতে পারেন না; যদি তারা বোধসম্পন্ন অভিভাবক বা নীতিজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষক হন। অবশ্য এখন এ ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। কোনো পিতা-মাতা তার সন্তান এলাকার সেরা মাস্তান—এটা ভেবে অহংবোধে ভোগেন। এমনকি বখে যাওয়া সন্তানকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিলেও পিছপা হন না কেউ কেউ। আর শিক্ষকদের একাংশ তো ব্যক্তিস্বার্থে ছাত্রদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেন না!
কবিতাটির এর পরের চার লাইন এরকম—‘ভাইবোন সকলেরে যেন ভালোবাসি,/ একসাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।/ ভালো ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা,/ পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।’ কবি এখানে ভাইবোন সকলেরে ভালোবাসার কথা বলে মানুষকে ভালোবাসার কথাই বলেছেন। মানবজীবনের একটি অন্যতম মূল্যবোধ হলো মানবপ্রেম। মানুষ যদি মানুষকে ভালো না বাসতে পারে, তাহলে সে নিজে যেমন মনুষ্য সারিতে বসার যোগ্য হয় না, তেমনি এই সমাজ-সংসারও হয়ে ওঠে অস্বস্তিকর। কবি মদনমোহন তর্কলঙ্কারের এই চার পঙক্তিতে স্বামী বিবেকানন্দের ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’ বাণী ভাস্বর হয়ে ওঠে। মানুষকে যে ভালোবাসতে না পারে, সে প্রকৃত অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। আর ভালো মানুষ হতে হলে একটি শিশুকে মিশতে হবে ভালো ছেলেদের সঙ্গে, মন দিতে হবে পড়াশোনায়।
আমার পণ কবিতার শেষ ছয়টি লাইন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কবি বলেছেন, ‘সুখী যেন নাহি হই আর কারও দুখে,/ মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।/ সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি/ কিছুতে কাহারে যেন নাহি দিই ফাঁকি/ ঝগড়া না করি যেন কভু কারও সনে,/ সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।’ সহৃদয় পাঠক, খেয়াল করুন, কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার অন্যের দুঃখে আমাদের সুখী না হতে বললেও আমরা কিন্তু উল্টোটাই করি। আমরা অপরের কষ্টে শুধু আনন্দই পাই না, বরং অপছন্দের মানুষটিকে বিপদে ফেলে কষ্টে রাখার চেষ্টা করি। অপরকে দুঃখ দিয়ে আমরা কেউ কেউ এক অপার আনন্দ লাভ করি। আমাদের মধ্যে অনেকের পরম সাধনা হয়ে দাঁড়ায় অপছন্দের মানুষটির জীবনচলার পথে মান্দার কিংবা বাবলা কাঁটা বিছিয়ে রাখা। তখন ওইসব মানুষের আরাধ্য হয়ে ওঠে—‘অপরের চোখের জল দেখিলেও শান্তি’। তাই বলে এটা বলছি না, সমাজের সবাই এ চরিত্রের। তবে চোখকান খোলা রেখে চললে এমন মানুষের আধিক্য নজর এড়াবে না কিছুতেই। পরের লাইনে কবি নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছেন, মিথ্যা কথা বলা থেকে। অথচ আমরা কারণে-অকারণে গলগল করে মিথ্যের ‘ন্যক্কার’ উগড়ে দিই। এসব মিথ্যে কখনো বলি আপন স্বর্থোদ্ধারের জন্য, কখনোও নিজের কৃত অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। এমনকি এজন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যে বলিব না’ অঙ্গীকার করেও অবলীলায় মিথ্যা বলে যায় কেউ কেউ।
কবি শেষ দুই লাইনে লোভ সামলে চলার পণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু আমরা কি তা পারি বা পারছি? ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’ প্রবাদটি জানা সত্ত্বেও আমরা লোভের বশবর্তী হয়ে এমনসব অপকর্মে লিপ্ত হই, যার পরিণতি হয়ে দাঁড়ায় অনিবার্য ধ্বংস। এর উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। মানুষের লোভ বহুমাত্রিক। একেকজনের একেকরকম লোভ থাকে। কারও লোভ থাকে টাকাকড়ি সহায়সম্পদের প্রতি, কারও থাকে খ্যাতি-প্রতিপত্তির। আবার নারীলোভ অনেককে করে তোলে উন্মত্ত পশু। কবি রফিক আজাদ তার কালজয়ী কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা’য় যথার্থই বলেছেন, “অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়;/ বাড়ি গাড়ি টাকাকড়ি-কারো বা খ্যাতির লোভ আছে,/ আমার সামান্য দাবি; পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর—/ ভাত চাই—এই চাওয়া সরাসরি— ঠান্ডা বা গরম,/ সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে /কোনো ক্ষতি নেই, মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাই;”। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে উপজীব্য করে প্রগতিবাদী কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন কবিতাটি। কবিতাটির ছত্রে ছত্রে মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম উপকরণ খাদ্যের জন্য হাহাকার ফুটে উঠেছে। কবিতাটি এখনো প্রাসঙ্গিক। যেখানে দেশের কোটি কোটি মানুষের দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠছে, কেউবা অপরের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে ভিখিরির হাত, সে সময়ে আমরা দেখি অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার লোভে একশ্রেণির মানুষ ডুবসাঁতার কাটছে দুর্নীতির পঙ্কিল ডোবায়।
মানুষের প্রবৃত্তির মধ্যে লুক্কায়িত যে ছয়টি শত্রু বা রিপু রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে লোভ অন্যতম। লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ অনেক সময় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। লোভকে বলা হয় পাপের বাপ, আর মিথ্যাকে বলা হয় পাপের জননী। যারা লোভ সামাল দিতে পারে না, তাদের পাপের মায়ের আঁচলের তলায় আশ্রয় নিতে হয়। কারণ লোভের বশবর্তী হয়ে সে যে পাপকাজ করে, তাকে ঢাকা দেওয়ার জন্য তাকে নিতে হয় মিথ্যার আশ্রয়। আর একটি মিথ্যাকে ধামাচাপা দিতে আশ্রয় নিতে হয় শত মিথ্যার।
আজ সমাজে যে অনাচার-ভ্রষ্টাচার পরিলক্ষিত হয়, তার মূলে রয়েছে মূল্যবোধ সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষার অভাব। আর মূল্যবোধের সে শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হওয়ার সবচেয়ে উত্তম সময় একজন মানুষের শিশুকাল। শিশুকালে একজন মানুষ তার পরিবার কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূল্যবোধের শিক্ষা লাভ করলে, পরবর্তী জীবনে সে হয়ে উঠতে পারে মানুষের মতো মানুষ। কিন্তু এখন আমাদের শিশুরা মূল্যবোধের শিক্ষা পায় না। না বিদ্যালয়ে, না পরিবারে। একজন শিশু যখন দেখে তার পিতা অবৈধ আয়ে সংসার চালাচ্ছে, তখন সে ধরে নেয় এটাই প্রথা। তার নীতিবান হয়ে ওঠার পথ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়।
শেষপ্রান্তে এসে একজন মহীয়সী নারীর কথা না বলে পারছি না। তিনি বিখ্যাত কেউ নন, বাংলাদেশের আর দশজন মায়ের মতোই অতিসাধারণ। তিনি আমার মা, আমার প্রথম শিক্ষক। অক্ষরজ্ঞান লাভ করেছিলাম তার কাছেই। তিনিই আমাকে এই কবিতাটির প্রথম চার লাইন শিশুকালে শুনিয়েছিলেন। তারপরই কবিতাটি গেঁথে গিয়েছে মনের গহিনে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন