২০২৪ সালের জুলাই মাসের শেষদিকের উত্তাল দিনগুলোতে, যখন ঢাকা শহর কারফিউর অধীনে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখনই মৃতদেহগুলো আসতে শুরু করে রায়েরবাজার কবরস্থানে। কোনো সাইরেন বাজেনি, হয়নি কোনো শোকযাত্রা, কাঁদেনি কোনো স্বজন। প্রতিটি মরদেহ মোড়া ছিল সাদা কাপড়ে—পরিচয়হীন, নীরব। ছিল না কোনো মৃত্যু সনদ, হয়নি কোনো ময়নাতদন্ত। একটার পর একটা মরদেহ দ্রুত মাটিচাপা দেওয়া হয়—মুছে ফেলা হয় তাদের অস্তিত্ব। ব্লক ৪-এর প্রতিটি কবরে গাঁথা ছিল শুধু একটি করে বাঁশের কঞ্চি।
আন্দোলনে নিহত অন্তত ১১৪টি মরদেহ কবর দেওয়া হয় রায়েরবাজারে—এর বেশিরভাগই ১৯ থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে, যখন ‘গুলি করার নির্দেশ’সহ কারফিউ জারি ছিল। তারা কেউ দুর্ঘটনার শিকার ছিলেন না, ছিলেন না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। তারা ছিলেন আন্দোলনের শহীদ—ছাত্র, শ্রমিক, পথচারী—যাদের কবর দেওয়া হয় পরিচয়হীন অবস্থায়, কোনো কাগজপত্র ছাড়াই, কোনো জবাবদিহি ছাড়াই। অসংখ্য পরিবার তখন মরিয়া হয়ে খুঁজছিল তাদের প্রিয়জনকে—থানায়, হাসপাতালে, মর্গে; কিন্তু বারবার ফিরতে হয়েছে খালি হাতে।
এটি ছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকার এক বর্বর প্রয়াস। তার সরাসরি নির্দেশেই দেশ জুড়ে জারি হয় কঠোর কারফিউ। দেওয়া হয় ‘গুলি করার অনুমতি’। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক। তবুও সব বাধা, সব নিপীড়ন অগ্রাহ্য করে প্রতিদিন রাস্তায় নামে আমাদের সন্তানরা, বুকভরা সাহসে ভয়কে পেছনে ঠেলে। কিন্তু জবাব এসেছিল কথায় নয়, এসেছিল গুলিতে। প্রতিদিনই বাড়ছিল মৃতের সংখ্যা। হাসপাতালগুলো হয়ে উঠেছিল নীরব মর্গ। রায়েরবাজার রূপ নেয় নামহীন শহীদদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এক প্রতীকী স্থানে। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ।
এই মুছে ফেলা ছিল না কোনো ভুলবশত ঘটনা, এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। মরদেহ ব্যবস্থাপনার যে ন্যূনতম নিয়ম ডকুমেন্টেশন, ডিএনএ নমুনা, ময়নাতদন্ত—সবকিছুই উপেক্ষা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, কীভাবে পুলিশ ভ্যানে তাড়াহুড়ো করে একসঙ্গে ১০ থেকে ১২টি মরদেহ এনে ফেলা হতো, সাদা কাপড়ে মোড়া, পরিচয়হীন। কবর খোঁড়ার শ্রমিকরা নিঃশব্দেই সেই মরদেহগুলো একটির পর একটি লম্বা গর্তে মাটিচাপা দিতেন—প্রতিটি কবরে গাঁথা হতো শুধু একটি বাঁশের কঞ্চি।
এ প্রক্রিয়াটি ছিল দ্রুত, নিঃশব্দ এবং নিখুঁত আর ঠিক সেখানেই ছিল মুছে ফেলার চূড়ান্ত নির্মমতা। শুধু কয়েক দিনের মধ্যেই এভাবে ডজনের পর ডজন মরদেহ মাটির নিচে হারিয়ে যায়। গোরখোদকদের ভাষায়, তাদের ওপর ছিল চাপ—চুপচাপ, দ্রুত সমাধি দিতে হবে। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল একটি সংঘটিত অপরাধের অংশ—একটি ‘হত্যা-যন্ত্র’, যা বেওয়ারিশ দাফনের আড়ালে মৃতদের অদৃশ্য করে দিচ্ছিল। রায়েরবাজারের সেই গণকবরগুলো আজ নিশ্চুপ। কিন্তু তাদের নীরবতা বয়ে আনে প্রতিধ্বনি—প্রশ্নের, শূন্যতার আর সেই করুণ নিস্তব্ধতার, যা ঘিরে রেখেছে একেকজন মানবসন্তানকে, যারা আর কখনো ফিরে আসেননি। যে শহর একদিন গমগম করত প্রতিরোধের স্লোগানে, আজ সেখানে ভেসে আসে অন্যরকম এক কান্না—অস্ফুট, করুণ, কিন্তু অন্তহীন। যে প্রতিটি মরদেহ কবর দেওয়া হয়েছে নাম ছাড়া, সেখানে একেকটি পরিবার রয়ে গেছে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তায়। আর যে প্রতিটি কবরে গাঁথা আছে শুধু একটি বাঁশের কঞ্চি, তার নিচে চাপা পড়ে গেছে একটি করে না-বলা গল্প।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের বাইরে এক মা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন—হাতে তার ছেলের একটি ঝাপসা ছবি। আগের রাতে তিনি একজন হাসপাতাল কর্মচারীকে ঘুষ দিয়েছিলেন, যেন অন্তত একবার হিমঘরে ঢুকে মরদেহগুলো দেখতে পারেন। যখন সেই কর্মচারী ফিরে এসে মাথা নাড়েন, তিনি সিঁড়িতে বসেই ঢলে পড়েন। ‘ও নেই’, কেউ একজন ফিসফিস করে বলে। তিনি চিৎকার করেন না। চলে যান না। তিনি শুধু বসে থাকেন—শুধু ঘণ্টা নয়, দিনের পর দিন। আরেকজন মা শুধু একটি তিল দেখে বুঝেছিলেন যে মৃতদেহটি তার ছেলের। কিন্তু তখনো সেই মরদেহ ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে কবর দেওয়া হয়ে গেছে। এগুলো শুধু শোকের দৃশ্য নয়, এগুলো একেকটি হারিয়ে যাওয়া মুহূর্ত। যে শোকে সত্য নেই, তা শোক নয়, তা এক প্রকার নির্যাতন।
এক নারী এসেছিলেন রায়েরবাজার কবরস্থানে—ভাঙা মোবাইল স্ক্রিনে ছিল তার ভাইয়ের ছবি। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তার চাচা। তিনি দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করেন, এমন কাউকে কি তিনি দেখেছেন? দারোয়ান মুখ ফিরিয়ে একটি বাঁশের কঞ্চির সারির দিকে ইশারা করেন। ‘সেদিন বারোটা দেহ কবর দিয়েছিলাম’—চাপাস্বরে বলেন তিনি। সেখানে কোনো নাম ছিল না। কোনো তালিকা ছিল না।
ছিল শুধু মাটির সারি আর খাড়া করে গাঁথা কঞ্চিগুলো। নারীটি মোবাইলটা আরও শক্ত করে ধরেন, আর ফিসফিস করে বলেন, ‘সে তো শুধু ভিডিও করছিল।’ তারা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন মাটি থেকেই কোনো উত্তর আসবে বলে অপেক্ষা করেন। কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। তারা চুপচাপ ফিরে যান।
যখন একের পর এক মৃতদেহ হারিয়ে যেতে থাকে সেই গণকবরে, তখন পরিবারগুলো ছটফট করে একটিমাত্র খবরে আশায়—কিন্তু চারপাশে কারফিউ, বন্ধ যোগাযোগ, নেই কোনো আহত বা নিহতের তালিকা।
মায়েরা মর্গের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন—হাতে ছবি, কণ্ঠে মিনতি। বাবারা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়ান এই আশায়, হয়তো ছেলে এখনো ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে কবর দেওয়া হয়নি। কেউ কেউ আটক হন চেকপোস্টে, জেরা করা হয়, ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আবার কেউ ঘুষ দেন মর্গের কর্মচারীকে—শুধু এক ঝলক দেখার সুযোগ পাওয়ার জন্য। তবে অধিকাংশ সময়ই জোটে শুধু হতাশা।
এই যে মানসিক যন্ত্রণা, এর পরিমাণ পরিমাপ করা যায় না। এ পরিবারগুলো শুধু বেদনায় ভারাক্রান্ত নয়, তাদের প্রিয়জনদের মতো তারাও যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। তারা বাস করছে এক অসমাপ্ত শোকে—যেখানে নেই কোনো কবর, নেই কোনো মোনাজাত, এমনকি নেই মৃত্যুর নিশ্চিত তথ্যও। আর রাষ্ট্রের চোখে তাদের ছেলে, ভাই, স্বামী নিখোঁজ। তাদের পরিবারের জন্য নেই কোনো ন্যায়ের পথ। না কোনো ক্ষতিপূরণ, না কোনো ‘শহীদ’ সনদ, না কোনো সরকারি মৃত্যুর নথি। নামহীন একটি মরদেহ, শুধু একটি অনথিভুক্ত কাগজমাত্র। আর সেই অনথিভুক্ত অবস্থাই তাদের বঞ্চিত করেছে সব ধরনের সহায়তা ও স্বীকৃতি থেকে। কোনো মন্ত্রণালয় কিছু বলেনি। কোনো ডিএনএ ব্যাংক গঠন হয়নি। নিখোঁজদের জন্য তৈরি হয়নি কোনো জাতীয় তালিকা। এ পরিবারগুলো শুধু শোকাহত নয়, তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে অদৃশ্য।
কিছু আন্তর্জাতিক কণ্ঠস্বর এ গোপনীয়, অমানবিক দাফন প্রক্রিয়ার কঠোর সমালোচনা করেছে। তারা একে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং মানুষের প্রতি ন্যূনতম সম্মানবোধের বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করেছে। ন্যায়ের দাবি এসেছে অনেক দিক থেকেই। আবারও আন্দোলনের ডাক উঠেছে—এবার শুধু পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং মৃতদের পরিচয় প্রকাশের দাবিতে। সামাজিক সংগঠনগুলো ডিএনএ পরীক্ষার দাবি জানিয়েছে। সাংবাদিকরা কবরের নথিপত্র দেখতে চেয়েছে।
পরিবারগুলো এখনো খুঁজছে। কিন্তু উত্তর এখনো অধরা। জুলাই আন্দোলনে অজ্ঞাত মরদেহ শনাক্ত করতে শুধু একবারই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তাতেও খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। তারপর? নীরবতা। কিন্তু এই নীরবতা কোনো ভয়ের প্রতিফলন নয়, এটি নির্লিপ্ততা।
যারা ক্ষমতায় থেকে এ হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল, মদদ দিয়েছিল কিংবা চুপ করেছিল—তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। এটি ছিল আন্দোলনকে মুছে ফেলার পরিকল্পনা, যাতে শহীদদেরও মুছে ফেলা যায়। বিলম্বিত ন্যায় শুধু ন্যায়ের অপলাপ নয়, তা ন্যায়ের অপমান। যে শাসকগোষ্ঠী মৃত্যুকে মুছে ফেলার মাধ্যমে রাজত্ব করছিল, তারা আজ আর নেই। কিন্তু তাদের অপরাধ এখনো রয়ে গেছে। এখন নতুন সরকারের দায়িত্ব—সত্যকে আলোর মুখে আনা। প্রতিটি কবর উন্মোচন করতে হবে। প্রতিটি দেহ শনাক্ত করতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে জানতে দিতে হবে, তাদের প্রিয়জন কোথায় শায়িত আছেন। প্রতিটি কবরে যেতে হবে নতুন করে। প্রতিটি অজ্ঞাতনামা দেহের পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি মা জানার অধিকার রাখেন, তার সন্তান কোথায় ঘুমিয়ে আছে। এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি একটি নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের গড়তে হবে শুধু স্মৃতি নয়, রেকর্ড। আমাদের সংগ্রহ করতে হবে সেই নামগুলো, যেগুলো নীরবে উচ্চারিত হয়। সেই ঝাপসা ছবিগুলো, যেগুলো হাত থেকে হাতে ঘোরে। সেই শেষ দেখা স্থানগুলো, যেগুলো কখনো পুনর্মিলনের স্থানে রূপ নেয়নি।
তাদের অনুপস্থিতি জেগে থাকুক আমাদের বিবেকে। প্রতিটি নামহীন কবর হয়ে উঠুক এমন একটি প্রশ্ন, যেটিকে কোনো সরকার মাটিচাপা দিতে পারবে না। প্রতিটি বাঁশের কঞ্চি যেন শুধু নিচের মৃত আত্মার দিকেই নয়, বরং উপরকার অপরাধের দিকেও নির্দেশ করে—একটি অপরাধ, যার বিচার এখনো বাকি। এখন কাজ শুরু হোক। নামগুলো খুঁজে বের করা হোক। আর সেই নামহীন কবরগুলো থেকেই উঠে আসুক ন্যায়বিচার।
লেখক: অধ্যাপক মার্কেটিং বিভাগ ও
আহ্বায়ক, সাদা দল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন