সঠিক নেতৃত্ব তৈরির কারিগর ছিল দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ। ডাকসু, চাকসু, রাকসু, জাকসু, শাকসু, বাকসু নির্বাচনগুলোর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের। এমনকি ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ, বরিশাল বিএম কলেজ, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ, চট্টগ্রামের মহসিন কলেজ, সিলেটের এমসি কলেজ, রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, খুলনার বিএল কলেজ, যশোরের এমএম কলেজসহ সারা দেশের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত করার জন্য, ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উঠে আসা অনেক ছাত্রনেতা পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতির হাল ধরেছে।
গত শতাব্দীর শেষ সময়গুলোর পদধ্বনি আবারও শুনতে পাচ্ছি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর, যা জুলাই আন্দোলনের ফলে প্রাপ্ত পরিবর্তনের ফল। এরই মধ্যে ডাকসু, রাকসু নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন একটা রিহার্সেল বলতে পারেন। গত শতাব্দীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ফেডারেশনসহ বেশ কিছু ছাত্র সংগঠন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত, যা প্যানেল আকারে একক সংগঠন থেকে কিংবা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন নির্বাচনকালীন ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে প্যানেল দিয়ে নির্বাচন করত। ওই সময় প্রতিটি ক্যাম্পাসে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করত। একটা ঈদ ঈদ ভাব থাকত। প্রতি বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য ছাত্রছাত্রীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত।
একসময় ছাত্র সংসদ নির্বাচন দ্বারাও সরকার পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যেত। আশি-নব্বই দশকের ধারাবাহিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনের শেষ অঙ্ক ছিল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন, যা শাকসু নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৯৭ সালে শাকসুর শেষ নির্বাচন হয়। দীর্ঘ সময় পর অ্যাসিড টেস্ট হিসেবে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৯ সালে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নির্বাচনে পরাজয়ের পর পরবর্তীকালে আর ডাকসুসহ অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচনের পথে পা বাড়ায়নি ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
সারা দেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক অবকাঠামো জাতীয় নির্বাচনসহ সব নির্বাচন যেভাবে বছরের পর বছর ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করা হয়েছে, ঠিক একইভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের পর ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সবকিছুতেই একটা পরিবর্তনের আভাস মিলছে, যা আগামীর বাংলাদেশ গঠনে সহায়তা করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র নেতৃত্ব তৈরির কারিগর হিসেবেখ্যাত কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ নির্বাচন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সারা বছর পাঠ্যক্রমবহির্ভূত নানা বিষয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ব্যস্ত সময় পার করতে সহায়তা করত।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকায় ছাত্রদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, অনৈতিক কাজের বিশেষ করে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজদের আবির্ভাব ঘটে। জুলাই আন্দোলনের পরিপূর্ণ ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি শুধু রাজনৈতিক সহনশীলতা না থাকায়। জুলাই আন্দোলনের ফলে জাতীয় রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের আবির্ভাব দেখতে পেয়েছি। জুলাই স্পিরিটকে ধারণ করে গত এক বছরে ডজনখানেক রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটেছে। দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির হালচাল তাদের ওপরও নির্ভর করবে।
জুলাই আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে যেন কোনোভাবেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ভাষা আন্দোলন আমাদের মায়ের ভাষাকে রক্ষা করেছে আর একাত্তর পাকিস্তানি হানাদারদের কাছ থেকে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশের কৃতী সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছে। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে বিশ্বের বুকে ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক আন্দোলনে যে একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানো সম্ভব, তা সারা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। দৃঢ়চেতা মনোবল বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদ, মুগ্ধদের মতো হাজারো ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে স্বৈরাচার তৈরির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। স্যালুট জুলাই আন্দোলনের সৈনিকদের। ক্ষমতালিপ্সুদের জন্য এক কঠিনতম রেড সিগন্যাল। বাংলাদেশিরা যে বীরের জাতি, সাহসী জাতি—তা বারবার প্রমাণ করেছে। মাঝে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও ডা. মিলনের মতো অনেক ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়ে দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
দেশের সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সংস্কৃতি গড়ে উঠুক, সঠিক নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটুক, বিশ্বের দরবারে একটি যোগ্য জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক এবং আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপকার হোক—এ প্রত্যাশা করি।
লেখক: সাবেক জিএস, শাকসু ও
সাবেক প্রেসিডেন্ট, সাস্ট ক্লাব লিমিটেড
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
মন্তব্য করুন